নাট্যসমালোচক প্রগাঢ় উচ্চারণ করেছিলেন, ‘ব্রাত্যযুগ চলছে’। সম্প্রতি গ্রন্থপ্রকাশ মঞ্চ থেকে গোসাঁইকবি সেই মতেই সিলমোহর দিয়েছিলেন। নাট্যসমগ্রের পাঁচ পাঁচটা সুবপু খণ্ড, তিনটি মহাকাব্যোপম উপন্যাস, গভীর কিছু গল্প, কবিতা, অজস্র প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, অনুবাদ, সম্পাদনা, নাট্য নির্দেশনা, চলচ্চিত্র নির্মাণ, অভিনয়ের সপ্তাশ্ব রথে সওয়ার হয়ে একজন সৃজনের মাঠ ক্রমাগত বড় করে ছুটেই চলেছেন। নাটকের দল থেকে সরকারের শিক্ষা বিভাগকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। হাতে-কলমে করে দেখাচ্ছেন কোম্পানি থিয়েটারতত্ত্ব বাস্তবিক সম্ভব। স্বভাবতই রসিক মহলের একাংশ বিশ্বাস করছেন, বাংলায় এখন তিনিই যুগ। তিনি ব্রাত্য বসু। তাঁর ২০২২ সালে প্রকাশিত ‘বি. বি. : বারটোল্ট ব্রেশট-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী’ নবকলেবরে পুনরায় প্রকাশ পেল। আরও স্পষ্ট, আরও প্রযত্নলালিত হয়ে। এবার সঙ্গী ব্রাত্যর ব্রেশট চর্চার আর এক মাণিক্য ‘যুদ্ধের বর্ণপরিচয়’। ব্রেশট লিখিত ‘ওয়ার প্রাইমার’ কাব্যগ্রন্থের ব্রাত্য বসু-কৃত ভূমিকা-সহ অনুবাদ। দুটি সৃজনই অভিঘাতী। ব্রেশটের জীবনী লিখতে বারোটি কাব্যময় শিরোনামযুক্ত অধ্যায় মলাটবন্দি করেছেন ব্রাত্য। প্রত্যেকটি সুরভিত গদ্য, প্রাজ্ঞ প্রতর্ক ও পরিপ্রশ্নময়। এরই সঙ্গে জুড়ে রাখা একটি তীক্ষ্ণ ভূমিকা ও তথ্যময় পরিশিষ্ট, এই নিয়ে বইটি নিটোল। যদিও লেখক সেকথা স্বীকার না করে বরং অসম্পূর্ণতার আশঙ্কাই করেছেন। ২০২২ সংস্করণের পাশে রাখলে বিরাট কিছু বদল চোখে পড়বে না। কেবল কিছু যুক্তিপূর্ণ অভিনিবেশ সংযোজিত হয়েছে। ব্রেশটের মতো মানুষদের পরিচিতি দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভূগোল বরাবরই কৃপণ। তাই আগের প্রকাশে যেখানে ব্রেশট ‘দেশ’-এ ফেরেন, এই সংস্করণে ব্রাত্য তাঁকে নিতান্ত ‘জার্মানি’তে ফেরান। সময়ের কোন প্রসবযন্ত্রণা এমন জীবনীগ্রন্থের জন্ম দেয়, এই তর্ক আমরা তুললে যেটা ওপরে ভেসে ওঠে, সেটাও ব্রেশটের জীবন। একজন সদানির্বাসিত এবং সদাপলাতক কমিউনিস্ট শিল্পী, যাঁকে ভয় পেতে হয়েছে কমিউনিস্টদের থেকেও। প্রগতি সাহিত্যের গুঁতোয় দাগানো সর্বহারা বৃত্তের সকলেই হন সর্বৈব মহান আর খেয়ে-পরে সচ্ছল মাত্রেই হয়ে পড়েন অনুভূতিহীন হাড়বজ্জাত। এতে একপেশে প্রোপাগান্ডার তেলভাণ্ডার পূর্ণ হলেও শিল্প যে বাটি হাতে পার্টিলাইনের দুয়োরে ভিক্ষা মেগে ফিরে যায়, এটা ব্রেশট বুঝেছিলেন। ব্রাত্যও বিশ্বাস করেছেন। বেঞ্জামিন ডিসরেলি বলেছিলেন পোড়ো না, জীবনীগ্রন্থ পড়ো। কারণ জীবনীগ্রন্থ তত্ত্বের বাইরে এসে জীবন ব্যাখ্যা করে। ইতিহাস ক্ষমতাধররা লেখান নিজের মতো করে।
আরও পড়ুন-সহিংসতার জেরে ৫ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে ফেরত পাঠাচ্ছে ভারত
