রোমান ঐতিহাসিক সিসেরো বলেছিলেন, ইতিহাসই জীবনের প্রকৃত শিক্ষক। বাঙালির এমনিতেই দুর্নাম রয়েছে ‘ইতিহাসবিস্মৃত জাতি’ বলে। তদুপরি, সভ্য সমাজের অগ্রগতির অন্যতম স্তম্ভ যে ছাত্র রাজনীতি, বাংলায় দীর্ঘদিন তার কোনও প্রামাণ্য ইতিহাসগ্রন্থ লেখার কেউ উদ্যোগ নেয়নি। এই আক্ষেপ অনেকাংশে ঘুচেছে পশ্চিমবঙ্গ তৃণমূল ছাত্র পরিষদের সভাপতি তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের উদ্যোগে, অধ্যাপক সন্দীপন মিত্রের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘সাথী’ (২০২৪) গ্রন্থটির মাধ্যমে। বিষয়বস্তু বাংলার সুদীর্ঘ, ঘটনাবহুল এবং গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র আন্দোলন। এই গ্রন্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের একাধারে রাজনৈতিক ইতিহাসের পাঠ দেবে, আপসহীন জাতীয়তাবাদী রাজনীতির আদর্শে দীক্ষিত করবে এবং সর্বোপরি জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে মানবতার মন্ত্রে মন্দ্রিত করবে।
তৃণমূল কংগ্রেসের বহু প্রবীণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব (যাদের অধিকাংশই ছাত্র রাজনীতির ফসল) সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধির লেখা স্থান পেয়েছে এই সংকলনে। প্রথমেই সংক্ষিপ্ত ‘শুভেচ্ছাবার্তা’য় জননেত্রী, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়— যার নিজের উত্থানও যোগমায়া দেবী কলেজে ছাত্র রাজনীতি থেকে এবং যাঁর নেতৃত্বে বাংলা তথা জাতীয়তাবাদী ছাত্র আন্দোলন নতুন দিশা পেয়েছিল— তাঁর তরুণ বয়সের কূটনৈতিক উপলব্ধির কথা লিখেছেন— ‘বাংলার ছাত্র আন্দোলন পৃথিবীব্যাপী ঠান্ডা যুদ্ধে বামপন্থীদের একটা ভোঁতা অস্ত্র হতে পারে না। আন্দোলনে বাংলার ছাত্রছাত্রীদের দেশপ্রেমী ও জাতীয়তাবাদী কন্ঠস্বরকে প্রাধান্য দিতেই হবে।’
আরও পড়ুন-ডাউকির হাতছানি
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘সংগ্রামী পথের দিশায় একাগ্রতা ও নির্লোভ থাকার’ ব্রত, তাঁর নির্মোহ জীবনবেদ ছাত্রসমাজের কাছে অনুকরণীয় আদর্শ। পরবর্তী ‘শুভেচ্ছাবার্তা’টি মাননীয় সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বাংলার ছাত্রসমাজ তথা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দায়িত্ব তাদেরকে নিজের সুলিখিত বার্তায় মনে করিয়ে দিয়েছেন জননেতা অভিষেক। সঙ্গে বলেছেন, ‘ছাত্র নির্বাচন ফিরিয়ে আনতে হবে। সুষ্ঠু গণতন্ত্র এবং নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিক রাজনীতির পাঠের জন্য এই প্রক্রিয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ, আমাদের বাঁচার প্রেরণা, আমাদের ভবিষ্যতে বাঁচার দিশা একমাত্র ছাত্রসমাজ, যাদের তেজে পরাজিত হবে কুচক্রীরা।’ মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘আজকের তৃণমূল ছাত্র সংসদ বাংলার জন্য যে প্রাগভাষ রচনা করে যাচ্ছে, তার উত্তরভাষ সুনিপুণভাবে লেখার দায়িত্ব আমাদের ভাবী প্রজন্মের।’ ছাত্র আন্দোলনের বৈপ্লবিক ইতিহাসে ঋদ্ধ এই সংকলনের ছত্রে ছত্রে উচ্চারিত ‘ভাবী প্রজন্মের’ জয়যাত্রা। আগামীর এই প্রাণচঞ্চল, সৃষ্টিশীল, নবজোয়ার বইয়ের প্রচ্ছদভাবনাতেও স্পষ্ট।
দাঙ্গাবাজ বিজেপির ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি) হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের সৌজন্যে ভারতবর্ষ যখন বহু খণ্ডে খণ্ডিত, যখন আমাদের ‘গোটা দেশ জুড়ে জউঘর’, তখন একমাত্র পশ্চিমবঙ্গে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাংলার বৈপ্লবিক ভবিষ্যতের দিশারী অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যেভাবে বিরোধীদের শত বিরোধিতা সত্ত্বেও ইফতার পার্টির আয়োজন করেছে, তা সম্প্রীতির এক অনন্য নজির স্থাপন করল। প্রকৃত অর্থেই তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বাংলার যুবসমাজের ‘সাথী’।
