প্রবীণদের চোখে দুর্গা

কেউ সাহিত্যিক, কেউ গায়ক, কেউ অধ্যাপক, কেউ চলচ্চিত্র পরিচালক। প্রত্যেকেই খ্যাতনামা। প্রত্যেকেই প্রবীণ। দেবী দুর্গাকে কী চোখে দেখেন তাঁরা? কীভাবে কাটান পুজোর দিনগুলো? কথা বলে জেনে নিলেন অংশুমান চক্রবর্তী

Must read

আজ মহালয়া। পিতৃপক্ষের অবসান। দেবীপক্ষের সূচনা। নদীর ঘাটে ঘাটে চলছে তর্পণ। দুর্গাপুজো প্রায় শুরু হয়েই গেল বলা যায়। কারণ, আজ থেকেই উন্মুক্ত হবে বহু মণ্ডপের প্রবেশপথ। দর্শন করা যাবে প্রতিমা। আনন্দের জোয়ারে গা ভাসাতে শুরু করেছে বাংলা।
অনেকেই মনে করেন, পুজোর হই-হুল্লোড়ে মাতে মূলত কম বয়সিরাই। প্রবীণরা পারতপক্ষে এড়িয়ে চলেন কোলাহল, ভিড়ভাট্টা। তাঁরা নিজেদের মতো করেই পুজো কাটান। কেউ কেউ বসেন পাড়ার মণ্ডপে, কেউ কেউ বাড়িতেই থাকেন।
কিছুদিন আগেই গিয়েছিলাম ব্যারাকপুরের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। সেখানে ঘরোয়াভাবে হয় দুর্গাপুজো। আনন্দে মেতে ওঠেন আবাসিকরা। নতুন পোশাক। খাওয়াদাওয়া। আড্ডা। একদিন বাসে চড়ে বাইরের ঠাকুর দেখা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বৃদ্ধাশ্রমের এক মহিলা বলেছিলেন, আমরা এখানে এসে অতীতের কথা ভুলে থাকার চেষ্টা করি। কী পাইনি না ভেবে কী পেয়েছি, সেটা ভেবেই বাঁচি। এখানে কোনওরকম সমস্যা হয় না। পুজোর দিনগুলো আনন্দে কাটে। হাতে হাত মিলিয়ে নিজেরাই সবকিছু করি। একে অন্যের মধ্যেই দেবী দুর্গাকে খুঁজে পাই।
হাওড়ার সাঁতরাগাছি বাকসাড়ার একটি বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকরাও প্রতি বছর একসঙ্গে পুজোয় দিনগুলো কাটান। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়। কোনও কোনও বছর ঠাকুর দেখাতেও নিয়ে যাওয়া হয়। বিভিন্ন ক্লাব সংগঠন থেকে দেওয়া হয় পুজোর প্রসাদ। জানালেন বৃদ্ধাশ্রমের শুভ্রা দত্ত।

আরও পড়ুন-মার্কিন সংস্থার ভারতীয় কর্মীদের কী হবে?

ঘরেই থাকেন শীর্ষেন্দু
এঁরা সাধারণ মানুষ। এবার মুখোমুখি হব সেইসব প্রবীণদের, যাঁরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, সুপরিচিত, খ্যাতনামা। জেনে নিতে হবে, দেবী দুর্গাকে তাঁরা কী চোখে দেখেন? কীভাবে কাটে তাঁদের পুজোর দিনগুলো?
কথা হল সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সারা বছর সচল থাকে তাঁর কলম। লিখে চলেন গল্প, উপন্যাস। দেবী দুর্গা তাঁর চোখে কী? পুজোর দিনে তিনি কী করেন? সাজিয়ে দিলাম প্রশ্ন। জানালেন, দেবী দুর্গা আমার চোখে শক্তির প্রতিমূর্তি। তাঁর উপাসনা হল শক্তির উপাসনা। যদিও এর নানারকম ব্যাখ্যা আছে। যাই হোক, এখন পুজোর দিনগুলো মোটামুটি ঘরে বসেই কাটাই। আগে বিভিন্ন সংস্থার পুজো পরিক্রমায় বিচারক হয়ে যেতাম। ঘুরতে হত বিভিন্ন মণ্ডপে। তখন ভালভাবেই সুন্দর সুন্দর সব পুজো দেখতাম। এখন প্রচণ্ড ভিড়ভাট্টা। ফলে বেরোই না। ঘরেই থাকি। না, পুজোর সময় লেখালিখি বিশেষ একটা করি না। বইপত্র পড়ি। টিভি দেখি। খেলা থাকলে খেলা দেখি।
পুজোর সময় অনেকেই বেড়াতে যান। আপনি গেছেন কখনও? জানালেন, পুজোর সময় সচরাচর বেড়াতে যাই না। তবে একবার গিয়েছিলাম লন্ডনে। নবমীর দিন কলকাতায় ফিরেছিলাম।
তিনি আরও বলেন, আমাদের বাড়ির সামনে তিনটে বড় পুজো। যোধপুর পার্ক, ৯৫ পল্লী এবং তালতলা মাঠের পুজো। আমার কাছে আমন্ত্রণ আসে। তবে যাওয়া হয় না। ছেলেমেয়েরা যায়। আগে পুজোয় অঞ্জলি দিতাম। এখন আর দেওয়া হয় না। আসলে এই সময় বাইরে বেরোতেই ইচ্ছে করে না। বাড়িতেই থাকি। আমি নিরামিষাশী মানুষ। পুজোর সময় ঘি-ভাত বা ফ্রায়েড রাইস হলে খাই। এই বয়সে পেটে তো সব সয় না। যাই হোক, এইভাবেই কাটে আমার পুজোর দিনগুলো।

