মোদি সরকার যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার গোড়ায় কুড়ুল মেরেছে, অতীতে তেমনটা আর কেউ করেনি। আর্থিক ব্যাপারে এই কাঠামোর চুরমার হয়ে যাওয়াটা আরও প্রকট। লিখেছেন আকসা আসিফ।
সংবিধানের প্রস্তুতিপর্ব চলছে তখন, গণপরিষদ তখন বেজায় ব্যস্ত। ১৯৪৮-এর সেই সময়টাতে গণপরিষদে নিজের উদ্বেগ অ-গোপন রাখেননি বি পোকার সাহিব। কেরল থেকে গণপরিষদের সদস্য হয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন এখন স্বাধীনতা লাভের পর আমরা যদি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের (Provincial Autonomy) বিষয়টিকে অবজ্ঞা করি আর যাবতীয় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করি কেন্দ্রের হাতে, তবে তা সর্বাত্মকবাদের দিকে চলবে এবং সেটা ধিক্কারযোগ্য।
আরও পড়ুন-বেআইনি শ্রমিক নিয়োগ নয়
এই আশঙ্কা যে সেদিন অমূলক ছিল না, তা আমরা আজ, এই অতিমারির প্রহরে, বেশ ভালমতোই টের পাচ্ছি।
খেলাট শুরু হয়েছিল করোনা অতিমারি আসার আগেই। যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখানোর খেলা। সিএসএস বা কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাপুষ্ট প্রকল্পগুলোতে রাজ্যের অবদানের অংশ বৃদ্ধি, পঞ্চদশ ফিনান্স কমিশনের শর্তাবলি, রাজ্যের সঙ্গে কোনও আলোচনা ছাড়াই নোটবন্দি, জিএসটির প্রয়োগ-তত্ত্ব, স্মার্ট সিটি মিশনে বিধিবদ্ধ কার্যাবলিতেও আউটসোর্সিং করা, এক দেশ এক রেশন, জিএসটি বাবদ রাজ্যের বকেয়া না-মেটানো ইত্যাদিতে এই এককেন্দ্রিক স্বৈরাচারের খেলাটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল তখন থেকেই।
আরও পড়ুন-শুরুতে টোকা নিয়ে আসেন দাদু, এখন নাতি
অতিমারির প্রহরে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে চুরমার করে দিয়ে কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনার তাবৎ দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হল রাজ্য সরকারকে। সংক্রমণ পরীক্ষার কিট সংগ্রহ, টিকাদান, বিপর্যয় মোকাবিলা ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ, অপরিকল্পিত লকডাউন, তা-ও আবার দেশব্যাপী— সবকিছুতেই সরিয়ে রাখা হল রাজ্য প্রশাসনকে। আর যখন দ্বিতীয় কোভিড ঢেউয়ের ধাক্কায় বেসামাল মোদি সরকার, তখন কেন্দ্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অবলীলায় বলে দিলেন, স্বাস্থ্য ব্যাপারটা রাজ্যের এক্তিয়ারে পড়ে! সত্যি সেলুকাস, কী বিচিত্র এই মোদি সরকার!
কৃষি আইন প্রণয়ন, ব্যাঙ্কিং রেগুলেশন (সংশোধনী) আইন ২০২০, জাতীয় রাজধানী অঞ্চল সংক্রান্ত আইনে সংশোধন, সামুদ্রিক মৎস্যচাষ সংক্রান্ত বিল, ২০২১ বিদ্যুৎ বিষয়ক বিলের সংশোধনীয় খসড়া, ২০২০, ২০১৯-এর বাঁধ নিরাপত্তা বিষয়ক বিল, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০— সবকিছুতে রাজ্যকে বাদ দিয়ে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রের মোদি সরকার। আর্থিক ক্ষেত্রে এই স্বেচ্ছাচারী মানসিকতা স্পষ্টতর।
পেট্রোপণ্যের ওপর সেস বসিয়ে যে অর্থ অর্জিত হল, তাতে ভাগ পেল না রাজ্যগুলো। ২০১৩-’১৪-তে এ-বাবদ আয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের অনুপাত ছিল প্রায় ৫০-৫০। সেখানে গত ৬ ডিসেম্বর, ২০২১-এ কেন্দ্রের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক সংসদে জানিয়েছে এক্ষেত্রে কেন্দ্র পকেটে পুরেছে ৬৮ শতাংশ আয় আর রাজ্যের কপালে জুটেছে মাত্র ৩২ শতাংশ।
আরও পড়ুন-অঙ্গীকারবদ্ধ তৃণমূল কংগ্রেস আরও সক্রিয়, জিততে হবে সব পুরসভাই ঘরে ঘরে জনসংযোগ শুরু
অতিমারির দোহাই দিয়ে মোদি সরকার রাজ্যের বারংবার অনুরোধ সত্ত্বেও নিশ্চিত ক্ষতিপূরণের অংকটা মেটাতে চায়নি। রাজ্যগুলোকে তাদের বকেয়া মিটিয়ে দিলে অর্থনৈতিক মন্দার হার খানিকটা কমত। জিএসটি-র ঘাটতি মেটাতে ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অথচ জিএসটিতে নিশ্চিত ক্ষতিপূরণ নীতি প্রযোজ্য ২০২০ অবধি এবং সেই সময়সীমা বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও মোদি সরকার বাড়ায়নি। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের রিপোর্ট বলেছে, ২০১৮-’১৯-এ জিএসটি ক্ষতিপূরণ সেসের ৪৭ হাজার ২৭২ কোটি টাকা রাজ্যগুলোর প্রাপ্য হওয়া সত্ত্বেও দেশের কনসলিডেটেড ফান্ডে রাখা হয়েছে। পঞ্চদশ ফিনান্স কমিশন বলেছিল কেন্দ্রীয় করের ৪১ শতাংশ রাজ্যগুলোকে দেওয়ার কথা। তা না মেনে ২০২১-’২২-এর বাজেটে রাজ্যগুলোকে ৩০ শতাংশ দিয়ে তাদের মুখ বন্ধ রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।
পিএম কেয়ারে দেওয়া অর্থ সিএসআর ব্যয় বলে গণ্য হবে আর মুখ্যমন্ত্রীর বিপর্যয় মোকাবিলায় গঠিত ত্রাণ তহবিলে প্রদত্ত অর্থ সে সুবিধা পাবে না। কেন?
আরও পড়ুন-আই লিগের শুরুতেই বিতর্ক, সই-জটে ৯ ফুটবলার নিয়ে মাঠে রাজস্থান
গণতন্ত্র বাঁচাতে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষা করাটা জরুরি। রাজ্যগুলো কেন্দ্রের প্রজা নয়। রাজ্য ও কেন্দ্র হল দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দুটো ডানা।
এগুলো আমরা সবাই জানি, কিন্তু জানলেও মানে না মোদি সরকার।
ছিন্নপক্ষ খঞ্জনার মতো তাই সে নেচে নেচে নিজের জয়গান গেয়ে চলে।
আর, গোটা দেশ সিঁটিয়ে থাকে তার তাবৎ গৌরব চুরমার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়। দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো রক্ষা করে তার শ্রীবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে মোদিরাজের পতন হওয়া দরকার।