তৃণমূল কংগ্রেসের (Trinamool Congress) যা কিছু দুর্বলতা, খারাপ দিক, তা চোখের সামনেই খোলাখুলি দেখতে পাবেন আপনি| সবটুকুই এক্কেবারে ওভার দ্য গ্রাউন্ড, সমাজের সারফেস লেভেলে! রেজিমেন্টেড, স্ট্রাকচার্ড, স্তালিনিস্ট দল নয় বলে তাদের দুর্বলতা চোখে পড়ে যায়! এই ভ্রান্তিগুলো সমাজের সারফেস লেভেল ছাপিয়ে ডিপ স্ট্রাকচারকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখে না! বিজেপি বা তার শরিক দলগুলো এর চেয়ে কয়েকশো গুণ বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত। তা সত্ত্বেও তারা নিজেদের যাবতীয় জনবিরোধী, অর্থনৈতিক, নারীবিরোধী, দলিতবিরোধী অপকর্ম অনায়াসেই কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখতে পারে। একটি অঙ্গরাজ্যে দাঁড়িয়ে বিজেপির মতো আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে অসম লড়াই চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। তার যেকোনও ত্রুটি-বিচ্যুতিকেই দানবাকৃতি হিসেবে দেখানো হয়, আর ক্লিনচিট পেয়ে যায় বিজেপি। ভারতের সাংবিধানিক কাঠামো, সংসদীয় গণতন্ত্র সবকিছুই আজ ধ্বংসের মুখে এই মোদি জমানায়। কিন্তু লক্ষ করবেন, কায়েমি স্বার্থের মূল আক্রমণ কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস (Trinamool Congress) সরকারেরই বিরুদ্ধে।
বিজেপি আজ বাংলার সুদীর্ঘলালিত সোশ্যাল ফ্যাব্রিক, ডিপ স্ট্রাকচার এক্কেবারে ভিতর থেকে ভেঙে চুরমার করে দেবার সুপরিকল্পিত দীর্ঘমেয়াদি সুদূরপ্রসারী এজেন্ডা নিয়ে নেমেছে| এটা আরএসএস-এর ১০০ বছরের প্রোজেক্ট: ‘মিশন বেঙ্গল’| শূদ্র বাংলা, বৌদ্ধ বাংলা, বৈষ্ণব বাংলা, সহজিয়া তন্ত্রের শাক্ত বাংলা, মুসলমান বাংলাকে তারা হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের মনুবাদী, মুসলিমবিরোধী, নারীবিদ্বেষী উপনিবেশ বানাতে চায়! মজলুম বাঙালিকে ওরা গো-বলয়ের নব্য-ক্রীতদাস বানাতে চায়!
ওদের হাতে কোটি কোটি টাকা, বিপুল সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যম এবং সুখী, আত্মতৃপ্ত, চরম প্রিভিলেজড সুশীল সমাজ| এদের সংখ্যা অত্যন্ত কম কিন্তু জনমত নির্ধারণে, ‘ম্যানুফ্যাকচারিং কনসেন্ট’ নির্মাণে এরা ২০০ ভাগ সক্ষম। বাংলার সমাজের বিগত ২৫০ বছরের ইতিহাসে এরাই সমস্ত ক্ষমতার ক্রিমটুকু খেয়েছে, আগামী ২৫০ বছরও যাতে সেই ক্রিমি লেয়ার হয়েই বেঁচে থাকা যায়, তাই বিজেপির মতো বাংলাদ্বেষী, বাঙালিবিদ্বেষী ইকোসিস্টেমকে সঙ্গে নিয়ে ওরা বর্গি লুটেরাদের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়েছে| বাংলা ওদের মাংসখণ্ড| ওরা বাংলাকে ধ্বংস করবে| বিগত দুই শতকের যা কিছু শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকার বাঙালি অর্জন করেছে, সেই কৃষ্টি, যুক্তিবাদী বোধ, মনন, মেধা ও তীব্র রাজনৈতিক চেতনা এই সবকিছু এরা পশ্চিম ভারতীয় কর্পোরেট পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেবে। এটাই ওদের একমাত্র এজেন্ডা! ইতিমধ্যেই বিজেপির বাঙালি তাত্ত্বিকরা রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটকদের বিরুদ্ধে ন্যারেটিভ নামাতে আরম্ভ করেছে।
তৃণমূল (Trinamool Congress) যেটা পেরেছে তা হল, বাংলার ২০০ বছরের অবনমিত সাব-অল্টার্ন সমাজকে নিচুতলা থেকে মঞ্চের উপরে তুলে এনেছে! তাদের সামাজিক মর্যাদা দিয়েছে| যাদের কোনও ফ্যামিলি ক্যাপিটাল, সোশ্যাল ক্যাপিটাল, সোশ্যাল কানেকশন, কালচারাল ক্যাপিটাল, এমনকী হাই এডুকেশনাল ক্যাপিটাল অব্দি ছিল না, যাদের বাপ-কাকা-দাদা ধরার সুযোগ ছিল না, তাদের এক বৃহদংশকে বিপুল প্রমিনেন্স দিয়েছে! আরও বহু কাজ বাকি! অজস্র নামগোত্রহীন অথচ অসম্ভব প্রতিভাবান তৃণমূল সমর্থক ও কর্মী জেলায় জেলায় কাজ করছেন! সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে তাঁরা দলের হয়ে ক্রিয়েটিভ লড়াই লড়ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং পথে-ঘাটে-স্ট্রিট কর্নারে! দলের উচিত তাদের খুঁজে বের করে যথার্থ স্বীকৃতি দেওয়া! তাদের সামনের সারিতে নিয়ে আসা!
