পুজো এসে গেল, ভোটও আসছে

এবারের দুর্গাপুজোতেও বঙ্গজীবনে রূপ আসুক, জয় আসুক, যশ আসুক, বিদ্বেষ বিষ ছড়ানোর প্রয়াস নাশ হোক। ভোটের জটে বাঙালির দুর্গাপুজো হারায়নি, এবারেও হারাবে না। বরং হারাবে তাদের যারা বাইরে থেকে এসে এই জমিতে বিভাজনের চাষ করতে চাইছে। লিখছেন তানিয়া রায়

Must read

কোনও দিন ভোটে না দাঁড়িয়েও মন্ত্রীসান্ত্রি না-হয়েও শুধুমাত্র ওই একটা দুর্দান্ত বাঙালিয়ানার সম্পদ উপহার দেওয়ার দৌলতে শতবর্ষ পেরিয়েও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র আন্তর্জাতিক। অমরও বটে। যতদিন বাঙালি থাকবে, দেবীপক্ষ ফিরে ফিরে আসবে এবং তাঁর অস্মিতার অনন্ত প্রতীক হয়েই সংবৎসর মহালয়ার পুণ্য প্রভাতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নামটাও উচ্চারিত হবে একই নিঃশ্বাসে।

আরও পড়ুন-ডায়াবেটিস রুখতে নীরব বন্ধু

একইভাবে, অভিন্ন আবেগে বাংলা ও বাঙালি কোনও দিন ভুলবে না অন্তত একটা দুর্দান্ত বাঙালিয়ানার সম্পদ উপহার দেওয়ার কারণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। বাঙালির দুর্গাপুজো চিরায়ত ছিলই। তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশিষ্টতা এনে দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ইউনেস্কো বাঙালির দুর্গাপুজোকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের স্বীকৃতি দিয়েছে। এবং বলতেই হবে বাঙালির দুর্গাপুজোর এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সম্ভব হয়েছে এক বাঙালি নারীর জন্যই।
তিনি ভোট পাখি নন। দুর্গাপুজোর সঙ্গে তাঁর হৃদয়ের সম্পৃক্তি। কিন্তু বিরোধীরা যাদের গতবারও তেমন উৎসাহ ছিল না, আসন্ন ভোট দখলের দৌড়ে তারাও পাল্লা দিচ্ছে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে! ভাল। ক্ষতি নেই। কিন্তু বাঙালির এই অনাবিল আনন্দে যুগ যুগ ধরে যাঁরা শামিল তাঁদের যদি বাইরের কেউ হিন্দুত্বের পাঠ দিতে আসে তাহলে ব্যাপারটা ব্যুমেরাং হতে বাধ্য। যেমনটা বিজেপির হয়েছিল কয়েক বছর আগে, ২০২১ এ।
কারণ আরএসএসের জন্ম ১৯২৫ সালে। আর দুর্গাপুজোর ইতিহাস হাজার হাজার বছরের। বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম পুজো করেছিলেন ১৯০১ সালে। সেই পরম্পরা আজও চলছে বেলুড় মঠে, বাংলার অলিতে গলিতে। তথাকথিত কোনও সনাতনী ছোঁয়া ছাড়াই।
এখন বাঙালির এই আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার পথে সনাতনীরা বাদ সাধছেন। দোহাই আপনাদের। ভোট ফুরোলেই তো কর্পূরের মতো উবেও যাবেন। সুতরাং বাংলার আবহমান পরম্পরায় ব্যাঘাত ঘটাবেন না, দয়া করে। এসব কথা বলতেই হচ্ছে, কারণ গেরুয়া পার্টির আচরণ। এই পার্টির কোনও কাজই স্বতঃস্ফূর্ত নয়, সবকিছুতেই ভোটের পাটিগণিত। কুসুমের ‘শরীর, কেবলই শরীরে’র মতো বিজেপির ভোট, কেবলই ভোট। দুর্গাপুজোকে মাথায় রেখেই নাকি জিএসটি কমানো হয়েছে। খুব ভাল কথা। কিন্তু মহামান্য নির্মলাদেবীকে প্রশ্ন বাংলায় ভোট আসন্ন বলেই কি দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাচ্ছেন! গতবারও তো জিএসটি কমাতে পারতেন। কোভিডের পরপরই সারা দেশ থেকে এই দাবি উঠেছিল। এবারই কেন? পুজোকে ব্যবহার করেই জনসংযোগ এবং তা থেকেই বাংলা, বিহার, তামিলনাড়ু, কেরলে ইলেকশন মেশিনারির বিনির্মাণ। এতদ্দ্বারা পুজোটাকেই অসম্মান করা হচ্ছে না কি!
ভোটের বছর হলেই পুজোয় হাওয়াই জাহাজে চেপে দিল্লি থেকে এসে বিজেপি নেতাদের উদ্বোধনের ধুম পড়ে যায় কেন? বাংলার হিন্দুরা কি এতই ঠুনকো! শুধু ভোটব্যাংক হিসেবে ব্যবহৃত হবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ দেড়শো বছর আগে সব সনাতনীকে হারিয়ে ধর্মের বহুত্ববাদকে তুলে ধরেছেন একেবারে সহজ সরল ভাষায়— ‘যত মত তত পথ!’ সর্বজনীন হিন্দুত্বের এর চেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মনোগ্রাহী আর কোনও ব্যাখ্যা হতে পারে? বিজেপি নেতারা জবাব দিন। বিজেপির আরও কীর্তি কলাপ। এবং তজ্জন্য গণ প্রতিক্রিয়া। রাজধানী দিল্লির পুজোমণ্ডপে প্রধানমন্ত্রীর ছবি রাখার গেরুয়া ফরমান পুজো কমিটিগুলি মেনে নেয়নি, বিদ্রোহ করেছে। এই বাংলাতেও বাঙালির উৎসবকে রাজনৈতিক জমি দখলের হাতিয়ার করা হলে প্রতিরোধ অনিবার্য। বিজেপি জেনে রাখো।

