৫০০ বছর আগেকার জলপাইগুড়ি। স্থানীয় রাজাদের উপাধি তখন রায়কত। বংশানুক্রমে যোদ্ধা এই রায়কতরা। আদতে কোচবিহারের রাজবংশের শাখা। সেই বংশের দুই ছেলে বিশ্ব, ওরফে বিশু, আর শিষ্য, ওরফে শিশু, খেলার ছলে মাটির দলা থেকে প্রতিমা বানিয়ে সেই প্রতিমাকে পুজো (durga puja) করেছিল দেবী দুর্গা রূপে। রায়কতদের দুর্গা পুজোর সেই শুরু।
আগে রায়কতদের রাজ্যটির নাম ছিল বৈকুণ্ঠপুর। রাজধানী ছিল শিলিগুড়ির কাছে, করতোয়া নদীর ধারে। পরবর্তীকালে রাজা ধর্মদেব রাজধানী সরিয়ে আনেন রায়কত পাড়ায়। করলা নদীর তীরে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনিই দুর্গা পুজো করে স্থাপন করেছিলেন দুর্গ। আর সেই দুর্গের ভেতরেই ছিল রাজবাড়ি।
রায়কত পাড়ার রাজবাড়ির দুর্গা পুজোয় আগে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল। এখনও সেই রেওয়াজ মেনে পিটুলির তৈরি মানুষ-পুতুল বলি দেওয়া হয়। শোনা যায়, নবমীর পুজোতে এখানে আজও অন্যতম উপচার নররক্ত। যিনি স্বেচ্ছায় বুক চিরে রক্ত দেন, রাজবাড়ি থেকে তাঁকে নাকি অর্থ দেওয়া হয়।
রায়কত পাড়ার দুর্গা পুজো আজও হয় ঘোর শাক্ত মতে। বদল এসেছে বিভিন্ন রীতি রেওয়াজে। তবে দেবী আজও আগেকার মতোই রক্তবর্ণা। তাঁর উচ্চতা অবশ্য কমেছে অনেকটাই। বর্তমানে যে মূর্তি পুজো করা হয়, সেটির উচ্চতা বড়জোর দশ ফুট। আগে দেবীর বাহন ছিল বাঘ। বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলে তখন সাদা বাঘের দেখা মিলত। এখন মেলে না। তাই, এখন দেবী সিংহবাহিনী। আগে দুর্গা একাই পূজিতা হতেন। সঙ্গে কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী থাকতেন না। এখন তাঁরাও থাকেন। সপরিবারে দুর্গার এই পূজিত হওয়ার প্রচলন গত শতকের প্রথম পাদে।
লোকে বলে, কোচবিহার রাজবংশের যে দুই ছেলে মাটির দুর্গা গড়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে বিশ্ব সিংহ কোচবিহারের রাজা হন। আর শিষ্য সিংহ চলে আসেন বৈকুণ্ঠপুরে। রাজা হয়েও তাঁরা দুর্গাপুজো বন্ধ করেননি। বরং, আরও ধুমধাম করে সেই পুজোর ব্যবস্থা করেন। দেবীর আশীর্বাদেই যে তাঁদের সিংহাসন প্রাপ্তি! পুজো তাই এক অর্থে কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।
এরকম অজস্র প্রাচীন দুর্গা পুজো অনুষ্ঠিত হয় বাংলার নানা প্রান্তে। যেমন মহিষাদলের রায়বাড়ির দুর্গা পুজো।
প্রায় ৪৫০ বছর বয়স হয়ে গেল এই পুজোর। আগে দেবী পূজিতা হতেন ঘটে, এখন হন মাটির মূর্তিতে। ঘটে পুজোর রীতি ভাঙেন ধীরেন্দ্রনাথ রায়। এখন তাঁর পৌত্রেরা পুজোর দায়িত্বে।
তাম্রলিপ্তের বঁইচবাড়ির রাজা নারায়ণ রায়বাহাদুর চলে এসেছিলেন হলদিয়ার সন্নিকটে, মহিষাদলে। উদ্দেশ্য ছিল জমিদারির তদারকি। তখন থেকেই তাঁরা চালু করেন ঘটে দুর্গা পুজোর রীতি। কয়েকশো বছর ধরে সেই রীতিই পালন করা হয় নিষ্ঠাভরে। তার পর সূচনা মূর্তি পূজার। বাসুলিয়ার রায়বাড়ির সেই পুজোয় আজও উপস্থিত হন তেরপেখ্যা, কেশবপুর, বাঁকা রঙ্গিবসান, গোপালপুর, কমলপুর, গাজিপুর-সহ আশপাশের গাঁয়ের মানুষজন।
