সব্বাইকার বড়দিন

সে স্বাদ হল উৎসবময়তার অনন্য উদ্গীরণ। আর সেই সূত্রে মানবতার পূজন। এই উদ্গীরণেই এই পূজনেই খ্রিস্টমাস হয়ে ওঠে বড়দিন।

Must read

২৫ ডিসেম্বর, বড়দিন বা খ্রিস্টমাস। এই লগ্নের উৎসবপ্রাণতা কোনও বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠীর আবেষ্টনে আবদ্ধ নয়। এর সঙ্গে লগ্ন শীত-আসা প্রহরে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশের খুশি। সেই সঙ্গে মানবতাবোধের পুনর্জাগরণের সচেতন আহ্বান। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

আরও পড়ুন-ক্রিসমাসে মাতলেন রোনাল্ডো ও মেসি

খবরের কাগজের পাতায় ছবি। প্রতি বছরের মতোই। বড়দিনের প্রার্থনার গির্জায় গিয়ে যোগ দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।
জননেত্রী বিশ্বাস করেন, ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। এইরকম উপলব্ধি থেকেই বড়দিনে গির্জায়গমন, প্রার্থনায় অংশগ্রহণ, পার্কস্ট্রিটে অ্যালেন পার্কে আলোকোজ্জ্বল আয়োজন। সবমিলিয়ে নির্দিষ্ট ধর্ম পরিচয় থেকে বেরিয়ে এসে সবার জন্য, প্রাণে প্রাণে প্রাণোচ্ছলতার নির্মাণ যজ্ঞ।
এই গোটা বিষয়টার মধ্যে ভিন্নতর স্বাদ সুস্পষ্ট। সেটাই বড়দিনের আসল স্বাদ। এক্কেবারে লৌকিক স্বাদ।

আরও পড়ুন-এমপি কাপে ফের সফিকের হ্যাটট্রিক

সে স্বাদ হল উৎসবময়তার অনন্য উদ্গীরণ। আর সেই সূত্রে মানবতার পূজন। এই উদ্গীরণেই এই পূজনেই খ্রিস্টমাস হয়ে ওঠে বড়দিন। এমন এক উৎসব যা সর্বজনীন। কলকাতার দুর্গাপূজার মতো।
দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ভ্যালসন থাম্প। তিনি একটা কথা বলতেন। কথাটা একেবারে মনে গেঁথে যাওয়ার মতো।
ক্রিব, ক্যারল, কার্ড আর কেক, এগুলো হয়ত বিশ্বজনীন নয়। যে আস্তাবলে যিশু খ্রিস্টের আঁতুড়ঘর তৈরি হয়েছিল সেটির প্রতিমূর্তি দেখতে পাওয়া যায় গির্জায় গেলে কিংবা খ্রিস্টান মহল্লায় গেলে। তাও সেই মূর্তিতে জ্ঞানী পুরুষ ম্যাজাই, রাজা হেরোদ কিংবা সিজার অগস্তাসের হদিশ অনেক সময়েই মেলে না। এসব উধাও হয়ে যায়। কিন্তু খ্রিস্টমাস বিশ্বজনীন হিসেবেই রয়ে যায়।

আরও পড়ুন-’৮৩ দেখে মুগ্ধ বিরাট-অনুষ্কা

এই বিশ্লেষণের উপান্তে ভ্যালসন থাম্প একটা কথাই বলতেন। বলতেন তাঁর বিশ্বাস ভূমি থেকে। অন্তরের অন্দরমহল থেকে। সে কথাটি এরকম: Only what addresses the core human condition is universal. যা মানুষের মূলগত অবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত সেটাই বিশ্বজনীন, সেটুকুই সর্বজনীন।
অর্থাৎ, ক্রিব, ক্যারল, কার্ড, কেক, এসবে বড়দিনের সর্বজনীনতা নিহিত নয়। এই সর্বজনীন নিহিত কেবল সেই অংশে যেটি মানুষের জীবনভিত্তির সঙ্গে সম্পর্কিত।
লুকের সুসমাচারের সেই অংশে চোখ ফেরাই। যিশু খ্রিস্ট জন্ম নিলেন আস্তাবলে। কারণ, সরাইখানায় তাঁর জন্য কোনও জায়গা ছিল না। ‘No room for him in the inn’। এই কথাটিকে নেহাতই একটা বাক্যাংশ, বর্ণনাত্মক বাক্যের অংশ বিশেষ মাত্র, এমন ভাবলে ভুল হবে।
স্মর্তব্য, ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট, এই দুইয়ের মধ্যবর্তী উপত্যকায় যিশুর জন্মোৎসব বা খ্রিস্টমাসের প্রহরটি লগ্ন। ওল্ড টেস্টামেন্ট দেখায় আদম ও ইভের মাধ্যমে যে মানবতার সূচনা তা স্বর্গীয় বৈভব থেকে চ্যুত হল। ঢুকে পড়ল পাপ, কলুষতা, নানা ঘৃণ্য ক্রিয়াকলাপ। মানুষের মানবিকতার পতনের সময় সেখানে উদ্ভাসিত। এরপর, নিউ টেস্টমেন্ট। শুরু যিশুর আবির্ভাব দিয়ে। সেই আবির্ভাব কোনও পানশালার ছাদের নিরাপদ তলদেশে সংঘটিত হয়নি। কারণ, অধঃপতিত মানবতা সদ্যোজাত খ্রিস্টের ছাদ হতে পারে না। সে জন্যই ‘…no room for him in the inn’। এই গৃহহীনতা প্রতীকের তাৎপর্যে ভিন্নতর বার্তাবাহী। এই গৃহহারা দশা আদতে মুক্ত মানবের অবাধ বিস্তারে প্রতিবন্ধক যে দশা, তার বিরুদ্ধে অন্যরকম প্রতিবাদ।