আরও পড়ুন-টাইফুন রাগাসা আছড়ে পড়ল ফিলিপিন্সে, এই বছরের সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড়

আগামী ছ’মাসে বাঙালির ভবিষ্যতের বিনির্মাণ যেন ধ্বংসাত্মক না হয়। গণতন্ত্রে ভোট আসবে যাবে। ক্ষমতা দখলের নিরন্তর খেলায় বাঙালিকে তাঁর সঠিক পথ বেছে নিতে হবে। ভেদাভেদ, হাঙ্গামা, বিভাজন কখনও যেন আমাদের দুর্বল করতে না পারে। দেশভাগ মন্বন্তর বন্যা খরা যাবতীয় দুর্যোগ এবং ব্যক্তিগত রেষারেষির ক্ষয়কে অতিক্রম করে বাঙালির এই মনটা বেঁচে থাকুক। এর বিশালতা কোনও ভিনদেশির খুঁটে বাঁধা থাকবে না কোনওদিন। বিজেপি শুনে রাখো, শহর কলকাতা পেরিয়ে বাংলার গ্রামেগঞ্জে দুর্গা পূজার অমূল্য আনন্দরতন আজ ছড়িয়ে পড়ছে, বাদ নেই সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপার বিদেশেও। লন্ডন প্যারিস নিউ ইয়র্কে ছড়িয়ে পড়া এই বিচিত্রগামী বাঙালিকে ক্ষুদ্র ভোটবাক্সে বাঁধবে কোন সংকীর্ণ রাজনৈতিক দল! সনাতনী নয়, বিভেদকামীও নয় বাঙালির সত্তা বেঁচে থাকবে সর্বজনীন উৎসবে।
মিলনের ভিড়ে, ঐক্যের জাদুতে আজও অমলিন বাঙালি সত্তার উচ্চকিত আবেগ মগ্নতা!
সুতরাং তার অনিবার্য উচ্চারণ, রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি!
বঙ্গজীবনে রূপ আসুক, জয় আসুক, যশ আসুক, বিদ্বেষ বিষ ছড়ানোর প্রয়াস নাশ হোক।
ভোটের জটে বাঙালির দুর্গাপুজো হারায়নি, এবারেও হারাবে না। বরং হারাবে তাদের যারা বাইরে থেকে এসে এই জমিতে বিভাজনের চাষ করতে চাইছেন।
‘রক্তবীজবধে দেবী চণ্ডমুণ্ড বিনাশিনী।’
স্তোত্রটা বিজেপি যেন মনে রাখে।

Latest article