ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ফরেনার্স (এক্সেম্পশন) অর্ডার, ২০২৫ জারি করেছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। বা ফরেনার্স অন্তর্ভুক্ত। বিদেশি নাগরিক সংশোধনী আইনের একটি নির্দেশিকা নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। যা রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে নতুন করে নাগরিকত্ব বিতর্ক এবং মতুয়া রাজনীতি উসকে দিল। এই নির্দেশিকাকে হাতিয়ার করে বঙ্গ-বিজেপির নেতারা মায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা পর্যন্ত দাবি করে বসলেন, নাগিরকত্ব পাওয়ার আবেদনের সময়সীমা ২০১৪-এর পরিবর্তে ২০২৪ অর্থাৎ ১০ বছর বাড়ানো হয়েছে। রাজ্য বিজেপি দাবি করে, নতুন আদেশের ফলে ২০১৪-২০২৪ পর্যন্ত যাঁরা ধর্মীয় উৎপীড়নের কারণে প্রতিবেশী দেশ থেকে ভারতে এসেছেন, তাঁরাও নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। রাজ্য বিজেপি মতুয়া সমাজকে সামনে রেখে এ-নিয়ে প্রচারের ঝড় তুললেও, তাঁদের সব দাবি নস্যাৎ করে দিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক জানিয়েছে, সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে (সিএএ) কোনও পরিবর্তন হয়নি। তাই সময়সীমা পরিবর্তনের কোনও প্রশ্নই নেই। তা ছাড়া, যে নির্দেশিকাটি দেওয়া হয়েছে তা বিদেশি নাগরিক সংশোধনী আইনকে কেন্দ্র করে। তার সঙ্গে নাগরিকত্ব আইনের সম্পর্কই নেই।
আরও পড়ুন-আজ মুখ্যমন্ত্রী যাচ্ছেন উত্তরে
গত সোমবার থেকে দেশে-বিদেশি নাগরিক সংশোধনী আইন কার্যকর হয়েছে। যার মূল প্রতিপাদ্য হল, বৈধ নথি ছাড়া ভারতে প্রবেশ করলে বা এ দেশে থাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই আইনে ছাড় পাবেন কারা? একটি নির্দেশিকায় বলা হয়, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, পার্সি, জৈন ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ যদি ধর্মীয় উৎপীড়নের ভয়ে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে ভারতে আশ্রয় নেন এবং তাঁদের কাছে যদি বৈধ নথি বা পাসপোর্ট না থাকে কিংবা বৈধ নথি বা পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তা হলেও তাঁরা ছাড় পাবেন। অর্থাৎ ভারতে থাকার বৈধ নথি না থাকলেও, ওই বিদেশিদের গ্রেফতার করতে পারবে না পুলিশ।
সমগ্র বিষয়টি এত সহজ নয়। এর মধ্যে আছে এক জটিল নির্বাচনী খেলা। রাজ্যের আসন্ন ভোটে মতুয়া ভোট যাতে বিজেপির থেকে সরে না যায়, সেই লক্ষ্যে ওই নির্দেশিকা জারি করা হল। বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের রক্ষাকবচের কৌশল নিল মোদির সরকার। ২০১৯ সালে ধর্মের ভিত্তিতে সিএএ আইন এনেছিল কেন্দ্র। ছ’বছর পরে ফের ধর্মকে সামনে রেখেই নির্দেশিকা জারি করল মোদি সরকার। আইনের পরিধির বাইরে রইলেন বেশ কিছু ধর্মীয় সম্প্রদায়। যাদের মধ্যে প্রধান হল মুসলিমরা।
এটা সংবিধান-বিরোধী।
এখানেই হল বিজেপির রাজনৈতিক খেলা। দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার ও শান্তনু ঠাকুর, নাগরিকত্বের সময়সীমা বাড়ল বাড়ল বলে বাজার মাত করলেন কেন? একই ট্যুইট করেন, বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র প্রদীপ ভাণ্ডারি। সমর্থন জানায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদও। তারপর ওনারা তাঁদের বক্তব্য প্রত্যাহার করেন। এরপর ওই নির্দেশিকাকে হাতিয়ার করে আবার সুকান্ত তাঁর পুরনো বক্তব্যেই ফিরে যান। সঙ্গে সঙ্গে নানা গোলমেলে কথাও বলতে শুরু করেন।
এর মানে দাঁড়াল, একদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য আবার সুকান্তরা যাতে বাংলায় ভোটের সুবিধা পায়, সেজন্য একটা নির্দেশিকা। এটা সম্পূর্ণ দ্বিচারিতা। এরই মধ্যে অপর একটি বক্তব্যে জানানো হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পর যাঁরা এদেশে এসেছেন, তাঁরা সিএএ-র মাধ্যমে নাগরিকত্ব না পেলেও প্রচলিত পুরনো আইনে নাগরিকত্ব পেতে পারেন। কারণ এই আইনে যে কেউ ভারতে টানা ১১ বছর বাস করলে, তিনি নাগরিক হওয়ার অধিকারী।
