বুদ্ধিলোপের কারিগর

ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক লোপাট করছে স্মৃতিশক্তি। গ্রাস করছে বুদ্ধি, কিন্তু কীভাবে? আজ তারই বিশ্লেষণ করলেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রাস করছে স্মৃতিশক্তি
মাইক্রোপ্লাস্টিক, অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা যার বিচরণ প্রায় সর্বত্র, ধীরে ধীরে গ্রাস করছে মানুষের মস্তিষ্ককে, গিলে খাচ্ছে স্মৃতিশক্তি। এমনটাই দাবি ইউনিভার্সিটি অফ নিউ মেক্সিকো হেল্থের বিজ্ঞানীদের। তাঁদের দাবি, ২০১৬ সালে মানুষের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে যে পরিমাণ প্লাস্টিক কণা পাওয়া গিয়েছিল, ২০২৪ সালে তা-ই প্রায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ, যা রীতিমতো উদ্বেগের ব্যাপার। পাঁচ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট এই কণাগুলি সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা এমন এক ধরনের পরিবেশ দূষক যা সাগরের গভীরতম স্থান থেকে শুরু করে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। ‘নেচার মেডিসিন’ জার্নালে টক্সিকোলজিস্ট ম্যাথিউ ক্যাম্পেন জানিয়েছেন, এই গবেষণায় যাঁরা অংশগ্রহণ করেছিলেন তাঁদের বেশির ভাগেরই মস্তিষ্কে কম করেও ৭ গ্রাম করে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গিয়েছে। তাঁদের মধ্যে কারও ক্ষেত্রে পাওয়া গিয়েছে পেট প্লাস্টিক, যা দিয়ে তৈরি হয় জলের বোতল, কারও শরীরে মিলেছে পলিস্টেরাইন— যা থাকে খাবারের কন্টেনারে। আবার কিছু মানুষের মস্তিষ্কে পাওয়া গিয়েছে পলিইথাইলিন, যা দিয়ে তৈরি হয় প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ। এক-এক জনের মস্তিষ্কে আবার এই প্লাস্টিকের দু’-তিন রকমের কণাও পাওয়া গিয়েছে। ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত, এমন ১২ জন প্রাপ্তবয়স্কের মস্তিষ্ক পরীক্ষার মাধ্যমে জানা গিয়েছে যে, এইসব মানুষের মস্তিষ্কে জমে থাকা প্লাস্টিকের পরিমাণ স্বাভাবিক মানুষের মস্তিষ্কের থেকে প্রায় ১০ গুণ বেশি।

আরও পড়ুন-রাস্তায় প্রস্রাবের প্রতিবাদ করায় গুলি করে খুন ভারতীয় যুবককে

কীভাবে মস্তিষ্কে পৌঁছয়
মাইক্রোপ্লাস্টিক-সহ আরও ছোট ন্যানোপ্লাস্টিক আমাদের পরিবেশে সর্বত্র বিদ্যমান এবং বিভিন্ন পথে মানবদেহে প্রবেশ করতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে :
শ্বাসগ্রহণ (Inhalation) : বাতাসের মধ্যে থাকা মাইক্রোপ্লাস্টিকের কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করা। এটি প্লাস্টিকের মস্তিষ্কে পৌঁছানোর একটি প্রধান পথ বলে মনে হয়, সম্ভবত ঘ্রাণ-সংক্রান্ত বাল্বের (olfactory bulb) মাধ্যমে।
খাদ্য গ্রহণ (Ingestion) : দূষিত খাদ্য, জল এবং পানীয় গ্রহণ করা।
ত্বকের সংস্পর্শ (Dermal contact) : যদিও এটির মাধ্যমে মস্তিষ্কে প্লাস্টিক পৌঁছোনোর সম্ভাবনা কম, কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে যে ত্বকের সংস্পর্শ একটি এক্সপোজার রুট হতে পারে মাত্র। একবার শরীরে প্রবেশ করলে, এই ক্ষুদ্র কণাগুলি রক্তপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যেতে পারে। ছোট কণা, বিশেষ করে ন্যানোপ্লাস্টিক, ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ার (BBB) বা রক্ত মস্তিষ্ক ব্যবধায়ক অতিক্রম করতে সক্ষম। BBB হল একটি অত্যন্ত নির্বাচিত ঝিল্লি যা মস্তিষ্ককে রক্তের ক্ষতিকর পদার্থ থেকে রক্ষা করে। আকারে খুব ছোট হওয়ায় (এক মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট) ন্যানোপ্লাস্টিক-এর কণাগুলি BBB-কে আরও সহজে ভেদ করতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে প্লাস্টিকের কণাগুলি কোলেস্টেরলের মতো অণুগুলির আবরণ দ্বারা আবৃত হয়, যা তাদের BBB-এর মধ্য দিয়ে অলক্ষিতভাবে যেতে দেয়। BBB-এর অখণ্ডতাকে প্রভাবিত করে, মাইক্রোপ্লাস্টিকের দীর্ঘস্থায়ী সংস্পর্শ। এটি BBB-কে দুর্বল করে দেয় ও এর ভেদ্যতা বৃদ্ধি করে। ফলে সমস্তরকম ক্ষতিকর পদার্থকে এরা মস্তিষ্কে প্রবেশ করতে দেয়।

