মুখর বাদর দিনে…

বৃষ্টি কারও মনে আনন্দের ঢেউ তোলে, কারও মনে জাগায় মনকেমনিয়া ভাব। বর্ষায় কেউ ধরতেন মাছ, কেউ চা-বাগান দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে গাইতেন গান। ভেজা গায়ে সিনেমা দেখেছেন কেউ, কেউ আবার গান গেয়ে নামিয়েছেন বৃষ্টি! কারও আবার গৃহহারাদের কথা ভেবে হয়েছে মনখারাপ। সবমিলিয়ে বৃষ্টি নিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টদের প্রচুর স্মৃতি। উজাড় করলেন তাঁরা। শুনলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

Chiranjeet Chakraborty — The Movie Database (TMDB)খিচুড়ি বসানো মাত্র বৃষ্টি থেমে যায়
চিরঞ্জিত চক্রবর্তী
ছেলেবেলায় বৃষ্টি (Rainy days) আমার কাছে খুব মজার ছিল। পাঁচ-ছয় বছর বয়সে ঢাকুরিয়ায় থাকতাম। তখন শুনতাম, বৃষ্টিতে পুকুরগুলো ডুবে গিয়ে মাছ বাইরে চলে আসে। ভাবতাম, আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তায় জল জমলে পুকুরের মাছ ভেসে এলে আমি ধরব। পরিকল্পনামাফিক একটা কাঠিতে সুতো বেঁধে, ডগায় খাবার দিয়ে ঝুলিয়ে বৃষ্টির মধ্যে খোলা ড্রেনের সামনে বসে থাকতাম। মাছ বলতে যেগুলো ভাবতাম, সেগুলো আসলে ব্যাঙাচি।
কোনও একবার খুব বৃষ্টি (Rainy days) হয়েছিল। আমাদের রাস্তায় জল জমেছিল। তখন আমাদের অ্যাকোয়ারিয়াম ছিল। মাছ তোলার জন্য ছিল হাতলওয়ালা জাল। সেটা নিয়ে আমি বেশ কিছুক্ষণ জলে বসেছিলাম। মায়ের বকুনি খেয়ে ভেতরে আসি।
আর একটা ভাললাগার বিষয় ছিল, জোরে বৃষ্টি হলে স্কুল যেতে হত না। তখন শিশুভবনে পড়তাম। গোলপার্কের বাড়িতে আসার পর একটু বড় বয়সে একবার তুমুল বৃষ্টির মুখে পড়েছিলাম। জাদুকর পি সি সরকার জুনিয়র ছিল আমার বন্ধু। সম্ভবত ১৯৭৮ সাল। দু’জনে মিলে দেখতে গিয়েছিলাম জেরি লুইসের হাসির ছবি ‘ডোন্ড রাইস দ্য ব্রিজ লোয়ার দ্যা রিভার’। ছবিটা চলার সময়ে বাইরে জোরে বৃষ্টি নামল। শো ভাঙতেই গাড়ি করে বন্ধুর বাড়ি ইন্দ্রজাল ভবনে চলে গেলাম। তখন ওর বাবা জাদুসম্রাট সিনিয়র পি সি সরকার ছিলেন। তিনি বললেন, ‘‍‘এত রাতে তোমরা ফিরছ? এখানে থেকে যাও।’’ বাড়িতে খবর দিয়ে দিলাম। তিনতলায় আমাদের খাবারদাবার এসে গেল। আমি শুলাম বিছানায়, বন্ধুটি মেঝেতে। এত বৃষ্টি, তিনদিন আটকে গেলাম। শান্তিনিকেতনের বৃষ্টি আমার দারুণ লাগে। আসলে শান্তিনিকেতনের বৃষ্টি মানেই রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের গান। লালচে পাথুরে মাটি। বৃষ্টিতে জল জমে না। আমার এক বন্ধু থাকে শান্তিনিকেতনে। মাঝেমধ্যেই তার কাছে যাই। সুন্দর বাগান। লন। খুব ভাল সময় কাটে। পাতায় জমা জল টুপ টুপ করে নিচে পড়ে। দেখতে দারুণ লাগে। বর্ষায় ব্যাঙেদের মুভমেন্ট দেখতেও খুব ভাল লাগে। ব্যাঙ ডাকলেই বুঝতে পারি বৃষ্টি হবে।
আমি থাকি সার্দান অ্যাভিনিউয়ে। একটা সময় এখানে প্রচুর জল জমত। এখন আর সেই সমস্যা নেই। বৃষ্টিদিনে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে অফুরন্ত সবুজের সৌন্দর্য দেখি। এখন একটা ফর্মুলা আবিষ্কার করেছি। আমি এবং আমার স্ত্রী। বৃষ্টি থামাতে চাইলেই খিচুড়ির পরিকল্পনা করি। খিচুড়ি বসানো মাত্র বৃষ্টি থেমে যায়!