কথায় আছে, দুর্বৃত্তের ছলের অভাব হয় না। যা যা বলা হচ্ছে, তার জন্য যে পুনরায় আইন সংশোধনের প্রয়োজন আছে— তাও গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আর একটি প্রশ্নও সামনে আসছে। যখন দেশ জুড়ে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী তকমা দিয়ে, তাঁদের গ্রেফতার করা হচ্ছে, বাংলাদেশের সীমানায় নিয়ে গিয়ে ‘পুশব্যাক’ করা হচ্ছে, এমন সময়ে এই নয়া আইনটি কেন চালু করা হল? সেই সময়ই আবার সব রাজ্যে ডিটেনশন ক্যাম্প খোলার নির্দেশই বা দেওয়া হল কেন? খুব স্পষ্ট ভাষায় বলা যায়, ভােটার তালিকা সংশোধন, ভােট চুরি বা বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষীদের উপর আক্রমণ থেকে নজর ঘোরাতে অনেক বেশি রাতে গেজেট ‘বিজ্ঞপ্তি’ প্রকাশ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। এই আইনে নাগরিকত্ব মিলবে না। শুধু শরণার্থীর মর্যাদা পাওয়া যাবে। তারপর কী হবে? বোঝাই যাচ্ছে, একবার শরণার্থী হিসাবে নাম নথিভুক্ত হলে, তারপর ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’। তারপর ‘পুশব্যাক’ আবার বাংলাদেশেও ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’, ‘ডি’ ভোটার এবং ভোট দেওয়ার অধিকার হারিয়ে এই অসহায় মানুষগুলি রাষ্ট্রহীন, দেশহীন, অধিকারহীন অবস্থায় বাকি জীবন কাটাতে বাধ্য হবেন। কোনও সুসভ্য রাষ্ট্রে এই অমানবিক কাজ হতে পারে না। তাই, প্রতিবাদ ও গণপ্রতিরোধই একমাত্র পথ। আবার সম্প্রতি বলবৎ হওয়া অভিবাসন ও বিদেশি আইনে স্রেফ সন্দেহের বশে কাউকে গ্রেফতার করার অধিকার দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। পদমর্যাদায় তিনি হেড কনস্টেবল হলেই চলবে। ওই আইন কার্যকর হওয়ায় বিভিন্ন বিজেপি-শাসিত রাজ্যে কর্মরত বাঙালি মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা আরও বেড়ে যাবে। পুলিশের হাতে বাড়তি ক্ষমতা দেওয়াই চিন্তার বিষয়। বেশ কিছু কাল ধরে বিজেপি-শাসিত রাজ্যে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকদের বিদেশি সন্দেহে গ্রেফতর করা হচ্ছে। বৈধ কাগজ থাকলেও, তাঁদের বিদেশি বলে টাকা চাওয়া হচ্ছে। না পেলে বাংলাদেশ ‘পুশব্যাক’ করা হচ্ছে। এবার তো সেই বেআইনি ধরপাকড়কে আইনি রক্ষাকবচ দিয়ে দিল কেন্দ্র সরকার। সন্দেহের বশে যে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে। এর ফলে বাঙালি মুসলিম পরিযায়ীদের উপর পুলিশের জুলুম আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
আরও পড়ুন-আজ উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচন, গণতন্ত্র সুরক্ষার বার্তা বিরোধী জোটের প্রার্থীর
ধরপাকড় বাড়লে হিন্দু-মুসলিম, উভয় ধর্মের পরিযায়ী শ্রমিকেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ওদের সন্দেহ, মুসলিম অনুপ্রেবশকারীদের কারণে দেশের সীমান্তের জনবিন্যাস পাল্টানোর পাশাপাশি দেশবাসীর জীবিকায় টান পড়েছে। এই যুক্তি দেখিয়ে কোনও তথ্য ছাড়াই অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করতে তৎপর হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওদের দাবি, এই অনুপ্রেবশকারীদের প্রায় সকলেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের সমর্থক এবং ওই সমর্থন সরে গেলে রাজ্যে পালাবদল সম্ভব। তাই পরিকল্পনা করেই মুসলিম পরিযায়ী শ্রমিকদের নিশানা করা হচ্ছে। এর কোনও বাস্তব-ভিত্তিক তথ্য নেই। সবটাই হচ্ছে সন্দেহের বশে। পরোয়ানা ছাড়া এই গ্রেফতারের নির্দেশ এককথায় ফ্যাসিস্ট পদ্ধতি এবং সেই কারণেই আর একটা কালা কানুন জারি করা হল।