বিশ্বায়িত ভুবনেও বঙ্গীয় আদর্শের জয়কেতন উড্ডীয়মান

বাঙালি শুধু একটা জাতি নয়, বাঙালি একটা চেতনা, একটা আবেগ। স্বাভিমান, আত্ম বলিদান, সহিষ্ণুতা শব্দগুলির সঙ্গে আজও বাঙালির সম্পৃক্তি। জাতীয়তাবাদ কথাটি উচ্চারিত হলেই আকাশ-বাতাসের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে প্রবাহিত হয় বাংলার ভাবধারা। সেই কথাটি মনে করিয়ে দিচ্ছেন অধ্যাপক ড. রূপক কর্মকার

Must read

যদি উড়ো মেঘে বেয়ে আসত ঠিকানা, যদি সোনালি আভা পথ দেখাত দূর স্বপ্নের দেশের! তাহলে হয়ত সেই ঠিকানা জুড়ে থাকত বাংলা ও বাঙালির জয়যাত্রা। পাতাবাহারির রঙে যদি রঙিন হতে পারতাম, সবুজ গাছের ছায়ায় যদি দিন কাটত, তবে কিন্তু মন্দ হত না সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত।
মাঝে মাঝে মনকে জিজ্ঞাসা করি ঠিকই, কোথায় গেলে শান্তি পাব, তৃপ্ত হবে মন প্রাণ। উওরগুলো তখন বড় বিচিত্র হয়। তার মধ্যে অবশ্য একটা উত্তর বেশ মন ছুঁয়ে যায়। উত্তরের যথার্থতা না থাকলেও তা অনেকটা এইরকম ডানা মেলে উড়ে যাওয়া ওই সাতরঙা জীবনের মাঝে, যেখানে নিঃসঙ্গতার কোনও মানে নেই, মানে নেই কোনও অস্থিরতার। যদি সেই পথের মাঝে কাঁটাতারও থাকত, আর সেই কাঁটাতারের বেড়া যদি সেই তৃপ্ততাগুলো ফিরিয়ে দিতে পারত, তবে শরীর ক্ষত-বিক্ষত হলেও একলাফে পৌঁছে যেতাম সেই অমলিন স্নিগ্ধতার দেশে, আমার মাতৃভূমিতে বাংলার ভূমিতে। চোখ বুজলে যেখানে সবুজ প্রকৃতি, নদ-নদী, মাঠ-ঘাট এবং সাধারণ মানুষের জীবন জীবন্তভাবে প্রকাশিত হয়, আমি সেই বাংলারই অংশ।

আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে পুলিশের হেনস্থা বাংলার তরুণীকে, তীব্র নিন্দা তৃণমূল কংগ্রেসের

বাঙালিদের কাছে বাংলা শুধু একটা ভৌগোলিক রূপ নয়, বাংলা যেন গভীর রূপ ও রসের একাত্ম বোধে মিলিয়ে থাকা এক অবচেতন মন। সেই বাংলার অনুভূতি থেকে বাঙালিদের আলাদা করা ততটাই অসাধ্য যতটা বোধ হয় প্রাণের সাথে আত্মার বিচ্ছেদ। বাঙালিদের দেশপ্রেম, স্বাধীনতায় অবদান এবং মাতৃভূমির প্রতি গভীর ভালবাসার যে ত্রয়ী তা জাতীয়তাবাদের মঞ্চকে সমৃদ্ধ করেছে বারংবার। জাতীয়তাবাদ কথাটি উচ্চারিত হলেই আকাশ-বাতাসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হয় বাংলার ভাবধারা।
আসলে বাঙালি শুধু একটা জাতি নয়, বাঙালি একটা চেতনা, একটা আবেগ, যা শত শত যুগ ধরে বয়ে আসছে সভ্যতার চোরা স্রোতে। বাঙালির দীর্ঘ চলার পথে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ বাঙালির জন্মভূমির স্বর্গীয় চেতনার এক রূপকে উন্মোচিত করেছে। বিমূর্ত জাতীয়তাবাদকে জননীর রূপ দিয়ে সহজ ও বোধগম্য করে তোলা হয়ত যে কোনও উপন্যাসের সবচেয়ে বেশি স্বার্থক রূপ। বাঙালি কী না পারে? শুধু লেখনীর মাধ্যমে দেশপ্রেমকে আধ্যাত্মিক পর্যায়ে উন্নীত করা, সর্বোপরি নিজ মুক্তি অর্জন নয়, সমষ্টির মুক্তি, এই ধারণা হয়ত বাঙালি চেতনারই সফল যাত্রার রূপ।
যে মঠে বন্দে মাতরম ধ্বনি বীজমন্ত্র হিসেবে উচ্চারিত হয়। সেই মঠ আনন্দের উৎস হবে সেটাই ভবিতব্য। স্বদেশি আন্দোলন শুধু একটা জাতির নয়, সমগ্র দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত এই বীজমন্ত্রের ওপর ভর করেই ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল। রাজনীতির প্রেক্ষাপটে আজও বাঙালির সৃষ্টি বন্দে মাতরম ধ্বনি শিহরন জাগায় শিরায় শিরায়। শুধুমাত্র কল্পিত চরিত্র শান্তি, কল্যাণী-দের উপর ভর করে এক নারী প্রজন্ম, যাদের মধ্যে অন্যতম প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, বীণা দাস, কল্পনা দত্তের মতো কত বিপ্লবী নারীরা স্বদেশি আন্দোলনের পুরো ভাগে নিজেদেরকে সঁপে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যথার্থই পর্যালোচনা ছিল ‘‘শ্রীকৃষ্ণের গীতা এবং বিবেকানন্দের রচনাবলি ছাড়াও তৃতীয় গ্রন্থ যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অপরিসীম ভূমিকা নিয়েছিল তা হল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’। একটা শতাব্দী ধরে বাঙালির যে যাত্রা তা শুধু ঐতিহ্যের নয় ইতিহাসের মাপকাঠিতে যেন এক যুগের সৃষ্টি করেছে। আমরা এখনও ব্রাহ্মণ, শুদ্র, উচ্চ, নিচ, হিন্দু, মুসলমান— কত না শব্দে নিজেদেরকে বিদ্ধ করি। প্রতিটা মুহূর্তে নিজেদের যাচাই করি কোনও এক জাতির পৃষ্ঠপোষক রূপে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে তাই স্বাভিমান, আত্ম বলিদান, সহিষ্ণুতা শব্দগুলির অর্থ হয়ত ঠুনকো কিন্তু এই শব্দগুলির মাহাত্ম্যতা বোঝার সৌভাগ্য যাঁদের হয়েছিল তাঁদের মধ্যে সিংহভাগই ছিলেন কিন্তু বাঙালিই।