আরও পড়ুন-ডবল ইঞ্জিন সরকারের রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে তরুণীর দেহ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা যুবকের
এটাই বাংলার ৫ থেকে ১০ ভাগ সমস্ত সামাজিক ক্ষেত্রে প্রিভিলেজড এগিয়ে থাকা উচ্চ স্তরের মানুষের গায়ের জ্বালা! এটাই তাদের গেল-গেল রবের কারণ। এই সবরকমের সুবিধাভোগী, অন্তত আট-দশ পুরুষের ফ্যামিলি ও সোশ্যাল ক্যাপিটাল-ওয়ালাদের একবার জিগেস করুন: তৃণমূল কংগ্রেস কি তোমাদের কোনও ব্যক্তিগত ক্ষতি করেছে? উত্তর আসবে, ‘না’! তবু এরা জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে তৃণমূলকে নিয়ে!
তৃণমূল কংগ্রেস সমাজতাত্ত্বিক পরিভাষায় ‘লেসার ভদ্রলোক’ (ঋণ: তাত্ত্বিক দীপেশ চক্রবর্তী) আর বাবুদের দ্বারা চিহ্নিত তথাকথিত, নিচুতলার অবনমিত, সামাজিক ক্ষমতাবিহীন ৯০ ভাগ মানুষের পার্টি! তাই অনায়াসেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কালীঘাটের ঝি, ডাকাতরানি, মমতাজ বেগম, পটুয়াপাড়ার মেয়েছেলে বলে ডাকা যায়! তাই না? ১৭৫৭-র পলাশির যুদ্ধ, ১৭৬৫-র দেওয়ানি লাভ, ১৭৭০-এ পরিকল্পিত গণহত্যার মাধ্যমে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ কৃষক, হকার, কারিগর, দেশীয় ব্যবসায়ী শ্রেণিকে ধ্বংস করে বিশ্বের প্রথম ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট পলিসি’ চাপিয়ে দেওয়া এবং ১৭৯৩-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর মাধ্যমে দেশীয় অনুগত জমিদারশ্রেণি তৈরি করে এরাই বাংলার ৯০ ভাগ মধ্যম ও নিম্নবর্গ এবং মুসলমান সমাজকে সমস্ত ক্ষমতাকাঠামোর বাইরে ঠেলে দিয়েছে!
ইতিহাস এইবার প্রতিশোধ নিচ্ছে! অবনমিতের উত্থান ও অভ্যুত্থানের অপর নাম তৃণমূল কংগ্রেস| তৃণমূল কোনওভাবেই মুছে যাবে না! নিচুতলার যে আপওয়ার্ড মোবিলিটি শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস, তার ফল বাংলার মাটিতে হবে সুদূরপ্রসারী! সমস্ত সামাজিক হিসেব উল্টে দেবে তৃণমূল কংগ্রেস! মিলিয়ে নেবেন! বিগত ১৫ বছরে বাংলার মেয়েদের একটু গ্রাউন্ড লেভেলে নেমে খুঁজে দেখুন! একটু চারিপাশের ক্ষুদ্র ঘেরাটোপ ভেঙে বাইরে তাকান। বাঙালি মেয়েরা বিগত ২৫০ বছরে এরকম ডেসপ্যারেট, স্বাধীনচেতা, আত্মপ্রতিষ্ঠাকামী, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হতে পারেনি! আজ হচ্ছে! সামাজিক, পারিবারিক ট্যাবু ভেঙে মেয়েরা আজ ডানা মেলতে শিখছে! ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া, নিজের দেশের মানুষকে ঘেন্না করতে শেখা ১০ ভাগ সুবিধাভোগী বাঙালির বাইরেই গোটা পশ্চিমবঙ্গ| তাকে বুঝতে শিখুন! যে সুবিধাভোগী অংশ এই উত্থান মেনে নিতে পারছেন না, তাঁদের ভণ্ড এলিটিজমে গ্যামাক্সিন দেওয়ার নাম তৃণমূল কংগ্রেস! এই গ্যামাক্সিন ছিটিয়ে দেওয়ার কাজ চলছে, চলবে!
জয় বাংলা! জয় বাঙালি!