বাংলায় (west bengal) ‘পরিবর্তন’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়েছিল কার সৌজন্যে? ৩৪ বছরের জগদ্দল সিপিএম-শাহির পরিবর্তন চেয়ে দেড় দশক আগে পরিবর্তনের ডাক দিয়েছিলেন ‘অগ্নিকন্যা’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মুখে ‘পরিবর্তন’ কথাটি যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল, সেটাই ছিনতাই করতে মরিয়া বিজেপি। ‘জয় শ্রীরাম’ ছেড়ে স্বয়ং মোদি ‘মাকালী’ এবং ‘মাদুর্গা’র নাম জপতে শুরু করেছেন। সোজা কথায়, বাংলার প্রধান বিরোধী দল ভরপুর টোকাটুকির মানসিকতা দিয়েই একটা শুভ কাজে নামার সংকল্প নিয়েছে।
‘মোদির গ্যারান্টি’ দেখে দেখে মানুষ ইতিমধ্যেই ক্লান্ত। মোদির গ্যারান্টি বলতে বাংলার (west bengal) গরিব মানুষগুলি সীমাহীন বঞ্চনার অধিক কিছু পায়নি। একশো দিনের কাজ এবং আবাস যোজনায় টাকা মেলেনি আজও। চাকরি/কর্মসংস্থানের নামগন্ধ নেই। এখন চলছে ‘ডাবল ইঞ্জিন’ রাজ্যগুলিতে বাঙালি বা বাংলাভাষীদের উপর রকমারি নিপীড়ন। এসআইআর-এর ধুয়ো তুলে এই অত্যাচার বহুবর্ধিত হয়ে উঠেছে। বিজেপির এক ‘মহামানব’ তো নিদান দিয়েছেন, বাংলা কোনও ভাষাই নয়!
স্বাধীনতার আট দশকেও রাষ্ট্র জানে না, কারা তার নাগরিক! আধার-সহ রকমারি কার্ড দেওয়া হয়েছে। সবগুলিই তৈরি করা বাধ্যতামূলক। অথচ সেগুলি ‘নির্ভরযোগ্য’ বলে মানেন না সরকার বাহাদুর স্বয়ং! সব মিলিয়ে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না।
এর মধ্যেই পরিযায়ী ভোট প্রচারকেরা বাংলায় এসে বারবার পরিবর্তনের ডাক দিচ্ছেন।
পরিবর্তন অবশ্যই দরকার। তবে মা-মাটি-মানুষের সরকারের নয়, পরিবর্তন জরুরি গেরুয়া অক্ষের। যত জন বিজেপি এমপি, এমএলএ বাংলায় আছেন তাঁদের আসনগুলিতে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ যাঁরা ইতিমধ্যেই নিজেদের বাংলা-বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন তাঁদের জন্য কেন বাংলার কিছু অমূল্য আসন নষ্ট হবে? এঁরা আবার জেতা মানে, বাংলার ক্ষতিবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করবেন। বাংলার বদনামের বিস্তার ঘটাবেন দেশ জুড়ে। মোদির দলের কিছু নেতার কাছ থেকে মাঝেমধ্যে যে ‘গ্যারান্টি’ মেলে তা বঙ্গভঙ্গের রকমারি প্যাকেজ মাত্র। তবে বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়াতেই অবশ্য কেউ কেউ ‘থুড়ি’ বলে কথা ঘোরাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। বাংলার বদনাম বৃদ্ধির জন্য দিল্লিতে অপপ্রচারেও সিদ্ধহস্ত তাঁরা। বাংলার জনমুখী প্রকল্পগুলি রুখে দেওয়ার জন্য দিল্লিতে গিয়ে দরবারেও দড় কেউ কেউ। সোজা কথায়, দেশ জুড়ে যে গেরুয়া বিশৃঙ্খলা কায়েম হয়েছে, তাতে সবচেয়ে বেশি ধাক্কা খাচ্ছে উন্নয়ন।
আরও পড়ুন-প্রাচীন রীতি মেনে ৩৫০ বছর ধরে চলে আসছে পটের দুর্গার পুজো
বাংলার সত্যিকার উন্নয়ন চাইলে মোদি-শাহ -দের বেশ কয়েকটা কাজ করতে হবে। বাংলার প্রাপ্য অর্থ দিন, যাবতীয় বকেয়াসমেত। বাংলার মানুষের হাতে হাতে কাজের ব্যবস্থা করুন। তার জন্য নতুন শিল্প চাই। এ-সব বিষয়ে মোদি শাহের দল সাহায্যের হাত না বাড়িয়ে বরং বিভ্রাট বাধাচ্ছে, প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। পরিবর্তন চাইছে উন্নয়ন বিরোধীরা। বাংলার মানুষ এটা সহ্য করবেন? কেন করবেন?
