সবে মিলি করি কাজ

মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত নেবার এক জৈবিক গণতন্ত্র। এক গোপন সুসংবদ্ধ শৃঙ্খলা। লিখলেন দীপ্র ভট্টাচার্য

Must read

প্রতিদিন আমরা কতগুলো সিদ্ধান্ত নিই, তা কি কখনও ভেবে দেখেছি? কখন ঘুম থেকে উঠব, কী খাব, কোন পথ দিয়ে অফিস যাব— সবকিছুই যেন চলতে থাকে এক অন্তর্নিহিত নির্দেশে। কিন্তু সেই ‘নির্দেশ’ কে দেয়? মস্তিষ্ক? কিন্তু মস্তিষ্ক তো একটিই, তাহলে সেই নির্দেশ কি আসে কোনও ‘নেতা’-নিউরনের কাছ থেকে? নাকি পুরো মস্তিষ্ক জুড়েই চলে এক ধরনের জৈবিক গণতন্ত্র?
সাম্প্রতিক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা এর উত্তর দিয়েছেন। দেখতে একমুঠো জটিল কোষের গুচ্ছ, কিন্তু কাজ চলে নিখুঁত সমন্বয়ে। একটি সাধারণ ইঁদুরের মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেলেন জটিলতর সত্য— আমাদের মস্তিষ্কে সিদ্ধান্ত গঠনের পদ্ধতি অনেকটাই এক প্রকার অ্যানিম্যাল লার্নিং অ্যালগরিদম, যেখানে শেখা হয় অভিজ্ঞতা থেকে, বিশ্লেষণ চলে নিউরনের সম্মিলিত পরিশ্রমে এবং সিদ্ধান্ত আসে কোনও একক নেতার আদেশে নয় বরং সম্মতিসূচক কার্যক্রমে।

আরও পড়ুন-পিজির ‘অনন্য’র উদ্বোধনে মুখ্যমন্ত্রী

প্রাণীর মস্তিষ্কে লুকানো অ্যালগরিদম
আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI অনেকটাই নির্ভর করে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমের উপর। বারবার চেষ্টা, ভুল ও সংশোধনের মাধ্যমে মেশিন শেখে— ডেটা থেকে। আশ্চর্যভাবে, প্রকৃতির সৃষ্টি হওয়া প্রাণীরাও ঠিক একই পদ্ধতিতে শেখে। সেটি প্রোগ্রাম করা হয় না, জন্মগতভাবেই গড়ে ওঠে তাদের নিউরাল নেটওয়ার্কের ভিতর। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, একটি ইঁদুর একটি নির্দিষ্ট কাজ— যেমন স্ক্রিনের বলটিকে মাঝখানে আনা যখন বহুবার করে, তখন সে কেবল দৃষ্টিশক্তির ওপর নির্ভর করে না, বরং, আগে কী ঘটেছে, কতবার কী খাবার পুরস্কার পেয়েছে— এই অভিজ্ঞতাগুলো তাকে শেখাচ্ছে কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটিই অ্যানিম্যাল লার্নিং অ্যালগরিদম— যেখানে শেখার মাধ্যম হল অভিজ্ঞতা এবং সিদ্ধান্ত আসে সেই অভিজ্ঞতার ‘স্মৃতি’ থেকে। এটি অনেকটাই মানুষের শেখা ও বিচারক্ষমতার প্রাথমিক স্তর।
গণতান্ত্রিক এক স্নায়ুসমাজ
প্রচলিত ধারণায় আমরা মনে করি, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোনও অংশ— যেমন প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স— নেতৃত্ব দেয়। কিন্তু নতুন গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা। ইঁদুরের মস্তিষ্কে ‘নিউরোপিক্সেল’ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোনও একক অঞ্চল নয়, বরং বহু নিউরন একযোগে কাজ করে সিদ্ধান্ত তৈরি করে। ইঁদুরের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যে চাকা ঘোরানোর মুহূর্তে সবচেয়ে প্রথমে সক্রিয় হয় মস্তিষ্কের পেছনের অংশ, যেখানে ভিস্যুয়াল তথ্য বিশ্লেষিত হয়। তারপর একে একে যুক্ত হতে থাকে অন্যান্য অঞ্চল। কেউ বিশ্লেষণ করছে, কেউ তুলনা করছে, কেউ অভিজ্ঞতার স্মৃতি খুঁজে আনছে। এ যেন একটি সহযোগিতামূলক বুদ্ধিবৃত্তিক সম্মেলন, যেখানে সবাই নিজস্ব ভূমিকা পালন করে, কিন্তু কেউ নেতা নয়। এভাবেই মস্তিষ্কে চলে নেতৃত্বহীন সহযোগিতামূলক প্রক্রিয়া।
অভিজ্ঞতাই হল অদৃশ্য গাইড
গবেষণার সবচেয়ে চমকপ্রদ মুহূর্ত আসে তখন, যখন স্ক্রিনে থাকা বলটি হঠাৎ করে মুছে দেওয়া হয়। বল দেখা যাচ্ছে না, তবু ইঁদুর সেই চাকা ঘুরিয়ে ঠিকঠাক মাঝখানে আনতে পারছে! এখানেই প্রমাণ হয়—ইঁদুর চোখে না দেখেও কাজ করছে পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। তার মস্তিষ্কে সেই অভিজ্ঞতা স্মৃতি হয়ে জমা আছে। নতুন সংকেত না আসলেও, সেই পুরনো ডেটা থেকে সিদ্ধান্ত তৈরি হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা একে বলছেন, ‘পূর্ব প্রত্যাশার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ’। এটি শুধু ইঁদুর নয়, মানুষের ক্ষেত্রেও ঘটে প্রতিনিয়ত। আমরা অনেক সিদ্ধান্ত নিই না-জেনে, না-ভেবে, শুধুমাত্র অভ্যাস ও অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। একে বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেন বায়েসিয়ান ব্রেইন তত্ত্ব দিয়ে, যেখানে প্রতিটি নতুন সিদ্ধান্ত আসে পূর্বানুমানের মাধ্যমে।
সম্মিলিত বুদ্ধি বনাম একক সিদ্ধান্ত
আজকের সমাজে বা প্রযুক্তিতে, আমরা প্রায়ই নেতৃত্ব বা কর্তৃত্বকেই কার্যকারিতা ভাবি। মনে করি, একক নেতার দিকনির্দেশই দ্রুত ফল আনে। কিন্তু মস্তিষ্ক দেখিয়ে দিল— একক নেতৃত্ব নয়, সম্মিলিত অংশগ্রহণই কার্যকর সিদ্ধান্তের ভিত্তি। এটি এক ধরনের যৌথ বুদ্ধিমত্তা ব্যবস্থা, যা ভাগ করে দেওয়া আছে অথচ সমন্বিত। অনেকটা ঝাঁক বেঁধে মাছ চলার মতো— একেক-জন নেতৃত্ব নেয় কিছু সময়ের জন্য, কিন্তু গন্তব্য নির্ধারিত হয় সম্মিলিতভাবে।