আরও পড়ুন-গ্রামীণ এলাকায় ২১০টি ভ্রাম্যমাণ মেডিক্যাল ভ্যান

তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপলব্ধিতে ছিল ‘‘আনন্দমঠ জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের গীতা, যাকে অবশ্যই আমাদের পাঠ এবং বিশ্লেষণ করা উচিত।” দূরে কোনও এক নির্জনে যে মঠটি আনন্দধারা বহনে জাতীয়তাবাদের পীঠস্থানে পরিপূর্ণ ছিল, তার লেশ ধরে ‘গোরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছিল। এমনকী স্বামীজি ‘বর্তমান ভারত’-এ তাঁর লেখনীতে বুঝিয়েছিলেন বাঙালির রক্ত শুধু ঐতিহ্য বহন করে তা নয়, বরং জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ একাত্ম হতেও পারে। আসলে এই ভূ-ভারতে ভারতবর্ষকে যদি কেউ আলাদা ভাবে চিনিয়ে থাকে তা হল বাঙালির সুমধুর ভাষা, তার লেখনী এবং তার স্বাভিমান।
ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালির সুমধুর লেখনী ও চিত্রকলার মাধ্যমে নবচেতনার যে জাগরণ সারা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল তার রেশ ভোলাতে ইংরেজরা নানা ছলনার আশ্রয় নিয়েছিল ঠিকই, তবে তা খুব একটা কার্যকর হয়নি। বরং বিভাজনের যে তীরটা বাঙালির হৃদয়ে গেঁথেছিল, সেই জ্বালাতেই স্বাধীনতার পথ অনেকটাই প্রশস্ত হয়েছিল। প্রকৃতির অমলিন সৌন্দর্যে মিশে যাওয়া এবং সেই সৌন্দর্যকে উপভোগ করা তা যে কোনও চরিত্রের কাছেই কষ্টসাধ্য। আর এই বিশ্বায়নের যুগে নিজেকে নতুন করে চেনানো কঠিন থেকেও কঠিনতম। বাংলা ভাষায় বিশ্বায়ন কিংবা উপনিবেশের ছোঁয়া লাগলেও তার সুদৃঢ় অবস্থান যেন স্বকীয়তার অনন্য উদাহরণ। তুর্কি, পাঠান, মোঘল আমলে ফারসি ভাষার প্রভাব ছিল বিদ্যমান।
সেজন্য সেই সময়কালে অনেক সাহিত্য ফারসি ভাষায় স্থান করে নিয়েছিল। তাই ফারসি ভাষাকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষার স্বতন্ত্র স্থান পাওয়া বেশ কঠিন ছিল। তা সত্ত্বেও মানুষের চিন্তা, চেতনা, মননে বাংলাভাষা স্থান করে নিয়েছিল নিজস্ব ভঙ্গিমায়। সৃষ্টির কোনও কিছুই যে আজীবন থেকে যাবে তা যেমনটা নয়, তেমনি সৃষ্টিকে যদি বশে আনা যায়, তবে তা ইতিহাসের পাতায় সমৃদ্ধ হয়ে থাকে। বাঙালি এবং তাদের ভাষা সেই সমৃদ্ধ ইতিহাসকে বশে এনে নজির সৃষ্টি করেছে।

Latest article