আজ মহালয়া

পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের শুরু আজ থেকে। গতকালের তিথিতেই মহর্ষি কাত্যায়নের আশ্রমে দেবতাদের সম্মিলিত তেজ থেকে সৃষ্টি হয়েছে দেবী কাত্যায়নী দুর্গার। বাংলায় পুজোর উদ্বোধনও শুরু হয়ে গিয়েছে। এই আবহে আজ রইল চারটি প্রাচীন পুজোর কথা। জানাচ্ছেন দেবু পণ্ডিত

Must read

শুরু করা যাক শাক্তপীঠ পূর্ণ জেলা বীরভূম দিয়ে। বীরভূমের সুরুল। বর্ধমানের নীলপুর গ্রাম থেকে এখানে এসেছিলেন ভরতচন্দ্র সরকার। পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করেন এখানেই। এখানেই জন্ম নেন তাঁর ছেলে কৃষ্ণহরি। এই কৃষ্ণহরির বড়ছেলে যাদবেন্দ্র আর নাতি ব্রজবল্লভ সরকার সাহেবদের সঙ্গে ব্যবস্থা-বাণিজ্যের সুবাদে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। সেই সঙ্গে শুরু করেন দুর্গাপুজো। সেটা ছিল ১৭৯৭ সাল। পুজো শুরু হয় মাটির মন্দিরে, মাটির প্রতিমায়। ব্রজবল্লভের সেজ ছেলে শ্রীনিবাস। তিনিও সাহেবসুবোদের সঙ্গে ব্যবসাপাতি করে বাবার মতো ১৮ লক্ষ টাকা রোজগার করেন। সেই টাকায় কিনে নেন একের পর এক জমিদারি। মাটির মন্দিরের বদলে তৈরি করেন চকমিলান দালানওয়ালা মন্দির। সে মন্দিরের স্থপতি ছিলেন রানাঘাটের গোবিন্দ মিস্ত্রি। মন্দিরটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল ১৮ হাজার টাকা। এসব ১৮৩৩-এর আগেকার ঘটনা। এখানকার দুর্গাপুজোর বিশেষত্ব হল নৈবেদ্য দেওয়ার প্রথা। রোজ ২৯টি করে নৈবেদ্য নিবেদন করা হয়। ষষ্ঠীর দিন কুলদেবতা লক্ষ্মীনারায়ণের পুজোর পর শুরু হয় দেবী দুর্গার মূল পূজা। এখানকার কুমারী পুজোর বিশেষত্ব হল পুজোর সময় এলাকার কুমারী মেয়েদের পেটপুরে খাওয়ানোর রীতি। আগে নবমী পুজোর দিন দরিদ্রনারায়ণ সেবার রেওয়াজ ছিল। এখন তা অবলুপ্তির পথে। দশমীতে বিসর্জনের সময় এখনও এখানে ১০০ মশাল জ্বালানোর রেওয়াজ আছে। তবে সাবেক ঐতিহ্যে আঘাত হেনেছে শরিকি বিবাদ। এখন সুরুলের সরকারদের পুজো দ্বিধাবিভক্ত। ছোট বাড়ি আর বড় বাড়ি, দু’বাড়িতেই পুজো হয় এখন। এটুকুই যা। দু’বাড়িতেই একই রীতি রেওয়াজ কিন্তু অনুসৃত হয় আজও।
এবার আসা যাক ‘জ্যান্ত দুর্গা’ সারদা মায়ের জন্মস্থল যে জেলায়, সেই জেলার কথায়।

আরও পড়ুন-পাড়া শিবিরে প্রবীণ বাম নেতার গলায় মুখ্যমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা

বাঁকুড়া জেলার নারায়ণপুর গ্রাম। জেলার উত্তর অংশে বয়ে চলেছে বোদাই, দামোদরের শাখা নদী। তারই দক্ষিণ তীরে পাত্রসায়র থানার অন্তর্গত নারায়ণপুর। পাশের গ্রাম হৃদল। লোকে দু’গ্রামকে জড়িয়ে নিয়েছে স্থান নামে। বলে হৃদল-নারায়ণপুর। প্রায় তিনশো বছর আগেকার কথা। ১৭১২ থেকে ১৭৪৮-এর মধ্যেকার কোনও এক সময়ে এখানে এসেছিলেন মুচিরাম ঘোষ। আদি নিবাস ছিল বর্ধমানের নীলপুরে। বাঁকুড়ার হৃদল-নারায়ণপুরে যখন এলেন তখন সে গ্রাম বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের শাসনাধীন। এলাকার বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ছিলেন শুভঙ্কর রায়। তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল মুচিরামের। সেই পরিচয়ের সুবাদেই মল্লরাজ গোপাল সিংহের সুনজরে পড়লেন মুচিরাম। মল্লরাজাই মুচিরামকে দিলেন ‘মণ্ডল’ উপাধি আর সেই সঙ্গে হৃদল-নারায়ণপুরের জমিদারি। তখন থেকেই মুচিরাম নিজগৃহে শুরু করলেন দুর্গাপুজো। পুজো হয় পুরোপুরি বৈষ্ণবরীতি মেনে। হয় না কোনও পশুবলি। তার জায়গায় রোজ বলি দেওয়া হয় চালকুমড়ো আর অষ্টমীর দিন আখ বলি। বিজয়ার দিন এই পুজোতেও হয় সিঁদুরখেলা। এই অঞ্চলে ঘটকে বলা হয় ‘দোলা’। কলাবউ স্নান করিয়ে আনার সময়ে সঙ্গে থাকে এই ‘দোলা’। ‘দোলা আনা’র শোভাযাত্রা এই পুজোর অন্যতম বিশেষত্ব। ‘দোলা আনা’র সময় পরিবারের দুই পুরুষ সদস্য শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন। একজন নেন ঘট, অপরজন কলাবউ। তাঁদের অনুসরণ করে শোভাযাত্রা। তাতে পরিবারের ছোট-বড় অংশ নেন। পুজো চলার সময় এখানকার কোনও নারী-পুরুষ, বয়স ও পরিবার নির্বিশেষে, পায়ে জুতো পরেন না। কেউ কাউকে প্রণামও করেন না। পুজোর সময় হৃদল-নারায়ণপুরে একমাত্র প্রণম্য হলেন দেবী দুর্গা।
বাঁকুড়ার আর একটি গ্রাম। নাম চৈতন্যপুর। থানা গঙ্গাজলঘাঁটি। চারিদিকে বন-জঙ্গল। এক সময় এই গ্রামের জমিদার ছিলেন মাণিক আচার্য। তাঁর জমিদারি ছিল মালিয়াড়া রাজার অধীন। মাণিক আচার্যই নিজগৃহে চালু করেন দুর্গাপুজো। জমিদারি প্রথা যতদিন লোপ পায়নি, ততদিন এই পুজোর জাঁকজমক ছিল দেখার মতো। তবে জমিদারি প্রথা লোপ পাওয়ার আগেই আচার্য বাড়ির আর্থিক অবস্থায় ভাটা পড়ে। এই ভাটার টান দেখা যায় মোটামুটি কেদারনাথ আচার্যর সময় থেকে। কেদারনাথ জমিদার হিসেবে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ছিলেন। কিন্তু আর্থিক ব্যাপারে ছিলেন ভয়ঙ্কর বেহিসাবি আর মানুষ হিসেবে উড়নচণ্ডী প্রকৃতির। এর প্রভাব পড়ে আচার্য পরিবারের আর্থিক অবস্থায় এবং সেই সঙ্গে তাঁদের দুর্গাপুজোতেও। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে কেদারনাথের পরবর্তী প্রজন্ম দৈন্য দশায় ডুবে যায়। বংশধররা নিজেদের মধ্যে পুজোর পালা ভাগ করে নেন। এক-এক বছর এক-একজনের পালা পড়ে। এভাবেই হয়ে আসছে পুজো। সেই হিসাবে এখন দশ-বারো বছর অন্তর এক-একজন পুজোর দায়িত্ব বহন করেন।

আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর লেখা ও সুরে কাল ১৭ গানের অ্যালবাম প্রকাশ

জেলা বর্ধমান সদর থানার অন্তর্গত বড়শুল গ্রাম। দে-রা সেখানকার জমিদার। এই পরিবারের ঠাকুর দালানটি তৈরি হয় ১৮২১ সালে। তখন থেকেই মূর্তি পুজোর শুরু এই বাড়িতে। তার আগেও পুজো হত, তবে ঘটে। এখানে দুর্গা দশভুজা নন, মহিষাসুরমর্দিনীও নন। তিনি দ্বিভুজা এবং শিব সোহাগিনী। বাঘ ছাল পরনে শিব বসে থাকেন উঁচু আসনে। আর তাঁর বাঁ ঊরুতে বসে থাকেন তাঁর জায়া দুর্গা। বিশালাকার এক চালার প্রতিমা। শিবের এক হাতে ডমরু, অন্য হাতে শিঙা। তিনি জটাধারী। জটায় একটা সাপ আর দু’কাঁধে দুটি সাপ। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। তবে তিনি সমুদ্র মন্থনকালে গরল পান করেছিলেন। তাই-ই দে-বাড়ির মূর্তিতে তাঁর গলার রং নীল। একেবারে আক্ষরিক অর্থে নীলকণ্ঠ শিব। সিংহাসনের নিচে বসে থাকে তাঁর বাহন ষাঁড়টি। দেবী দুর্গার ডান হাতে অভয় দানের ভঙ্গিমা, বাঁ হাতের দুটি আঙুল জুড়ে মুদ্রার ভঙ্গি। দেবী এখানে একা। না আছে তাঁর বাহন সিংহ, না আছে বধ্য মহিষাসুর। তবে শিব-দুর্গার সঙ্গে আছেন তাঁদের পুত্রকন্যারা। শিবের পাশটিতে থাকেন গণেশ ও তাঁর ইঁদুর, সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকেন লক্ষ্মীদেবী। একইভাবে দুর্গার পাশটিতে দাঁড়িয়ে থাকেন সরস্বতী। আর ময়ূরের পিঠে থাকেন কার্তিক। তাঁর দু’হাতে তির-ধনুক। লক্ষণীয়ভাবে, এই প্রতিমা-পরিকল্পনায় লক্ষ্মী-সরস্বতীর কোনও বাহন নেই। দে-পরিবার বৈষ্ণবভাবাপন্ন কিন্তু দুর্গাপুজোয় মেনে চলা হয় শাক্ত বিধান। কুলগুরুর নাকি নির্দেশ ছিল এমনটাই। নবমীর দিন বলি দেওয়া হয় তিনটে চালকুমড়ো, একটা বাতাবিলেবু, একটা শসা আর একটা আখ। পশুবলির প্রথা নেই এ-বাড়িতে, নেই অন্নভোগ নিবেদনের প্রথাও। আগে হত ‘বাঘ নাচানো’, সে আসর বসত নবমীর রাতে। একজন ব্যক্তি বাঘের মুখোশ পরে আর নকল বাঘছাল জড়িয়ে নানা খেলা দেখিয়ে দর্শকদের আমোদ দিত। এখন আর সেসব হয় না। দশমীর সন্ধ্যায় দেবী বরণের অনুষ্ঠান। তখন দুর্গা দালানে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। বিসর্জনের আগে দেবী প্রতিমাকে বরণ করতে পারেন কেবল বাড়ির মহিলারাই।

Latest article