Subodh Sarkar | Poet Subodh Sarkar stands by SSC protesters who are on hunger strike since 26 days dgtl - Anandabazarডুয়ার্সের বৃষ্টিই সেরা
সুবোধ সরকার
আমার জীবনের প্রথম চাকরি ছিল ডুয়ার্সে। ডুয়ার্সের সুকান্ত মহাবিদ্যালযয়ে আমি প্রথম অধ্যাপনার চাকরি নিয়ে যাই। সেটা ধূপগুড়িতে। তখন বয়স অল্প। এখনও পর্যন্ত আমি কুড়ি-পঁচিশটা দেশের বৃষ্টি দেখেছি। যাকে বলে ঝরঝর বারিধারা। ক্যালিফোর্নিয়ার বৃষ্টি দেখেছি, গ্রিসের বৃষ্টি দেখেছি, নিউ ইয়র্ক শহরের বৃষ্টি দেখেছি। তবে আমি ডুয়ার্সের বৃষ্টি ভুলতে পারি না। বৃষ্টি হলে আমি বেরিয়ে পড়তাম। এক ঘণ্টা দু’ঘণ্টা ঝরার পর রাস্তা মোটামুটি শুকিয়ে যেত। জল জমত না। জল নেমে যেত। চারপাশে ছোট ছোট ঝোরা, জল টেনে নিত। ১৯৮৫-’৮৬ সালের কথা বলছি। এখন কী হয়, বলতে পারব না। সবচেয়ে ভাল লাগত চা-বাগানের বৃষ্টি। চা-বাগানের বাংলোর বারান্দা থেকে বৃষ্টি দেখতাম। চা-বাগানগুলোয় অনেকটা কলোনিয়াল ব্যাপার ছিল, আছে। চা-বাগানের বাংলোগুলো আরও বেশি কলোনিয়াল। বাংলোয় বসে বৃষ্টি দেখার সময় মনে হত, পৃথিবীতে এর থেকে সুন্দর আর কিছু হতে পারে না। তবে আমি খুব বেশিক্ষণ বারান্দায় বসে থাকতে পারতাম না। আমাকে বৃষ্টি টানত। আমি ছুটে নেমে বেরিয়ে যেতাম। চা-বাগানের ভিতর দিয়ে দৌড়তাম। গান গাইতে গাইতে হাঁটতাম। বৃষ্টিতে স্নান করে আবার বাংলোয় ফিরতাম। ডুয়ার্স এবং পাহাড় অদ্ভুত সুন্দর হয়ে উঠত বর্ষায়। এত অসামান্য বৃষ্টি, এর বর্ণনা করার ক্ষমতাও আমাদের নেই। পেরেছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। কবিতায় ডুয়ার্সের বৃষ্টির অসামান্য বর্ণনা করেছিলেন। বৃষ্টি আসলে একই। জায়গা অনুসারে চরিত্র বদলে যায়। এক-এক জায়গার বৃষ্টি এক-একরকম লাগে। দিল্লির বৃষ্টি আমার মনে কোনওদিন রেখাপাত করতে পারেনি। আগে কলকাতায় বৃষ্টি হলে ভয়ঙ্কর জল জমত। এখন আর সেইরকম হয় না। তবে মুম্বইয়ে প্রচুর জল জমে। মুম্বইয়ের বৃষ্টি আগেকার কলকাতাকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। অমিতাভ বচ্চনের বাড়ির সামনে হাঁটুজল। ঘরবন্দি থাকতে হয়। যাই হোক, আমার কাছে ডুয়ার্সের বৃষ্টিই সেরা। এই বৃষ্টি আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।