আরও পড়ুন-সিজার অ্যাটাকের পরে হাসপাতালে দু’ঘণ্টা! জুবিনের মৃত্যুতে সিআইডি তদন্ত

গাছের পরিচর্যা করেন অমিত্রসূদন
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য। অবসর জীবন যাপন করছেন। লিখে চলেছেন একটার পর একটা বই। পাশাপাশি চলছে সম্পাদনার কাজ। কথা হল তাঁর সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আরাধ্য দেবতা। দেবী দুর্গা সম্পর্কে তিনি বললেন, দুর্গা আমার চোখে প্রতিমা। দেবতা আমার কাছে নিত্য বিরাজমান। শুধু মণ্ডপে নয়। আমি যদি মণ্ডপে নাও যাই, তাও দেবী দুর্গা নামক শক্তিকে আমি পুজো করি। তিনি সেই শক্তির মূর্তি মাত্র। সেই মূর্তি কখনও দুর্গা, কখনও কালী, কখনও লক্ষ্মী, কখনও সরস্বতী রূপে দেখা দেন। সবমিলিয়ে আমার কাছে ঈশ্বরের এক-একটি রূপ মাত্র। যাঁরা অপৌত্তলিক, তাঁরাও ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেন। তাঁরা মূর্তি কল্পনা করে নেন। সেই মূর্তির সঙ্গে বাস্তবের মূর্তির মিল নাও থাকতে পারে। অচেতন, অবচেতন মনে না দেখতে পাওয়া শক্তিকে তাঁরা দেখেন।
কীভাবে কাটান পুজোর দিনগুলো? জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, পুজোর সময় আমি মূলত লেখাপড়া করি। আগেও তাই করতাম। আমার স্ত্রী প্রায় ১১ বছর আগে গত হয়েছেন। তিনি যখন ছিলেন, আমরা দুজনে পুজোর ছুটি এবং অন্য কোনও সময় বাইরে বেড়াতে যেতাম। মূলত উত্তরবঙ্গে।
এখন বেড়াতে যান? জানালেন, এখন আর কোথাও যাই না। পুজোর সময় শান্তিনিকেতনেই থাকি। আগে এখানে পুজোর ঢাক বাজত না। ঢোল বাজত না। পটকা ফাটত না। এখন অনেক বদল ঘটেছে। যাই হোক, এখন পুজোর সময় পড়াশোনা করেই সময় কাটে। কিছু প্রিয় মানুষ বাড়িতে আসেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলি। শান্তিনিকেতনে আমার বাড়ির নাম ‘আনন্দমঠ’। এটাই আমার আনন্দের আশ্রম। বাড়ির চারপাশে বাগান। পুজোর ছুটিতে আমি গাছের পরিচর্যা করি। ফুল ফোটানোর কাজে ব্যস্ত থাকি। ছোট্ট জমির উপর তিনটি বাড়ি বানিয়েছি। পুজোর ছুটিতে সেই বাড়িগুলো মনের মতো করে সাজাই। শুধু পুজোর ছুটিতে নয়, আমার কাছে প্রতিদিনই শান্তিনিকেতন সুন্দর।

