পুজোর সময় ঢাক বাজে। প্রতি বছরই। কিন্তু এবার কেন জানি না মনে হচ্ছে, সেই আওয়াজকে ছাপিয়ে যাবে আত্মপ্রচারের ঢক্কানিনাদ।
নিজের ‘কৃতিত্ব’ দাবি করার ক্ষেত্রে কে এগিয়ে, তা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একটি অলিখিত প্রতিযোগিতা হতেই পারে। কিন্তু এই প্রশ্নে ট্রাম্পকে যে এক ইঞ্চি জমি ছাড়তেও নারাজ মোদি, তা নিয়ে বিতর্কের কোনও অবকাশ নেই। সোমবার থেকে গোটা দেশে জিএসটির নতুন হার কার্যকর হতে শুরু করেছে। বিভিন্ন পণ্যে এর পুরো সুবিধা এখনই মিলবে কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। তবে জিনিসপত্রের দাম কমলে সাধারণ মানুষ যে খুশি ও উপকৃত হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু জিএসটি হার কমার কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রীর বলে প্রচার করতে শুরু করেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। মোদি নিজেও তাতে ভুল কিছু দেখছেন না! কিন্তু ঘটনা হল, এই অভিন্ন পণ্য পরিষেবা কর কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে জিএসটি কাউন্সিল। এই কাউন্সিলে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ছাড়াও রয়েছেন সব রাজ্যের অর্থমন্ত্রী। বস্তুত নিজেদের বিপুল রাজস্ব ঘাটতি হবে জেনেও প্রতিটি রাজ্যের অর্থমন্ত্রী একযোগে এই সিদ্ধান্তে সহমত হয়েছেন। রাজ্যের তরফে আপত্তি উঠলে জিএসটির এই সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হত কেন্দ্রের। তাই এর কৃতিত্ব যৌথভাবে কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির, মোদি বা কেন্দ্রের একার নয়। তাছাড়া ২০১৭-তে চালু জিএসটিকে ‘গব্বর সিং’ ট্যাক্স বলে কটাক্ষ করে বহু আগে থেকে তা সংশোধনের দাবি জানিয়েছে কংগ্রেস। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাস্থ্যবিমা-কর মকুব করার জন্য প্রথম দাবি তুলেছিলেন। সুতরাং জিএসটি হার কমানোর কৃতিত্বের দাবি করে প্রধানমন্ত্রী যে সস্তার রাজনীতি করছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আরও পড়ুন-সুদৃশ্য তোরণে সেজে উঠবে আলিপুরদুয়ার
দেবীপক্ষ শুরুর প্রথম দিন থেকে চালু নতুন ব্যবস্থাকে জিএসটি সাশ্রয় উৎসব বলে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কথায়, ‘এ হল আত্মনির্ভরতার লক্ষ্যে এক বড় পদক্ষেপ।’ দেশবাসীর উদ্দেশে তাঁর বার্তা, স্বদেশি পণ্য কিনুন। ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ পণ্য কেনাবেচায় জোর দেন তিনি। রাজ্যগুলিকে স্বদেশি পণ্য উৎপাদনে গতি আনার জন্য জোর দিতে বলেন তিনি। মোদির বক্তৃতায় বিদেশি পণ্য বর্জনের সরাসরি ডাক ছিল না ঠিকই, কিন্তু বিদেশি পণ্যের উপর নির্ভরতা কমাতে বলেন তিনি। একটা দেশকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আত্মনির্ভর হতে গেলে দেশি পণ্যের উৎপাদন, কেনাবেচা ও ব্যবহার যে বাড়াতে হবে, পরনির্ভরতা কমাতে হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেদিক থেকে প্রধানমন্ত্রীর বার্তা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই দেখতে পারলে দেশবাসী খুশি হতেন। কিন্তু এখানেই মোদি ‘দ্বিচারিতা’ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিরোধীদের অভিযোগ, আত্মনির্ভরতা, স্বদেশি পণ্যের কথা বলে প্রধানমন্ত্রী বিমা ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ছাড়পত্র