সংকীর্ণ রাজনীতির জুতোয় পা গলিয়ে বাংলায় পরিবর্তনের ডাক দেওয়া যায় না।
মোদিজিদের কাছে অনুরোধ, আগডুম বাগডুম না বকে, দেশ জুড়ে বাঙালি এবং বাংলাভাষীদের অসম্মান বন্ধ করুন। ভুলে যাবেন না, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলা এবং বাঙালির অবদান ও আত্মত্যাগ সবার চেয়ে বেশি। এমন দুর্দশায় পতিত হওয়ার জন্য আমাদের পিতৃপুরুষগণ ইংরেজকে দেশছাড়া করেননি নিশ্চয়। বিজেপির বঙ্গ নেতারা যাতে দ্রুত সেলফ-পানিশমেন্ট প্যারানয়া মুক্ত হতে পারেন, তার জন্য সুচিকিৎসারও ব্যবস্থা করুন। এমন কমপ্লেক্সে যাঁরা ভুগছেন তাঁদের উপর নির্ভর করে আর যাই হোক বাংলা দখল কোনওকালেই সম্ভব হবে না।
১৯৩১ সালের ঘটনা। ফরাসি মনোবিদ জ্যাক লাকাঁ তখনও মেডিক্যালের ছাত্র, প্যারিসের সেন্ট-অ্যান হাসপাতালে মার্গারিট প্যান্টেইন নামে এক মহিলার চিকিৎসা করেন। তাঁর ডক্টরেট থিসিসে অবশ্য তিনি ব্যবহার করেন ওই রোগিণীর ছদ্মনাম—‘এমি’। এমি এক ‘অপরাধ’ করে বসেন। বিখ্যাত অভিনেত্রী ইগেট দুফলোকে ছুরিকাঘাত করার চেষ্টা করেন তিনি। এজন্য তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়। অথচ দুফলোর কোনও দোষ ছিল না। এই অসংলগ্ন এবং হতবাক করা কাণ্ডের কারণ খুঁজতে গিয়ে লাকাঁ বুঝতে পারেন যে, এটি এক প্রকার ‘সেলফ-পানিশমেন্ট প্যারানয়া’। লাকাঁর মতে, এমি নিজেকে ছুরি মারার বিকল্প হিসেবে দুফলোকে বেছে নেন। কারণ এমি দুফলোর মতোই খ্যাতিলাভের খোয়াব দেখতেন। কিন্তু বাস্তবে তাঁর পক্ষে তা সম্ভব ছিল না এবং তিনি তেমনটি হতেও পারছিলেন না। এমি ভেবেছিলেন, এজন্য একমাত্র দায়ী দুফলো। তিনিই ষড়যন্ত্র করে এমিকে উপরে উঠতে দিচ্ছেন না। এমি ভাবলেন, তাঁর নিজের যে ‘পার্সিকিউটেড সাইকি’, সেটিকে আঘাত করার সবচেয়ে ভাল পথ হল সরাসরি দুফলোকে আঘাত করে বসা।
ঠিক এই কাজটাই অবিরত করে চলেছে বাংলায় (west bengal) বিজেপি। প্যারানয়া এমন এক ধরনের মানসিক অবস্থা, যেখানে রোগী কোনও কোনও মিথ্যা বিশ্বাসকে ভীষণ সত্যি বলে ধরে নেয়। বাস্তবে সে তুচ্ছ মানুষ হয়েও ডেলিউশনের কারণে নিজেকে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। সে ভাবে যে, ‘আমার চেয়ে দামি কেউ নেই। যেটা আমি ভাবি এবং বলে থাকি— কেবল সেটাই খাঁটি।’
বঙ্গ বিজেপি এখন এই রোগে ভুগছে।
সুতরাং সাধু সাবধান!
পরিশেষে একটি তথ্য। মোদি সরকার বিষয়ক। এতেই বোঝা যাবে আসলে বিজেপি কী বস্তু।
আজ থেকে ঠিক দু’বছর আগের কথা। ২০২৩ সালের বিশ্বকর্মা পুজোর দিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন ‘পিএম বিশ্বকর্মা’ প্রকল্প। উদ্দেশ্য ছিল কারিগর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং তাঁদের দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বনির্ভরতা। মোদি সরকারের অন্য যে কোনও প্রকল্পের মতো ‘পিএম বিশ্বকর্মা’ নিয়েও প্রচারের ঢক্কানিনাদে কমতি ছিল না। কিন্তু যে লক্ষ্য নিয়ে এই প্রকল্প আনা হয়েছিল, তা পূরণ হওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট।
চলতি বছর পর্যন্ত এই প্রকল্পে প্রায় তিন কোটি আবেদন জমা পড়েছে। তবে এমএসএমই মন্ত্রকের আওতাধীন এই স্কিমে এখনও পর্যন্ত রেজিস্ট্রেশন পেয়েছেন ২৯ লক্ষ ৯৮ হাজার মানুষ। অর্থাৎ আবেদন ও প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার মধ্যে বিস্তর ফারাক। কেন্দ্র ঘোষণা করেছিল, প্রকল্পের একাধিক সুবিধার মধ্যে অন্যতম হল সহজ শর্তে মিলবে ব্যাঙ্ক ঋণ। সেই ঋণের টাকায় নতুন ব্যবসা বা কাজ শুরু করে জীবিকা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। সেই জায়গায় দেখা যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত এই প্রকল্পের আওতায় ঋণ পেয়েছেন মাত্র ৩ লক্ষ ৯১ হাজার আবেদনকারী। যদিও ঋণ পেতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে প্রায় ১২ লক্ষ ২০ হাজার আবেদন জমা পড়েছিল। অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি মানুষ যে প্রকল্পের সুবিধা নিতে চেয়েছিলেন, ঋণ নিয়ে সফলভাবে ব্যবসা করার হার সেখানে দেড় শতাংশেরও কম!
তথ্য বলছে, এই স্কিমে এখনও পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। প্রায় ৭ লক্ষ ৮৭ হাজার আবেদন পত্রপাঠ বাতিল করে দিয়েছে ব্যাঙ্কগুলি। ঋণ প্রদানে যে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে, তা মানছে এমএসএমই মন্ত্রকও।
তাই বলছি, বিজেপিকে ছেঁটে ফেলাই আসল পরিবর্তন। আসুন, সেই পরিবর্তনের পথে পা মেলাই।