কিন্তু জীবনীগ্রন্থে সে কারসাজি চলে না। বর্ণময় চরিত্র ব্রেশট। পারফর্মিং আর্টে দুটো বিশ্বযুদ্ধের শঙ্খনিনাদের মাঝে শুয়ে থাকা প্রথমবিশ্ব, তার শিল্পচর্চার ঘর-বাড়ির খবর, ইতিহাসের শ্যাওলার নিচে চাপা থাকা আপনজনের অপরাধ, বারবার প্রত্যাখ্যাত প্রজ্ঞার ক্লিন্নতাকে ব্রেশটের মতো লং-শটে আর কে তেমন তুলতে পারছিলেন? অথচ লেখনীর গায়ে কোনও চওড়া প্রপাগান্ডার চিহ্ন নেই! নারী, যৌনতা, প্যাশান আর ব্রেশটের জীবন, সেই সম্পর্কগুলোর স্বাভাবিকতা নিয়ে ব্রাত্যর কলম একেবারে দ্বিধাহীন, সটান। একইরকম বঙ্গীয় সাম্যবাদী তাঁবুর তৎসংক্রান্ত অস্বস্তি নিয়েও। অভিযোগ করেছেন সেই তাঁবুর ব্রেশটচর্চার ধরন নিয়ে, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রশক্তির পাশাপাশি তাঁর ওপর অফিসিয়াল কমিউনিস্টদের অত্যাচার নিয়ে ‘হিরন্ময় নীরবতা’ পালন নিয়ে। সেটাই সম্ভবত জীবনীকারের মূল প্রেরণা।
মানুষ মরতে পারে, উড়তে পারে, মারতে পারে, আবার ভাবতেও পারে। এই শেষেরটা নিয়ে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের যত গেরো। আর্তুরো উই তাই জেগে থাকেন ব্রেশটের লেখায়, ভাবুক মানুষকে চিরতরে ঘুম পাড়ানোর আগ্রহে। ব্রেশটের লেখা কবিতা, নাটক আপাদমস্তক ফ্যাসিবিরোধী। জীবনী লিখতে গিয়ে ব্রেশটের কবিতাগুলোও অনুবাদ করেছেন ব্রাত্য। বাংলা ভাষার নিজস্ব স্বাদুতা বজায় রাখতে কিছুক্ষেত্রে স্বাধীনতা নিয়েছেন তিনি। একই রীতি অনুসরণ করেছেন ‘ওয়ার প্রাইমার’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির বঙ্গীকরণ করতে গিয়ে। এক্সপ্রেশনিস্ট কবি ব্রেশটের নির্বাসন পর্বে জার্মান ভাষায় লেখা এপিগ্রামের বই ‘ক্রিগসবাইল’-এর ইংরেজি অনুবাদ ‘ওয়ার প্রাইমার’। যুদ্ধের তলপেট থেকে ঝলকে তুলে আনা ভেদনশক্তিসম্পন্ন কবিতায় ঠাসা আস্ত ওয়্যারহাউস। কবির অমোঘ অনুভূতি অনুবাদকের কলমে, ‘আমিই তো সভ্যতা রক্ষায় একা অফুরন্ত।’ সর্বশক্তিমান মেকিত্বের মুখের ওপর ছবির মতো সুন্দর করে হেসেছেন ব্রেশট। ঘূর্ণির মতো নেচেছেন ফ্যাসিজমের চোখ রাঙানির চারপাশে। সেগুলোই অনুবাদককে ভিতর থেকে আকৃষ্ট করেছে ‘যুদ্ধের বর্ণপরিচয়’ সৃজনে। ‘মহান দিগ্ভ্রান্ত নেতা’র উদ্দেশ্যে একমুখ থুতু এনে হেসে উঠে ব্রেশটের কণ্ঠে অনুবাদকও ‘চিয়ার্স’ বলে চিৎকার করেছেন। সঙ্গে রেখেছেন খান ছিয়াশি লাগসই ছবি। পাঠকের সুবিধার্থে সার্থক দাস বড় নিষ্ঠা নিয়ে এই বইটিতে টীকা, চিত্রসূত্র ও প্রাসঙ্গিক তথ্য সুসংবদ্ধ করেছেন।
রন চেরনাও, জেমস্ বস্ওয়েল, ওয়াল্টার আইজ্যাকশনরা যে তাগিদ থেকে জীবনীসাহিত্যকে দেখেছেন, সেই প্রজ্ঞা পারমিতায় আমরা ব্রাত্য বসুকেও জুড়ে নিতে পারি তাঁর ‘বি বি : বারটোল্ট ব্রেশট-এর পূর্ণাঙ্গ জীবনী’ এবং ‘যুদ্ধের বর্ণপরিচয়’ বই দু’টির সৌজন্যে। দ্বিতীয়টি কবিতার অনুবাদ হলেও তার ভূমিকা নিয়ে প্রথম বইটির পরিপূরক। দুটি মিলিয়ে পাঠের অভিজ্ঞতা নিলে তবেই একটা ব্রেশটের ছবি পাব, যাকে ফ্যাসিস্ট আর সিউডো কমিউনিস্টরা প্রতিদিন লাথি-ঝাঁটা কষিয়েছেন। পয়সা উসুলপ্রত্যাশী পাঠককেও চেটেপুটে বুঝে নেওয়ার সুযোগ রেখেছে এই গ্রন্থ-আয়োজন।