কোথাও যান না হৈমন্তী
সংগীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লা। বহু পুজো মণ্ডপে শোনা যায় তাঁর গান। কথা হল তাঁর সঙ্গে। তিনি জানালেন, একটা সময় পুজোর সময় দেশের বাইরেই থাকতাম। ইংল্যান্ড, আমেরিকায় অনুষ্ঠান করতে যেতাম। দিল্লি, মুম্বইয়েও গেছি। প্রবাসী বাঙালিরা আন্তরিকতার সঙ্গে পুজো করেন। তবে এখন আর কোথাও যাই না। পুজোর সময় বাড়িতেই থাকি। কারণ, শরীর ভাল নেই।
অঞ্জলি দেন? তিনি জানালেন, এখন পুজোয় অঞ্জলি দিতে যেতে পারি না। তবে পুজোর আনন্দ বাড়িতে বসেই উপভোগ করি। খাওয়াদাওয়া হয়। দুর্গা আমার কাছে মা। তিনি এলে তো আনন্দ হবেই! তিনি যে আনন্দময়ী।

আরও পড়ুন-গানে-গানে প্রতুল-স্মরণ

ভিড় এড়িয়ে চলেন শিবাজী
আটের দশকের মাঝামাঝি মুক্তি পেয়েছিল তরুণ মজুমদারের ‘ভালবাসা ভালবাসা’। প্রায় প্রতিটি গান ফিরেছিল মুখে মুখে। ‘খোঁপার ওই গোলাপ’-সহ কয়েকটি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন শিবাজী চট্টোপাধ্যায়। তখন তিনি যুবক। এখন প্রবীণ। আজও বিভিন্ন পুজো মণ্ডপে শোনা যায় তাঁর গান। কথা হল তাঁর সঙ্গে। মা দুর্গা আপনার চোখে কী? জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, দুর্গা আমাদের শক্তি। রক্ষাকবচের মতো। তাঁর আশীর্বাদে, তাঁর করুণায় আমরা সমস্তকিছু করতে পারছি। তিনিই আমাদের চালিকাশক্তি।
কীভাবে কাটান পুজোর দিনগুলো? তিনি জানালেন, পুজোর সময় মনের মধ্যে অদ্ভুত আনন্দের জন্ম হয়। এটা হয় ছোটবেলা থেকেই। চারিদিকে পুজো। বিরাট পুজো হয় আমার বাড়ির সামনেও। অগণিত মানুষ রাস্তায় বের হন।
ঠাকুর দেখতে যান। ঘুরতে যান। আলোকসজ্জা দেখেন। আমি এগুলো দেখেই আনন্দ উপভোগ করি। কারণ, এখন পুজোর সময় খুব বেশি বাইরে বেরোই না। ভিড় এড়িয়ে চলি। তবে কম বয়সে ঠাকুর দেখার বিরাট শখ ছিল। এখন ঠাকুর দেখি পুজোর কার্নিভালে।
পুজোর সময় নানা জায়গায় গানের অনুষ্ঠান হয়। আমন্ত্রণ থাকে না? তিনি জানালেন, আগে পুজোর সময় অনুষ্ঠানে যেতাম। তবে এখন আর যাই না। বাড়িতেই থাকি। টিভিতে ঠাকুর দেখি। জমিয়ে খাওয়াদাওয়া হয়। থাকে কিছু স্পেশাল আইটেম। তার মধ্যেও মিশে থাকে পুজো-পুজো ভাব। অনেক সময় বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজন আসেন। গল্পগুজব করি। গান শুনি। পুরনো এবং নতুন গান। কোনও কোনও বছর পুজোর সময় বৃষ্টি হয়। তখন খুব খারাপ লাগে। ঠাকুরের কাছে একটাই প্রার্থনা, পুজোর আনন্দ যেন মাটি না হয়। বয়সের কারণে জনজোয়ারে পা মেলাতে না পারলেও, মনে মনে মানুষের সঙ্গেই থাকি। আনন্দের সঙ্গী হয়েই থাকি। আপডেট থাকার চেষ্টা করি। নিউজ চ্যানেল দেখে জেনে নিই পুজোয় কোথায় কী হচ্ছে। এখন অঞ্জলি দেওয়া হয় না। মাইকে অঞ্জলির মন্ত্র ভেসে আসে। সেটা শুনেই মন ভরিয়ে নিই। এইভাবেই আমি দুর্গাপুজো মনে-প্রাণে উপভোগ করি। ব্যক্তিগতভাবে মণ্ডপে হাজির না থেকেও মনটাকে ওখানে পাঠিয়ে দিই।