নবীন-প্রবীণের সমাবেশে ঋদ্ধ এই সংকলনে প্রতিটি নিবন্ধই তথ্যগুণে বিশিষ্ট। এসেছে বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়ের মতো অগ্রপথিকের কথা, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রথম সভাপতি থাকাকালীন যিনি বাসে-ট্রেনে চেপে, গোটা রাজ্য পায়ে হেঁটে ঘুরে চরম বামপন্থী আগ্রাসনের যুগেও বিভিন্ন কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ইউনিট গঠন করেছিলেন। পড়া জরুরি তাঁর ‘বর্তমান ছাত্রসমাজের কাছে আমার আহ্বান’ নিবন্ধটি। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় মাননীয় অরূপ বিশ্বাসের লেখা নিবন্ধটির কথা। নিউ আলিপুর কলেজের দিনগুলো থেকে ব্যক্তিগত স্তরে ছাত্ররাজনীতির আঙিনায় বাম ছাত্রসংগঠন এসএফআইয়ের অকথ্য অত্যাচারের যে ভয়াবহ ইতিহাস তুলে ধরেছেন, তা পড়তে পড়তে তৃণমূল ছাত্র পরিষদকে শুধুই ধন্যবাদ জানাতে ইচ্ছে করে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পড়াশোনাকে গুরুত্বহীন করে দিয়ে ছাত্র রাজনীতির নামে মাৎস্যন্যায় চালানো ছিল তথাকথিত বাম ছাত্র সংগঠনগুলির রোজনামচা। শুধু অরূপ বিশ্বাস নয়, কৃষ্ণা চক্রবর্তী, দেবব্রত চাকীর লেখাতেও বাম ছাত্র রাজনীতির কদর্য ছবিটি প্রকট হয়েছে। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে কৃষ্ণকুমার দাস, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রণব হাজরার ভয়াবহ অভিজ্ঞতাও এ-প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। আজকের প্রজন্ম সেই কদর্যতা, ভয়াবহতার কথা হয়তো জানে না। তাদের সকলের অবশ্য পাঠ্য ‘সাথী’। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর আদর্শ এবং ছাত্রযুবদের আইকন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৎ, সহিষ্ণু অথচ প্রত্যয়ী ব্যক্তিত্বের হিরণ্ময় ছটা-কে সম্বল করে, তৃণাঙ্কুর ভট্টাচার্যের সুযোগ্য নেতৃত্বে এগিয়ে চলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ‘রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বীর সুভাষের’ ভারতবর্ষকে জগৎসভায় আবার শ্রেষ্ঠ করে তোলার যজ্ঞে অবতীর্ণ হয়েছে। ‘সাথী’ সেই যজ্ঞেরই নান্দীমুখ রচনা করে দিল।
আরও পড়ুন-২৮ অগাস্ট আমাদের সেন্টিমেন্ট
প্রখ্যাত সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্যের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের ‘জন্মদিন’ ২৮শে আগস্ট নিয়ে লেখা নিবন্ধটিও নিঃসন্দেহে এই সংকলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, বাম বিরোধী ছাত্র আন্দোলন মাত্রই তাত্ত্বিক দিক থেকে দুর্বল— এমন ভ্রান্ত ন্যারেটিভ বহুদিন ধরেই প্রচলিত। আমরা সবাই কমবেশি চিনি আগমার্কা এই বাম উন্নাসিকতাকে : সিপিএমের সমর্থক মাত্রই উচ্চশিক্ষিত, বাকি সবাই মূর্খ। কাজেই এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই, সিপিএমের ছাত্রদলও এই একই মিথ্যে ন্যারেটিভ লালন করবে। আশা করা যায়, ‘সাথী’ এই ন্যারেটিভকে বহুলাংশে ভেঙে ফেলতে সক্ষম হবে।
তরুণ সম্পাদক সন্দীপন মিত্র অক্লান্ত পরিশ্রম করে, অত্যন্ত যত্নসহকারে বইটি নির্মাণ করেছেন। তথ্যনির্দেশ থেকে যাবতীয় সালতামামি, তথ্যের নিশ্চয়তা থেকে তত্ত্বের সহজপাচ্যতা, সবদিকেই নজর রেখেছেন তিনি, কারণ যতই হোক, এই বই মূলত ‘ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে’ লেখা। তাঁর নিজের লেখা নিবন্ধ ‘জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও উন্নয়ন : কিছু জরুরি কথা’ ছাত্র-শিক্ষক, গবেষক তথা পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জনগণের পাঠ করা উচিত। আশা রাখা যায়, বাংলার ছেলেমেয়েরা ‘সাথী’ পড়বে এবং তৃণমূল ছাত্র পরিষদের স্নেহাশ্রয়ে অক্ষত রাখবে নিজেদের “কাঁচ-রোদ্দুর, ছায়া-অরণ্য, হৃদয়ের স্বপ্ন” (‘কাঁচ-রোদ্দুর, ছায়া-অরণ্য’/ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)।