প্রতিবছর ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হয়। ওই দিন প্রবাদপ্রতিম আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক সর্বপল্লি রাধাকৃষ্ণনের (Sarvepalli Radhakrishnan) জন্মদিন। ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর ডক্টর রাধাকৃষ্ণন ভারতের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি এবং তারপর রাষ্ট্রপতি। কিন্তু সেটা তাঁর আসল পরিচয় নয়। তিনি একজন প্রবাদপ্রতিম আদর্শ শিক্ষক ছিলেন। মাদ্রাজে একটি কলেজে দর্শনশাস্ত্রের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে তাঁর শিক্ষকজীবন শুরু হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তরুণ গবেষক রাধাকৃষ্ণনের একটি প্রবন্ধ পড়ে তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কার্যত রাধাকৃষ্ণনকে আবিষ্কার করেছিলেন স্যার আশুতোষ, যাঁর ছিল জহুরির চোখ। তাঁর আরও আবিষ্কার পরবর্তীকালে নোবেলজয়ী পদার্থবিদ্যাবিদ সিভি রমন, ভবিষ্যতের বিশ্বজোড়া খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক ডক্টর রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। কয়েক বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার পর, বিশেষ করে স্যার আশুতোষের মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে ডক্টর রাধাকৃষ্ণন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। ধীরে ধীরে শিক্ষক হিসাবে তাঁর সুনাম শুধু ইংল্যান্ডে নয়, অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। উপরাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ও রাষ্ট্রপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণের পরেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নিয়মিত অধ্যয়ন ও গবেষণায় সময় অতিবাহিত করেছেন।
৫ সেপ্টেম্বর নানা অনুষ্ঠান হয়। কিন্তু এই দিনটি নিছক রুটিন অনুষ্ঠানের দিন নয়। দিনটি শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত সকলের আত্মসমীক্ষার দিন। শিক্ষক হিসাবে আমরা কতটা দায়িত্ব পালন করতে পারছি বা পেরেছি। এখন শিক্ষক বলতে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষককে বোঝানো হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি আছে কিনা। শুধু ক্লাসের মধ্যে পড়ানোর দ্বারা ছাত্রছাত্রীরা অনুপ্রাণিত হয় না। শিক্ষকের ব্যক্তিত্ব, গতিশীলতা, এমনকী ব্যক্তগত জীবনধারাও ছাত্রসমাজকে প্রভাবিত করে। আমরা যখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন আমাদের শিক্ষকদের বেতন খুবই কম ছিল। কিন্তু কী নিষ্ঠা নিয়ে তাঁরা পড়াতেন। ক্লাসে কোনও মাস্টারমশাই অনুপস্থিত থাকবেন, এটা ব্যতিক্রম ছিল। কোনও মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে গেলে না খাইয়ে ছাড়তেন না। অথচ তখন এটা বোঝার বয়স হয়নি, মাস্টারমশাইয়ের এবং তাঁর পরিবারের খাওয়ার বন্দোবস্ত হয়েছে কিনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা উত্তর দেখে সংশোধন করে দিতেন। বিন্দুমাত্র কিছু প্রত্যাশা করতেন না।
আরও পড়ুন-তৃণমূলকে মোকাবিলায় ব্যর্থ তাই সেনাকে অপব্যবহার বিজেপির
আজ পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বেতন অনেকগুণ বেড়েছে। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। গবেষণার অনেক সুবিধা বেড়েছে। যখন আমরা প্রেসিডেন্সি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, অধ্যাপকদের মধ্যে মাত্র দুই-একজনের ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল। এখন যে সমস্ত কলেজে একটু খালি জায়গা বা ক্যাম্পাস আছে, অধ্যাপক-অধ্যাপিকাদের গাড়ি রাখবার জায়গা পাওয়া দুষ্কর। এ-সব ঠিকই আছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব পরিস্থিতির পরিবর্তন অনিবার্য। আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দায়িত্ববোধ কতটা বেড়েছে। কলেজের স্টাফরুমগুলিতে (staff room) পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা হয় কি? কতজন শিক্ষক অবসর সময়ে গ্রন্থাগার ব্যবহার করেন এবং ছাত্রছাত্রীদের হাতে-কলমে কীভাবে গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে হয়, শিক্ষা দেন? বেতন বাড়ছে, সেইভাবে ট্যুইশনির বাজার রমরমিয়ে বাড়ছে। স্কুল-কলেজে ঠিকমতো ক্লাস হলে কি ট্যুইশনের দরকার হয়! এরকমও অভিযোগ আসছে। পিএইচডি-র একশ্রেণির তত্ত্বাবধায়কেরা (supervisor) গবেষকদের কাছ থেকে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন, যেটা ১৯৭০-এর দশকে কল্পনার অতীত ছিল। কার্যত শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ অপশাসন। শিক্ষার নগ্ন রাজনীতিকরণের ফলে যে ব্যক্তির জাহাজের খালাসি হওয়ার কথা ছিল, তিনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছেন! শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও মর্যাদার সম্পর্ক ছিল, সেটা হারিয়ে গেল বামফ্রন্টের শাসনকালে। সিপিএম কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে কলকারখানা গণ্য করে অধ্যাপিকা-অধ্যাপকদের এবং কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে শ্রেণিশত্রু মনে করে বিধ্বংসী আন্দোলন শুরু করল। আজ তারা এবং তাদের তাঁবেদাররা টিভি চ্যানেলে বসে বড় বড় মিথ্যা কথা বলছেন।
ডক্টর রাধাকৃষ্ণনের (Sarvepalli Radhakrishnan) মূল প্রেরণা ছিল ভারতের মিশ্র সনাতন সংস্কৃতি। এই প্রেরণা থেকে এসেছে তাঁর স্বদেশচেতনা এবং জাতীয়তাবোধ বা রাষ্ট্রীয়তাবোধের অনুভূতি। এই উদার মিশ্র সংস্কৃতির প্রতীক ছিলেন ভগবান বুদ্ধ, মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য এবং বর্তমানে রামকৃষ্ণ ও স্বামী বিবেকানন্দ। রাধাকৃষ্ণানের বালক বয়স থেকেই বিবেকানন্দের প্রতি গভীর শ্রদ্ধার অনুভূতি ছিল, যেটা তিনি তাঁর বিভিন্ন লেখার ছত্রে ছত্রে প্রকাশ করেছেন। আমরা যাঁরা শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত আছি, তাঁদের এ-কথাও অনুভব করবার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা না থাকলে, পৃথিবীর মাটিতে শক্ত পায়ে দাঁড়ানো যায় না, মেরুদণ্ড সোজা রাখা যায় না, মানবিক মূল্যবোধ তৈরি হয় না। আমাদের কাজ, জীবনচর্চা ও প্রতিদিনের আচরণ দেখে ছাত্রেরা শিখবে, নিছক পুঁথিগত পাণ্ডিত্য ও ভাষণ থেকে নয়।
তাই আজ আত্মবিশ্লেষণের দিন, আত্ম-অনুধাবনের দিন।