আরও পড়ুন-ভূগর্ভের গভীর থেকে অতীতের ডাক বাসুকি ইন্ডিকাসের কাহিনি

Rajatava Dutta | Rajatava Dutta opens up on his roles, career and his views regarding the current trends of Bengali entertainment industry dgtl - Anandabazarসিনেমা হলে ঢুকলাম ভেজা গায়ে
রজতাভ দত্ত
প্রথমেই যেটা মনে পড়ে বৃষ্টি (Rainy days) পড়লেই রেনি ডে। দ্বিতীয়ত, কখনও স্কুলে রয়েছি, সেই সময় বৃষ্টি নেমেছে, জল ঠেলে বাড়ি এসে হাত-পা ধুয়ে বাড়ির সামনে রাস্তায় জমা জলে কাগজের নৌকো ভাসিয়েছি। আরও ছোটবেলায় বিদ্যুতের গর্জনে সত্যি সত্যি খুব ভয় পেয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতাম। মায়ের গায়ের গন্ধ এবং বৃষ্টি বা বজ্রপাতের ভয়ংকর আওয়াজ জড়িয়ে থাকত। মা ছিল তখন আশ্রয় এবং সান্ত্বনা।
আমরা ছিলাম মধ্যবিত্ত পরিবার। বর্ষায় খিচুড়ি হত। তার সঙ্গে হত কুমড়ো ভাজা। ডিম ভাজা বা ইলিশ মাছ ভাজা সাধারণত হত না। ডিম ভাজা মানে তখন কিন্তু অমলেট নয়, ডিমকে সেদ্ধ করে বেসনে চুবিয়ে ভাজা। এইগুলো আরেকটু পরে ধীরে ধীরে জীবনে এসেছে।
উত্তর কলকাতা তুলনায় দক্ষিণ কলকাতায় জল কম জমত। আমাদের বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা ঘাস জমি ছিল। বৃষ্টি হলে কলকাতার বাড়িতে বসেই আমি ব্যাঙের ডাক শুনেছি। পরে দেখেছি ঘাসের মধ্যে ব্যাঙের ডিম জমে থাকতে। তখন আমাদের জীবনবিজ্ঞান বইয়ে সেগুলো পড়ানো হচ্ছে। ব্যাঙাচি বেরতেও দেখেছি। চিনেছি মশার লার্ভা। এইগুলো ছিল অপার বিস্ময়।
পরবর্তিকালে, যখন কলেজের চৌহদ্দি পেরিয়েছি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের মতো যাঁরা একটু বোহেমিয়ান জীবন যাপন করতেন, তাঁদের কিছু স্মৃতিকথা ও সাহিত্যের প্রভাব আমাদের উপর একটু একটু করে পড়েছিল। আমি দক্ষিণ কলকাতা ছেলে। কিন্তু এই গল্প-স্মৃতিকথাগুলো জড়িয়ে থাকত উত্তর কলকাতার সঙ্গে। আমার বন্ধু কবি, কয়েক বছর আগে প্রয়াত রূপক চক্রবর্তীর উৎসাহেই আমি, রূপক এবং আর এক বন্ধু বাবুন, তিনজন মিলে বৃষ্টির মধ্যে উত্তর কলকাতায় হাঁটুর ওপরে জমা জল ঠেলে খালি গায়ে ঘুরে ঘুরে কলকাতা দেখতাম। দুপুর থেকে বিকেল, সন্ধে পর্যন্ত। সন্ধের পর জল কিছুটা নেমে গেলে চা-শিঙাড়া খেয়ে বাড়ি ফিরতাম। নোংরা জলে হাঁটাহাঁটি করে মুশকিলেও পড়েছি। অসুখবিসুখও করেছে। ওই স্মৃতিটা খুব জমকালো হয়ে আছে। সবকিছু তখন মনে হত বিরাট বাহাদুরি ব্যাপার।
আর একটা স্মৃতি মনে আছে। একটা সময় ধর্মতলা পাড়ায় নিয়মিত সিনেমা দেখতে যেতাম। সাড়ে এগারোটা নাগাদ নামতাম, পরপর চারটে শো দেখতাম। একবার ধর্মতলায় তুমুল বৃষ্টির মধ্যে নেমেছি। সিনেমা হলে ঢুকলাম ভেজা গায়ে। সারাদিন সিনেমা দেখতে দেখতে পুরো জামা কাপড় গায়ে এসির ঠান্ডায় শুকিয়ে গেল। তার জন্য কোনওরকম সর্দি-জ্বর হয়নি।