মস্তিষ্কের এই গোপন শৃঙ্খলা থেকে আমরা কী শিখতে পারি?
এই গবেষণা শুধু স্নায়ুবিজ্ঞানের অগ্রগতি নয়, বরং আমাদের চিন্তার পদ্ধতি, প্রযুক্তি, সমাজগঠন, এমনকী নেতৃত্বের ধরন পর্যন্ত নতুনভাবে ভাবতে শেখায়।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও মেশিন লার্নিং
আজকের AI সিস্টেম অনেক সময় সিদ্ধান্ত নেয় বড় ডেটাসেট থেকে নির্দিষ্ট প্যাটার্ন চিনে। কিন্তু মানব মস্তিষ্ক শুধু তথ্য বিশ্লেষণ করে না— সে অভিজ্ঞতা থেকে শেখে, ভুল থেকে শিক্ষা নেয় এবং একই সঙ্গে বহু উৎসের তথ্য বিচার করে সিদ্ধান্ত নেয়। ভবিষ্যতের AI-কে সত্যিকার অর্থে ‘মানবসদৃশ’ করতে হলে, মস্তিষ্কের এই সমন্বিত ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শেখার মডেল অনুকরণ করতে হবে।
মানসিক স্বাস্থ্য ও নিউরনের সমন্বয়
ডিপ্রেশন বা সিদ্ধান্তহীনতা অনেক সময় মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ নয়, বরং নিউরনের মাঝে পারস্পরিক সমন্বয়ের গোলমালের ফল হতে পারে। এই গবেষণা সেই ‘গণতান্ত্রিক’ কার্যপ্রক্রিয়া বুঝতে সাহায্য করবে, যা ভবিষ্যতের চিকিৎসায় নতুন দিশা দেখাতে পারে।

আরও পড়ুন-কোথায় শান্তি? মোদির সফর শেষ হতে না হতেই ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ মণিপুরে

আচরণ বিশ্লেষণ ও অভ্যাস
আমরা প্রতিদিন অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিই, যার অনেকগুলোই যুক্তির চেয়ে অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। মস্তিষ্কের সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়াকে বুঝলে মানুষের আচরণ ও সিদ্ধান্তের প্যাটার্ন ব্যাখ্যা করাও সহজ হবে।
নেতৃত্ব ও দলগত সিদ্ধান্ত
একক নেতৃত্ব নয়, বরং সম্মিলিত অংশগ্রহণই সবচেয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত এনে দেয়— যেমনটা মস্তিষ্কে প্রতিটি নিউরন করে। সমাজেও এই মডেল কার্যকর হতে পারে।
মাথার ভেতরের নিঃশব্দ সংলাপ
আজকের বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদের জানিয়ে দিল— আমরা নিজের অজান্তেই চলি এক অদৃশ্য নেতৃত্বহীন সহবুদ্ধির নির্দেশে। প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি বিকল্প বিশ্লেষণ আসে হাজার হাজার নিউরনের সক্রিয় অংশগ্রহণে। এটি কেবল মস্তিষ্কের তথ্যপ্রক্রিয়ার এক নিখুঁত উদাহরণ নয়, বরং জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্তের এক অন্তর্মুখী অনুশীলন।

Latest article