আরও পড়ুন-নতুন বছরে নতুন পরিষেবা

রুশো লিখেছিলেন, জন্মকালে মানুষ মুক্তই থাকে, তারপর সর্বত্র সে আবদ্ধ হয় শিকলে। শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথ টের পেয়েছিল, সে ভয়ানকভাবে বদ্ধ দশার শিকার, ‘cabined, cribbed, confined’। একইরকম অনুভব ছুঁয়ে থেকেছে দস্তয়েভস্কির রাসকোলনিকভ এবং তলস্তয়ের নেখ লিউদোভকে। ভিক্টর হুগোর জ্যঁ বলজ্যঁ ও মনে করেছিল, দুনিয়াটা বর্ধিত কারাগার ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সব অনুভবেই ওই বাইবেলীয় গৃহহীনতার কথা, ছাদহারা হওয়ার সুরটা ঠিকঠাক ধরা পড়ে।

যিশু খ্রিস্টের জীবন ও কর্মে, প্রদত্ত শিক্ষায় ও প্রচারিত ধর্মে মানবতার এই নিরাশ্রয় দশটাই মুখ্য গুরুত্ব পেয়েছে বারংবার। এই আশ্রয়হীন বিপন্ন মানবতার জন্যই যিশুর সেই অমোঘ ও অমৃত উচ্চারণ, ‘Abide in me, and I in You.’ আমাকে বিশ্বাস কর, আমি বসত করি তোমাতে। পরস্পর পরস্পরের লগ্ন হয়ে বাঁচুক। বেঁধে বেঁধে, ঘেঁষে ঘেঁষে, মিলেমিশে থাকার মধ্যে নিশ্চিত আশ্রয় পাক মানবতা। এই কথাটাই যিশু অন্যত্র বলেছেন, অন্যভাবে। বলেছেন, প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো। Love Your neighbor like Yourself. মানুষ মানুষকে ভালোবাসবে। একে অপরের পরম নির্ভরতার, নিবিড় আশ্রয়ের জায়গা হয়ে উঠবে। তবেই তো মানবতা ছাদ খুঁজে পাবে। আস্থার ছাদ। আবেগের ছাদ। সমাজের ছাতা।

আরও পড়ুন-লোকায়ুক্ত গঠনে কাল বৈঠক

প্রাসাদবাসী মানুষ, অট্টালিকার অধিবাসী পরম প্রেমে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে নিরাশ্রয় নিরন্ন মানুষের দিকে, ঝুপড়ির বাসিন্দার দিকে। পরম প্রেমের সঙ্গে মিশে থাকবে প্রত্যয়ী প্রশ্রয়। তবেই আসবে বড়দিন। পালিত হবে খ্রিস্টমাস আপন গৌরব বিভায়।
জুডাস বিশ্বাসঘাতক। সেই বিশ্বাসঘাতকতা ব্যক্তি যিশুর সঙ্গে নয়। সঙ্গে চলা মানুষের সঙ্গে। সহযাত্রীর সঙ্গে। বন্ধুর সঙ্গে। সেই বিশ্বাসঘাতকতার ফল কী হল? ক্রুশবিদ্ধ হলেন খ্রিস্ট। তিনি তো আসলে মানবতার প্রতীক। বার বার তাঁর বিচার হয়েছে। প্রত্যেকবার, বিচারের সময়, তিনি স্পষ্ট উচ্চারণে জানিয়েছেন, তিনি নির্দোষ। কিন্তু বিপন্ন মানবতা শুদ্ধ নিখাদ মানবিকতার নির্দোষিতাকে গ্রহণ করতে, মান্যতা দিতে, স্বীকৃতি দিতে পারেনি। তাই, তাই-ই, বিচারান্তে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন যিশু। তাঁকে ক্রুশ বিদ্ধ করা হয়েছে। মানুষ মানুষের বিশ্বাস ভঙ্গ করলে মানবিকতাকে শাস্তি পেতে হয়। এটাই বাইবেলের শিক্ষা। ইতিহাসের শিক্ষা। বড়দিনেরও।

আরও পড়ুন-দিঘায় দশ বছরে রেকর্ড ভিড়

তাই, বাংলার জননেত্রী যখন বড়দিনের উৎসবঘন প্রহরে গির্জায় প্রার্থনা করেন, তখন তা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ে নিবিষ্ট পটচিত্র ছেড়ে মানবিকতার সর্বজনীন উচ্চারণের প্রসৃতি অর্জন করে। কারণ, যিনি ওই কাজটি করছেন তিনি প্রাণিত জনকল্যাণের নানা প্রকল্প-প্রবাহে মিশে থাকা মানববিকতার প্রগাঢ় প্রত্যয়ে।
বাংলার ধর্মনিরপেক্ষতা এভাবেই সর্বজনীন নিলীমায় অবাধ ডানা মেলার প্রহর খুঁজে পায়।

Latest article