দেবীপক্ষেই খেলা হবে

ভোটবাক্স দখলের অছিলায় মাত্র বারো হাজার টাকায় বাঙালির ভক্তিকে কিনতে গিয়ে দেবী দুর্গার সঙ্গে একই বেদিতে আসীন হওয়ার পরিকল্পনা করে প্রধানমন্ত্রী আদতে অপমান করলেন রামচন্দ্রের উপাস্য দেবীকেই। লিখছেন চিরঞ্জিৎ সাহা

Must read

‘কী মজা, কী মজা, রাজা খায় ব্যাঙ ভাজা!’— বিখ্যাত বাঙালি লেখক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বহুচর্চিত শিশুতোষ গল্প ‘টুনটুনি ও রাজার কথা’-র জনপ্রিয় বাক্যটি আবারও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সাম্প্রতিক রাজনীতিতে। সৌজন্যে, ভারতবর্ষের বর্তমান মহারাজা। বাঙালি নামক ‘টুনটুনি’-র মন ধরতে গিয়ে উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের সেই রাজার মতোই নিত্য নাস্তানাবুদ এক হতোদ্যম প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। মাতৃভাষায় কথা বলার অপরাধে রাজ্যে-রাজ্যে নির্বিচারে বাঙালি মেরে বঙ্গপ্রীতির গাজর ঝুলিয়ে বাঙালিকে খাঁচাবন্দি করার দুর্বল অভিনয়ে আর ভুলছে না বাংলার মানুষ। উল্টে টুনটুনির মতো করেই মোদির মুখে গুঁজে দিচ্ছে প্রত্যাখ্যানের ব্যাঙভাজা। রামায়ণের শূর্পণখার বিভিন্ন ভেক ধরে ছলে-বলে-কৌশলে রামচন্দ্রকে প্রলুব্ধ হতে প্ররোচিত করার পন্থাকে অনুসরণ করে যতবারই নরেন্দ্র মোদি বাঙালির মন জেতার লোভনীয় টোপ ফেলেছেন, ততবারই কাটা গিয়েছে তাঁর নাক। রামচন্দ্রের ছদ্ম-উপাসক সাক্ষাৎ যেন শূর্পণখার পুরুষোচিত আধুনিক সংস্করণ। ২০২১, ২০২৪-এর পর দোরগোড়ায় হাজির ২০২৬। কুম্ভীরাশ্রু নিয়ে দরজায় কড়া নাড়তে থাকা বাঙালিপ্রীতির মুখোশধারী মোদির অপেক্ষায় তরবারি হাতে গোটা বাংলার মানুষ। লক্ষ্মণের মতো করে যোগ্য জবাব দিতে হবে যে— “নাককাটা মোদি রে, হারালি তোর গদি রে।”

আরও পড়ুন-আজব! যোগীরাজ্যে অনলাইন ভিডিয়ো দেখে নিজেই লিঙ্গ পরিবর্তনের অস্ত্রোপচার যুবকের

