ডায়াবেটিস রুখতে নীরব বন্ধু

খাবারের পর রক্ত-শর্করার হঠাৎ ঊর্ধ্বগতি যেন নিঃশব্দে শরীরে বাজায় বিপদের ঘণ্টা। এই নীরব সংকেতকে থামাতে বিজ্ঞান এনেছে নতুন আশার দিগন্ত— গ্লুব্লক। আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞানের ছোঁয়ায় গড়া এই পরিপূরক খাদ্য আজ ডায়াবেটিস প্রতিরোধে এক নীরব সহযোদ্ধা। সে-বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেন তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

মিষ্টিই যত অনাসৃষ্টির কারণ
ভারতে ডায়াবেটিস বা মধুমেহ এক নীরব অতিমারি। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের ২০২১ সালের ডায়াবেটিস অ্যাটলাসের স্পষ্ট ইঙ্গিত, আজ ভারতবর্ষে প্রায় ১০.১ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক ডায়াবেটিস পীড়িত। এর অন্যতম সূচক হল পোস্ট প্রানডিয়াল ব্লাড গ্লুকোজ, অর্থাৎ খাওয়ার ২ ঘণ্টা পর রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। এই মাত্রা যদি প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ১৪০ মিলিগ্রাম ছাড়িয়ে যায়, তবে তা প্রাক-ডায়াবেটিসের ইঙ্গিত; কিন্তু যদি ২০০ মিলিগ্রাম ছাড়ায় তাহলে তা স্পষ্টতই ডায়াবেটিস। গবেষণায় দেখা গেছে, শহুরে জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০% মানুষ খাবারের পর অতিরিক্ত গ্লুকোজ বৃদ্ধির শিকার। ফল— নানারকম শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা। কিন্তু নিয়মিত হাঁটা, সুষম খাদ্য ও স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণে রাখলে পরিস্থিতি অনেকক্ষেত্রেই সামাল দেওয়া যায়। গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণকারী নতুন প্রযুক্তিও এ-ক্ষেত্রে আশার আলো। তবে খাবারের পর রক্তে শর্করার এই ওঠা-নামাই ডায়াবেটিসের প্রথম সতর্ক ঘণ্টা। সচেতনতার প্রশ্ন উঠতেই, বলা ভাল ডায়াবেটিস রুখতে বিজ্ঞানীদের হাতে এসেছে অসীম সম্ভাবনাময় ‘গ্লুব্লক’।
আমরা জানি, দেহজগতের প্রতিটি কোষ যেন এক-একটি অধ্যায়— এককেন্দ্রিক না হলেও একান্ত আন্তঃসম্পর্কযুক্ত এবং এই জটিল শারীরতন্ত্রের অন্যতম নিয়ামক হল রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা। খাওয়ার পর হঠাৎ করে রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, যাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলে পোস্ট প্রানডিয়াল ব্লাড গ্লুকোজ সার্জ, তা যদি বারবার ঘটে, তবে নিঃশব্দে আমাদের শরীরে জন্ম নেয় নানা বিপদ— ডায়াবেটিস, হৃদরোগ এমনকী স্নায়ুতন্ত্রের নানা অসুখের আশঙ্কা। এই শারীরবৃত্তীয় চক্রে এক নতুন সংযোজনের বাণিজ্যিক নাম গ্লুব্লক। এটি একটি ফুড সাপ্লিমেন্ট বা প্রাকৃতিক খাদ্যসম্পূরক যা গবেষণার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, সুস্থ ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও খাওয়ার পর গ্লুকোজের হঠাৎ বৃদ্ধিকে আশ্চর্যজনকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে। বৈজ্ঞানিক মহল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আগামীদিনে গ্লুব্লকের উপর অনেকটাই ভরসা রাখছেন।
একটি পাইলট স্টাডি,
একঝলক ভবিষ্যৎ
২০২৩ সালের ১২ জুলাই ভারতবর্ষের তেলেঙ্গানার মাই পুরা ভিদা ওয়েলনেস প্রাইভেট লিমিটেডের পক্ষ থেকে মিঃ চৈতন্য চক্রবর্তী গালি এবং মিসেস ললিতা পালে ‘রিসার্চ স্কোয়ার’ নামে একটি জার্নালে গ্লুব্লকের কার্যকারিতার উপর একটি গবেষণামূলক রিপোর্ট প্রকাশ করেন। তখন যদিও বিষয়টি পুরোপুরি পরীক্ষালব্ধ ছিল না। পরবর্তীতে, গত বছর ১১ জুলাই ভুবনেশ্বর এইমসের ডঃ গিরিপ্রসাদ ভেনুগোপাল, ডঃ ঋষিকেশ দাশ, ডঃ শিবানী অগ্রবাল, ডঃ সায়ন্তন রয়, ডঃ প্রশান্তকুমার সাহু এবং ডঃ বালামুরুগন রামদাস একত্রে ‘এমডিপিআই’ জার্নালে গ্লুব্লকের উপর পরীক্ষালব্ধ গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