আরও পড়ুন-স্মৃতির কীর্তির দিনে সিরিজ হার ভারতের

গ্রামীণ পুজো দেখেন গৌতম
চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ। অভিনয়ও করেছেন কয়েকটি ছবিতে। তাঁর সঙ্গেও কথা হল। পুজোর দিনগুলো কীভাবে কাটান? তিনি জানালেন, আজকাল পুজোর সময় খুব একটা বাড়ির বাইরে বেরোনোর চেষ্টা করি না। থাকি গোলপার্কের কাছে। এত ট্রাফিক যে বেরোনোই যায় না। এই কারণেই আসল পুজোটা মিস করি। কলকাতায় সুন্দর সুন্দর থিম পুজো হয়। মাঝেমধ্যে চেষ্টা করি দু-একটা পুজো দেখে নেওয়ার। তারপর চলে যাই কলকাতার বাইরে।
কোথায়? তিনি বললেন, কাছাকাছি কোথাও। শারদোৎসবে তো শুধু কলকাতাই নয়, সারা রাজ্য মেতে ওঠে। কলকাতায় আড়ম্বর হয়তো বেশি। একটা বিরাট কার্নিভাল হয়। বিদেশ থেকে প্রচুর লোকজন আসেন। লোকের কর্মসংস্থান হয়। পাশাপাশি আমার গ্রামীণ পুজো দেখতেও খুব ভাল লাগে। তাই বীরভূম চলে যাই। শান্তিনিকেতনে আমার শ্বশুরবাড়ি। পুজোর সময় কখনোসখনো সেখানে যাই। ওই অঞ্চলের বেশকিছু প্রাচীন পুজো দেখার সুযোগ হয়। গ্রামের পুজো দেখার মধ্যে অদ্ভুত আনন্দ রয়েছে। সেই সঙ্গে চেষ্টা করি নিজের কাজ করার। বসে বসে চিত্রনাট্য লিখি।
পুজোয় পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়? তিনি জানালেন, একটা সময় পুজোয় প্রচণ্ড হইহুল্লোড় করতাম। স্বাভাবিক কারণে এখন আর সেটা সম্ভব হয় না। বন্ধু-বান্ধবদের বয়স হয়েছে। তারাও এদিক-ওদিক চলে গেছে। অনেকেই চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে। পুজোর সময় তাদের কথা খুব মনে পড়ে। মনটা খারাপ হয়ে যায়। মনে পড়ে, এক সময় সবাই মিলে কত আনন্দ করেছি। এটা তো জীবনের নিয়ম। কিচ্ছু করার নেই।
বসে বসে অনেক কথাই ভাবেন তিনি। কী ভাবেন? জানালেন, আমাদের দেশে এত বৈষম্য, এত ভেদাভেদ যে কল্পনাই করা যায় না। দিন দিন যেন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আগে শারদোৎসবের সময় এইসব মনে হত না। এখন হয়। এই সময় পৃথিবীর কত মানুষ অভুক্ত। কত মানুষের কিচ্ছু নেই। পুজোর সময় এটা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। নিজের দেশকে ভালবাসতে হবে। বুঝতে হবে। বন্ধ করতে হবে সাম্প্রদায়িক হানাহানি। দুর্গাপুজোয় এত আলো, এত রোশনাই খুব সুন্দর লাগে। পাশাপাশি মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে অভুক্ত শিশুদের উপর গুলি চালানোর ঘটনা মনে পড়লে। এ আমরা কোথায় বাস করছি? উৎসবের সময় এগুলো খুব মনে হয়। মহাবিশ্ব থেকে দেখা যায় শান্ত পরিবেশ। মাঝখানে নীল রঙের একটা গ্রহ। আমাদের পৃথিবী। জুম করলে দেখা যাবে রক্ত, শোনা যাবে গুলির আওয়াজ। এগুলো আমাকে খুব পীড়া দেয়। শক্তির দেবী মা দুর্গার কাছে প্রার্থনা, মানুষ শান্ত হোক, শুদ্ধ হোক। এখন আর অঞ্জলি দেওয়া হয় না। অঞ্জলি দিলে এগুলোই হত দেবীর কাছে আমার প্রার্থনা।

Latest article