কোভিড-পরবর্তী ২০২১ সালে পরিযায়ী শ্রমিকের লাশের ওপর দিয়ে বাংলায় ডেলি প্যাসেঞ্জারি শুরু গুজরাতি মহারাজার। বাঙালিকে আবেগের সুড়সুড়ি দিয়ে তার মননকে জিতে নিতে সাদা দাড়িতে নিজেকে সাজিয়ে তুলেছিলেন বঙ্গহৃদয়ের ধ্রুবতারা রবীন্দ্রনাথের আদলে। কবিগুরুকে শিখণ্ডি করে বিকৃত বাংলা উচ্চারণে পশ্চিমবঙ্গের ভোটবাক্স দখলের অশুভ অভিপ্রায়কে বাঙালি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিল আত্মঅস্মিতায় আঘাত হিসাবে। অতিসহিষ্ণু ঘাসফুলের দৃপ্ত নমনীয়তার কাছে মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়েছিল ‘পোঁদে ছাপের’ ঔদ্ধত্য। ‘চোলায় চোলায় মোদির বাজানো জয়ের ভেড়ি’-তে ২০২১ ও পরবর্তীতে ২০২৪ সালে ধ্বনিত হয়েছিল— “জনগণের গর্জন, বঙ্গবিরোধীদের বিসর্জন।” হাড়ে হাড়ে বিজেপি টের পেয়েছিল— “বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি।” হায়নার হাসি কিংবা কুমিরের কান্না দিয়ে বাঙালিকে জয় করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতেই সাম্প্রতিককালে ঘোমটা খুলেই গোয়েবলীয় মডেলে খেমটা নাচ শুরু বিজেপির। ভয় দেখিয়ে ভক্তি আদায়ের হিটলারোচিত কৌশল। ওড়িশায় পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দকুমারের শীতলপুর গ্রামের পরিযায়ী শ্রমিক মুস্তাফা আলি থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে নদিয়ার তেহট্টের বাসিন্দা রাজু তালুকদারকে কুপিয়ে খুন কিংবা মহারাষ্ট্র থেকে ফেরার অব্যবহিত পরেই পরিযায়ী শ্রমিক গোলাম মণ্ডলের অস্বাভাবিক মৃত্যু— গেরুয়া সহমর্মিতা হঠাৎ পরিবর্তিত প্রতিশোধমূলক সহিংসতায়। কিন্তু বাঙালি যে জিওল মাছের জাত— “যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ।” মিথ্যের মস্তানি আর জুমলার জুলুমবাজির কাছে মাথা নোয়ানো বাঙালির ধাতে নেই। এই বাংলার প্রতিটি মনের মণিকোঠার মধ্যমণি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তাই গর্জে উঠেছে বাঙালি। স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বাধিক সংখ্যক আত্মবলিদানের নজির রাখা জাতি বিশ্ববন্দিত এক অগ্নিকন্যার অনুপ্রেরণায় আবারও নিজেদের ঐক্যবদ্ধতার প্রমাণ দিচ্ছে বাঙালিয়ানা রক্ষার তাগিদে। আর তাতেই ভোলবদল বিজেপির। নতুন ছলে বাঙালিকে বোকা বানানোর সাবধানী তাস। কিন্তু ওই যে, রাখে দুর্গা, মারে কে! বজ্র আঁটুনি, ফসকা গেরো। আবারও ফাঁস হয়ে গেল মোদির ঘৃণ্য চক্রান্ত। বাঙালির আরাধ্যা দেবী দুর্গাকে বোড়ে বানিয়ে এই বাংলার দাবার বোর্ডে নিজের রাজত্ব কায়েম করতে চেয়েছিলেন মহারাজ। কিন্তু সে গুড়ে বালি! সম্প্রতি দিল্লি পুলিশ বাংলাদেশি সন্দেহে ৮ জন বাঙালিকে আটক করে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি বাজেয়াপ্ত করে। সবই লেখা বাংলা ভাষায়। আর সেই সব নথির তথ্য যাচাইয়ের জন্য একজন অনুবাদকের খোঁজে বঙ্গভবনে চিঠি দেয় দিল্লি পুলিশ। সেই চিঠিতেই বাংলা ভাষাকে ‘বাংলাদেশি’ ভাষার তকমা দেওয়া হয়। ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই তৈরি হয় বিতর্ক। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়ে দিল্লি পুলিশ। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত সভায় গত ৬ সেপ্টেম্বর শতাধিক পুজো কমিটি ও রামলীলা আয়োজকদের সঙ্গে বৈঠক করে ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টা করেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী রেখা গুপ্ত। আসলে ছাব্বিশের বিধানসভা ভোট বড় বালাই! তাই প্রবাসী বাঙালির মন রাখতে দুর্গাপুজোর বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য জমা টাকার পরিমাণ ৪০ হাজার থেকে এক ধাক্কায় নামিয়ে আনেন ১০ হাজারে। ১২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুতের বিল মকুবের আশ্বাসও দেন। কিন্তু এরপরই ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়ে লুকিয়ে থাকা ‘জুমলা’ বিড়াল। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী বলে ফেলেন— “১৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিন। সেদিন থেকে ২ অক্টোবর পর্যন্ত আমরা সেবাপক্ষ চালাব। এই সময় দিল্লি জুড়ে চলবে নানারকম সেবামূলক কাজ। আমি চাই আপনারাও পুজোর দিনগুলোয় কোনও না কোনও সেবামূলক কাজ করুন। প্রত্যেকটি মণ্ডপে মায়ের মূর্তির পায়ের কাছে প্রধানমন্ত্রীর ছবি রাখুন। এতে মায়ের আশীর্বাদ পেয়ে তিনি দীর্ঘায়ু এবং সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারেন।” দেবী দুর্গাকে পণ্য বানিয়ে চৈত্র সেলের দরে বাঙালিকে কিনতে চাওয়া মোদির নাক কাটা যাওয়া এখন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ১,২০০ ইউনিট বিনামূল্যের বিদ্যুৎ অর্থাৎ মাত্র ১২,০০০ টাকায় বাঙালির গর্ব এবং বিশ্বাস কিনতে চাওয়া বিজেপির নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর ক্রাচে ভর দিয়ে চলা সরকারের এটাই না মায়ের আশীর্বাদে শেষ দশমী হয়ে যায়!