গবেষণাটি ছিল ডাবল-ব্লাইন্ড, প্লেসেবো-নিয়ন্ত্রিত পাইলট স্টাডি— যেখানে নমুনা ব্যক্তির কেউই জানতেন না কে উচ্চ শর্করা জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করছেন এবং কে গ্লুব্লক গ্রহণ করছেন। এই ধরনের গবেষণা বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে দেখা গেছে, গ্লুব্লক গ্রহণকারী গ্রুপে খাবারের পর গ্লুকোজ বৃদ্ধির গতি ছিল লক্ষণীয়ভাবে ধীর এবং নিয়ন্ত্রিত, যেখানে প্লেসেবো গ্রুপে তা ছিল দ্রুত ও তীব্র। বলা ভাল, গবেষণায় অংশ নিয়েছিলেন সুস্থ প্রাপ্তবয়স্করা, যাঁদের উপর খাবারের আগে এবং পরে গ্লুকোজ মাপকাঠি প্রয়োগ করে ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, গ্লুব্লক ব্যবহারে শরীর যেন খাবার থেকে শর্করা শোষণ করার সময় কিছুটা ধীর গতি নেয়— যেন একধরনের জৈবিক সাবলীলতা এনে দেয়।
কীভাবে কাজ করে গ্লুব্লক?
গ্লুব্লক হল একটি প্রাকৃতিক উদ্ভিদজাত খাদ্য-মিশ্রণ যা মূলত আপেলের (মুলাস ডোমেস্টিকা) খোসা বা বীজ ও হোয়াইট মাল বেরি (মোরাস আলবা এল) বা সাদা তুঁতের পাতা থেকে তৈরি। বৈজ্ঞানিক কেরামতিতে ওই দুটি ফলের বিশেষ অংশ একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে মিশিয়ে গ্লুব্লক তৈরি করা হয়। এর মধ্যে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ যেমন, কোয়ারসেটিন, ফ্লোরিডজিন, ক্যাটেচিন, রুটিন ও ক্লোরোজেনিক অ্যাসিডের মতো শক্তিশালী পলিফেনল ও ফ্ল্যাভোনয়েড থাকে। এই উপাদানগুলো খাবারের পর রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে বাধা দেয়, বিশেষ করে কার্বোহাইড্রেট বা চিনি-সমৃদ্ধ খাবারের পর। গ্লুব্লক সাধারণত স্বাস্থ্য পরিপূরক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আমরা জানি, হাই গ্লাইসেমিক ইনডেক্স যুক্ত খাবার, যেমন ৩০০ গ্রাম চালের ভাত কিংবা ৪০০ এমএল জলে প্রায় ৭০ গ্রাম চিনির সরবত স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে যেমন রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বেড়ে যাওয়া, তেমনি ইনসুলিন প্রতিরোধ গড়ে ওঠা, ওজন বৃদ্ধি এবং রক্তে শর্করার হঠাৎ পতন বা গ্লুকোজ ক্র্যাশের মতো বিপর্যয়ও ঘটে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, গ্লুব্লকের মূল উপাদান হল প্রাকৃতিক ফাইবারসমৃদ্ধ জৈব যৌগ— যা পাচনতন্ত্রে শর্করার ভাঙনকে বিলম্বিত করে। সহজভাবে বললে, এটি আমাদের হজম প্রক্রিয়ায় এমন একটি ‘বাঁধ’ তোলে, যা খাবারের পর গ্লুকোজ যেন বন্যার মতো রক্তপ্রবাহে না ঢোকে, বরং নদীর স্রোতের মতো ধীরে, নিয়ন্ত্রিতভাবে প্রবেশ করে। ফলে, শরীরের ইনসুলিনের ওপর চাপ কমে যায় এবং দেহকে নিজের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসার সময় দেয়। এই প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে শুধু ডায়াবেটিস প্রতিরোধেই নয় বরং ওজন নিয়ন্ত্রণ, অন্ত্রের স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক বিপাকতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হতে পারে।
ভবিষ্যতের কথা
গ্লুব্লককে আমরা একটি কার্যকরী ‘টুল’ হিসেবেও দেখতে পারি, আবার একটি চিকিৎসাগত দর্শন হিসেবেও। এটি শরীরের সাথে একাত্ম হয়ে, তাকে স্বাভাবিক ছন্দে চলতে সহায়তা করে। এর নেই কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, আছে শুধু সহযোগিতা; নেই কোনও প্রকার ডিসঅর্ডারের চোখরাঙানি, এর গুণে রয়েছে এক অদ্ভুত শারীরবৃত্তীয় সমন্বয়। বিজ্ঞানীদের অনন্য খোঁজ এই গ্লুব্লক। কেননা, বিজ্ঞানের কাজ কেবল সমস্যা শনাক্ত করা নয় বরং সেই সমস্যার প্রতি মানবিক সমাধান খোঁজা। গ্লুব্লকের গবেষণা তারই এক আশানুরূপ অধ্যায়। প্রতিদিনের খাওয়াকে শুধুই রসনার তৃপ্তি না ভেবে, যদি আমরা দেহের সাথে সঙ্গতি রেখে চিন্তা করি— তবে এই প্রকার খাদ্যসম্পূরক অর্থাৎ আমাদের দৈনন্দিন ডায়েট চার্টে গ্লুব্লকের উপস্থিতি আমাদের সুস্থ জীবনের পথপ্রদর্শক হতে পারে।
যদিও এই গবেষণা এখনও প্রাথমিক স্তরে, তবে এর সম্ভাবনা অসীম। ভবিষ্যতে ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা, দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব এবং নিরাপত্তা-বিষয়ক আরও বিস্তৃত গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু একথা বলা যায়— এই পাইলট স্টাডি এক সম্ভাবনাময় বার্তা বহন করে : খাদ্য যদি হয় ওষুধ, তবে প্রকৃতির কাছেই হয়তো আছে তার উত্তর।

Latest article