অষ্টমীর দিন এখানে বলি দেওয়া হয়। তবে কোনও জীবন্ত পশু-প্রাণীকে নয়। এই পুজোর রীতি মেনে বলি দেওয়া হয় কলা, আখ, কুমড়ো আর লেবু। নবমীর দিন কুমারী পুজোর আয়োজন হয়। নামে মানুষের ঢল। বাহারি আলোয় সেজে ওঠে রাজবাড়ির ঠাকুর দালান।
আরও পড়ুন-অসমের গুয়াহাটিতে ৫.৮ মাত্রার ভূমিকম্প, উত্তরবঙ্গেও অনুভূত কম্পন
আগে ভোগ প্রসাদ সংগ্রহ করতে আসতেন কম পক্ষে ২০ হাজার মানুষ। এখন আর সেদিন নেই। তবুও অন্তত দেড়-দু’হাজার মানুষ আজও নবমীর দিন এখানে অন্নভোগ পান।
প্রবাসী আত্মীয়স্বজনেরা আসেন বাড়ির পুজোয় যোগ দিতে। আশপাশের গ্রামবাসীদের সঙ্গে মিলেমিশে তাঁরা অংশ নেন এক মহামিলন উৎসবের। রায়বাড়ির পুজোর এটাই বিশেষত্ব। বিশ্বায়নের আবহে ভাঙাচোরা প্রতিবেশেও সর্বার্থে সর্বজনীন হয়ে ওঠে এই পুজো।
আর একটি সুপ্রাচীন পুজো বর্ধমানের আউশগ্রাম থানার অন্তর্গত গুসকরার জমিদারদের পুজো। চোংদার বাড়ির পুজো নামে বিখ্যাত। হাজার বছর আগে অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে আউশগ্রামে এসেছিলেন চোংদাররা। আসলে তাঁরা কাশ্যপ গোত্রীয় ব্রাহ্মণ, কুলীন, পদবি চট্টোপাধ্যায়। রাজার সেনাপতি হিসেবে এই চোংদার উপাধি পেয়েছিলেন এই পরিবারের এক পূর্বপুরুষ।
সেই চোংদার বংশের চতুর্ভুজ আর তাঁর স্ত্রী বিদ্যাধরী মিলে গুসকরায় শুরু করেছিলেন দুর্গা পুজো। প্রায় ৪০০ বছর আগেকার কথা সেসব। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে, কিন্তু চোংদারদের দুর্গাপুজো আজও অব্যাহত। জৌলুস কমলেও ঐতিহ্য হারায়নি সেই পুজো।
একচালার প্রতিমা। সপরিবারে দেবী দুর্গা। দেবীর মাথায় মুকুট। লক্ষ্মীর মাথাতেও। কিন্তু মুকুট নেই সরস্বতীর মাথায়। পুজো হয় শাক্তমতে। একদা নবমীতে ১৩টি ছাগল আর একটি মহিষ বলির প্রথা ছিল। সেসব রক্তারক্তি কাণ্ড অতীত এখন।
পশুবলি বন্ধ হয়েছে ১৯৭৮-এ, যেবার প্রবল বানের জলে প্রচুর গোরু-মোষ-ছাগল ভেসে গিয়েছিল।
বরং এখনও রয়ে গিয়েছে এক বিশেষ প্রথা। দশমীর দিন পুজোর আচার-অনুষ্ঠান শেষ হলে এখানে হয় এক বিশেষ শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। চতুর্ভুজ চোংদারের স্মরণে শ্রাদ্ধ-অনুষ্ঠান। একবার দশমীর নরম আলো-মাখা বিকেলে বিষ মেশানো দুধ খেয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন চতুর্ভুজ আর বিদ্যাধরী। তাঁদের ইচ্ছানুসারে দুজনের শবদেহ সমাধিস্থ করা হয় পুজো মণ্ডপেই। এই দুর্গাপুজো যে চতুর্ভুজ-বিদ্যাধরীর প্রাণ ছিল! তাই মরণোত্তর পর্বেও সেই পুজোতে জড়িয়ে থাকার চেষ্টা।
আজও রয়ে গিয়েছে সেই সমাধিস্থল। এখন সেখানে দেবী পুজোর হোম হয়। একটা সময় ছিল যখন চোংদার দম্পতির শ্রাদ্ধানুষ্ঠান শেষে পঙক্তিভোজের ব্যবস্থা হত। বিশাল আয়োজন। এখন ফি-বছর শ্রাদ্ধের সেই বিরাট ভোজও অতীত।
এখন যে ঠাকুরদালানে পুজো (durga puja) হয়, সেটার ভগ্নপ্রায় দশা। শেষবার সংস্কার হয়েছিল প্রায় ১৩৪ বছর আগে, ১২৯৮ বঙ্গাব্দে।
পুজোর জৌলুস অনেকটা কমলেও ঐতিহ্য অটুট। এখনও তাই দেবীকে নিবেদন করা হয় ৫১ রকম ভোগ, সেগুলি সাজিয়ে দেওয়া হয় ৫১টি থালায়।
এরকম বহু পুজো (durga puja) আর তাদের ম্যাজিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এই বাংলায়।