আরও পড়ুন-ক্ষুব্ধ পুজোর উদ্যোক্তারা মানবেন না দিল্লির গেরুয়া মুখ্যমন্ত্রীর আজব ফতোয়া

মস্তিষ্কের ক্ষতির সম্ভাব্য প্রক্রিয়া
একবার মাইক্রোপ্লাস্টিক মস্তিষ্কে জমা হলে, তারা বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মস্তিষ্কে ক্ষতিসাধন করে। মস্তিষ্কের ইমিউন কোষ, যাকে মাইক্রোগ্লিয়া বলা হয়, তাদের দ্বারা মাইক্রোপ্লাস্টিক ধংস করা যেতে পারে। তবে এই ঘটনা ঘটানোর জন্য এই কোষগুলি অত্যধিক সক্রিয়তা দেখায়। যা ফলে মস্তিষ্কে প্রদাহজনক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ফলে নিউরোন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবার অনেকসময় মাইক্রোপ্লাস্টিক ভেঙে আরও ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হওয়ার পরেও মস্তিষ্কের ক্ষুদ্র রক্তবাহগুলিতে আটকে যেতে পারে, যা রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এর ফলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন এবং পুষ্টির অভাব (ইস্কেমিয়া) দেখা যায় এবং স্ট্রোকের মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। আবার এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাগুলি গুরুত্বপূর্ণ মস্তিষ্কের কাঠামোতে আঘাত করতে পারে এবং তার ক্ষতি করতে পারে, যেমন— মায়েলিন শিদ (যা নিউরোনকে আবৃত করে রাখে) এবং মাইক্রোটিউবিউল্স (যা স্নায়ু কোষের গঠন এবং কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য)। যার ফলে নিউরোন বা স্নায়ুকোষের গঠন বিনষ্ট হয় যা সামগ্রিকভাবে মস্তিষ্কের সমস্ত কার্যকারিতাকে বিঘ্নিত করে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক নিউরোডিজেনারেটিভ রোগের সাথে যুক্ত প্রোটিনগুলির একত্রিতকরণের জন্য একটি ‘বীজ’ হিসেবে কাজ করে, যেমন অ্যামাইলয়েড-বিটা (যা আলঝাইমার রোগের সাথে যুক্ত) এবং আলফা-সিনুক্লেইন (যা পারকিনসন রোগের সাথে যুক্ত) একত্রকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক অতিসক্রিয় অক্সিজেন (ROS)-এর উৎপাদন বাড়িয়ে মস্তিষ্কে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়াতে সাহায্য করে, যা ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের কোষগুলিকে নষ্ট করতে থাকে ফলে নিউরোডিজেনারেশন দেখা যায়। কিছু গবেষণায় আবার বলা হয়েছে যে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিউরোট্রান্সমিটারগুলির ভারসাম্যকে ব্যাহত করতে পারে, যেমন ডোপামিন এবং অ্যাসিটাইলকোলিন-এর ভারসাম্য এরা বিঘ্নিত করে, যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নিউরোট্রান্সমিটার। বলা বাহুল্য ডোপামিন কিন্তু স্মৃতিসংরক্ষণ তথা নতুন স্মৃতি গঠনের জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় নিউরোট্রান্সমিটার।

আরও পড়ুন-আবার জারি হল কালো আইন

গবেষণার ফলাফল এবং উদ্বেগ
একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানব মস্তিষ্কের টিস্যুতে অন্যান্য অঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে উপস্থিত। গবেষণায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে এই পরিমাণ সময়ের সাথে ক্রমশ বাড়ছে। গবেষণায় মস্তিষ্কে উচ্চমাত্রার মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ডিমেনশিয়ার মতো অবস্থার মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক পাওয়া গেছে। তবে প্লাস্টিক রোগটি ঘটায় নাকি রোগের প্রক্রিয়া মস্তিষ্ককে প্লাস্টিক জমার জন্য আরও সংবেদনশীল করে তোলে তা এখনও স্পষ্ট নয়। সাধারণত প্রাণীদের ওপর গবেষণায় দেখা গেছে যে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে স্মৃতিশক্তির হ্রাস ঘটে, movement কমে যায় এবং দুর্বল motor coordination-সহ একাধিক আচরণগত এবং বুদ্ধির সমস্যা দেখা যায়।
মস্তিষ্কের বিকাশেও এর গভীর প্রভাব থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়ে থাকে, যার ফলে মাইক্রোপ্লাস্টিকের সংস্পর্শে বুদ্ধির বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং আচরণের ওপরও এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
বর্তমানে প্লাস্টিকের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার ও মানুষের প্লাস্টিক দ্রব্যের প্রতি নির্ভরশীলতা যে মানব মস্তিষ্ককে ধীরে ধীরে গিলে খাচ্ছে তা আমরা বুঝতেও পারছি না, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব যে মানুষের স্মৃতিশক্তিকে গ্রাস করার পাশাপাশি মানুষের বুদ্ধিমত্তাকেও প্রভাবিত করবে তার অশনিসংকেত কিন্তু বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই দেখতে শুরু করেছেন। যার ফলে আমাদের বুদ্ধাঙ্ক ধীরে ধীরে লোপ পাবে আর তার সাথে লোপ পাবে আমাদের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হওয়ার গর্ব।

Latest article