Swagatalakshmi Dasgupta music, videos, stats, and photos | Last.fmবৃষ্টি এলেই মানুষের অসুবিধা
স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্ত
বর্ষার রোম্যান্টিসিজিম ছোটবেলায় খুব একটা অনুভব করতে পারতাম না। আমি উত্তর কলকাতার সিঁথিতে মানুষ। সুতরাং বর্ষা মানেই দেখতাম জলমগ্ন পাড়া। বৃষ্টি (Rainy days) হলেই বাবা মাকে বলতেন, চালে-ডালে বসিয়ে দাও। জলে ছপছপ করতে করতে আমার দাদা সন্ধেবেলায় দোকান যেত ডাল কিনতে। খিচুড়ি হত, বেগুন ভাজা হত। স্টকে ইলিশ মাছ থাকলে ইলিশ মাছ ভাজা হত। না হলে যে কোনও মাছ ভাজা। জমিয়ে খাওয়াদাওয়া। খুব বেশি বৃষ্টি হলে আমার মনে হত, জল জমে গেলে গৃহহারাদের কী হবে, বস্তির বাসিন্দাদের কী হবে। এটা আমাকে খুব কষ্ট দিত। মনে পড়ছে, একবার কফিহাউসে বসে বসে বর্ষা নিয়ে কবিতা লিখেছিলাম। ছন্দের কবিতা। শেষের স্তবকটা ছিল ‘এলোমেলো বরষায়/ বস্তিটা ভেসে যায়/ কবি সুখে লিখে যায়/ কবিতা কবিতা।/ ছন্দ মানে না বাগ/ আবেগটা কেটে যায়,/ কাগজটা সাদা রাখি/ কবিতা কবিতা।’
ছোট থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত বর্ষা আমার প্রিয় ঋতু ছিল না। সারাক্ষণ মাথায় ঘুরত, বৃষ্টি এলেই মানুষের অসুবিধা হবে। বন্যা হবে। আদ্যাপীঠের মুরালভাইয়ের কাছে মানুষের সমস্যার কথা শুনতাম। ওঁরা ত্রাণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।
বড় বয়সে আমি বর্ষাকে ভালবেসেছি রবীন্দ্রনাথের গানের হাত ধরে। বর্ষাকে স্বচক্ষে দেখে যত না রোম্যান্টিক হতে পেরেছি, তার তুলনায় বেশি রোম্যান্টিক হয়েছি রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে। উনি যেভাবে দেখিয়েছেন, আমি সেভাবে বর্ষাকে দেখেছি।
বর্ষার মধ্যে বহু জায়গায় অনুষ্ঠানে গেছি। একটি দিনের কথা মনে পড়ছে। হাওড়ার সালকিয়ায় জটাধারী পার্কে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। তুমুল বৃষ্টির মধ্যে প্রায় দশ হাজার শ্রোতা ছাতা মাথায় বসে রবীন্দ্রনাথের গান শুনছিলেন। গান এবং বর্ষার অসাধারণ এক সমন্বয় ঘটেছিল। আমার দেখা বর্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা।

Saikat Mitra hits songsগান গেয়েছিল বৃষ্টি
সৈকত মিত্র
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। হাওড়া শরৎ সদনের চত্বরে সান্ধ্যকালীন অনুষ্ঠান ছিল। বেশ সুন্দর প্যান্ডেল বানানো হয়েছে। খুব সম্ভবত ‘হাওড়া সঙ্গীত মেলা’, উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন হাওড়ার মান্যগণ্য ব্যক্তিবর্গ। বেশ সুন্দর আয়োজন। কিন্তু, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের তাপপ্রবাহে দর্শকদের এবং শিল্পীদের হাঁসফাঁস অবস্থা।
আমি মঞ্চে উঠে গান শুরু করলাম। শ্রোতাদের অনুরোধ আসা শুরু হল। কেউ একজন বলে উঠলেন, ‘‍‘এমন কোনও গান করুন যাতে একটু বৃষ্টি হয়, গরমে কষ্ট হচ্ছে।’’ হাসতে হাসতে বললাম, ‘‍‘বৃষ্টি নিয়ে আমি এই বছরেই একটা গান করেছি, গেয়ে শোনাচ্ছি।’’ সঙ্গে সঙ্গে আমি ‘ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিরে’ গানটি গাইতে শুরু করলাম। ও মা, অবাক কাণ্ড! একটা ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করল এবং গানের শেষের দিকে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়া শুরু হল। আমি গান থামিয়ে দিয়েছিলাম। এখনও বেশকিছু শ্রোতা সেদিনের কথা মনে করিয়ে দেন। মনে হয়, সেদিন আমি গাইনি। গান গেয়েছিল বৃষ্টি (Rainy days)।

Latest article