আরও পড়ুন-ফুলওয়ারিশরিফ ফৌজদারি ষড়যন্ত্র মামলায় NIA-র বড় পদক্ষেপ, গ্রেফতার বিহারের PIF প্রধান

রাবণ বধের প্রাক্কালে যুদ্ধে দেবী দুর্গার আশীর্বাদ প্রার্থনা করে শরৎকালে অকাল বোধন করেছিলেন অযোধ্যাপতি শ্রীরামচন্দ্র। ভোটবাক্স দখলের অছিলায় মাত্র বারো হাজার টাকায় বাঙালির ভক্তিকে কিনতে গিয়ে দেবী দুর্গার সাথে একই বেদিতে আসীন হওয়ার পরিকল্পনা করে প্রধানমন্ত্রী আদতে অপমান করলেন রামচন্দ্রের উপাস্য দেবীকেই। প্রকাশ্যে চলে এল বিজেপির দর্শনে রামচন্দ্রের প্রকৃত মর্যাদা। অপরদিকে, বাংলার ৪০ হাজার পুজো কমিটিকে ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা অকুণ্ঠ আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলির পাশাপাশি পুজো কমিটিগুলিকে বিদ্যুতের বিলে ৮০ শতাংশ ছাড় দেওয়ার কথা এই বাংলার ঘরের মেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেও মণ্ডপে নিজের ছবি ব্যবহার করে পূজিত হওয়ার তুঘলকি বাসনা তিনি প্রকাশ করেননি। পরিবর্তে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে আমবাংলার প্রান্তিক মানুষের অর্থনীতির চাকাতে খানিক ত্বরণ আনতে পরিকল্পনা করে চলেছেন দিনরাত। মর্ত্যলোকে শান্তি আনতে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রামচন্দ্রকে আশীর্বাদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন মা দুর্গা। একই পথে শিশির ভেজা ঘাসফুলে এই শরতেই হয়তো পুণ্য মহাষ্টমীতে জন্ম নেওয়া মা দুর্গার আশীর্বাদধন্য সর্বত্যাগী এক উপাসিকার হাত ধরে দেবীপক্ষে ঘোষিত হবে এ যুগের মহিষাসুরের রাজনৈতিক মহাপ্রয়াণে এক সংগ্রামী নারীশক্তির ভারতবর্ষব্যাপী সার্বিক উত্থান— “নাককাটা মোদি রে, হারাবি তোর গদি রে।”

Latest article