দিয়েছেন। প্রতিরক্ষা, খনিজ সম্পদের মতো ক্ষেত্রগুলি বিদেশি সংস্থার জন্য হাট করে খুলে দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, মোদির ‘স্বদেশি’ বক্তব্যের মধ্যে আবেগ, রাজনীতির কৌশল থাকলেও তা বর্তমান ভারতের প্রেক্ষিতে আদৌ বাস্তবসম্মত নয়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় স্বদেশিরা দিয়েছিলেন ভারতীয় মর্যাদা ও জীবিকা রক্ষার জন্য বিদেশি পণ্য বর্জনের ডাক। তার পিছনে ছিল স্বাধীনতার জন্য ত্যাগের মহৎ উদ্দেশ্য। এখন এই গ্লোবালাইজেশনের যুগে যেখানে মাউসের এক ক্লিকে ঘরের দরজায় আধুনিক ও উন্নতমানের যে কোনও পণ্য এসে হাজির, সেখানে তাকে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনও পরিকাঠামোই ভারতের এখন নেই। তাই মুখে কেবল স্বদেশি আবেগ বা দেশপ্রেম দিয়ে ভোক্তাদের পছন্দকে প্রভাবিত করা যাবে না। নিজের পায়ে দাঁড়াতে, প্রতিযোগিতায় লড়তে গেলে শক্ত জমি তৈরি করা প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী সেই মূল বিষয়কে আড়াল করে ‘আত্মনির্ভর ভারত’, স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের কথা বলে হাততালি পেতে চাইছেন! তাতে চিঁড়ে ভিজবে না।
আরও পড়ুন-বিশ্রামেই বুমরা? আজ ফিরতে পারেন অর্শদীপ
কথায় আছে, আপনি আচরি ধর্ম পরেরে শিখাও। প্রধানমন্ত্রী হওয়া-ইস্তক মোদির নামীদামি ব্র্যান্ডের বহুমূল্যের পোশাক, বরাবর আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। তাঁর ‘ফ্যাশন স্টেটমেন্ট’ বিশ্বের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমের নিয়মিত চর্চার বিষয়। তবু তাঁর 5মধ্যে স্বদেশি গন্ধ রয়েছে। কিন্তু মোদির পছন্দের তালিকায় একগুচ্ছ বিদেশি পণ্যের ছড়াছড়ি! বিদেশি বিলাসবহুল ব্র্যান্ডের ব্যবহার তাঁর নিত্য-অভ্যাস! যেমন ঘড়ি। মোদির প্রিয় ব্র্যান্ড সুইজারল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত মুভাডো ঘড়ি। তাঁর বিশেষ পছন্দ জার্মান সংস্থার তৈরি মঁ ব্ল ফাউন্টেন পেন। আবার ইতালির নামজাদা ব্র্যান্ড বুলগারির চশমা পরেন তিনি। একবার সূর্যগ্রহণের সময় মে ব্যাক সানগ্লাস পরতে দেখা যায় তাঁকে। এর সব ক’টিরই মূল্য লাখের ঘরে। মুখে স্বদেশি পণ্য ব্যবহারের বার্তা দিয়ে লাক্সারি বিদেশি ব্র্যান্ডের উপর নির্ভরতাও এক ধরনের ‘দ্বিচারিতা’ বলে মনে করেন অনেকে। হতে পারে, আমেরিকার ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানোর পাল্টা কৌশল হিসেবে স্বদেশি পণ্যের ব্যবহারের প্রচার করে প্রধানমন্ত্রী বিদেশনীতির কিছু ব্যর্থতা বা দুর্বলতা ঢাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেটা করতে হলেও নিজের ঘর থেকেই কাজটা শুরু করা উচিত। মোদিজি কি তা করতে রাজি আছেন? মনে তো হয় না।
এই প্রসঙ্গে আর একটি জরুরি তথ্য। ঘোষণা হয়েছিল আড়াই সপ্তাহ আগেই। প্রচারের ঝংকারেও কোনও খামতি রাখেনি কেন্দ্র। জিএসটির নয়া হারে দাম কমবে নিত্যপণ্যের, এমন প্রচারের ব্যাটন নিয়ে মাঠে নেমেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এগুলো আমরা সবাই জানি। আম জনতার আবেগে শান দিতে মোদিজি সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন দেবীপক্ষ ও নবরাত্রির উৎসবকেও। ২২ সেপ্টেম্বর থেকে দেশ জুড়ে জিএসটির হার কমার সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল ক্রেতাদের। সেই সুবিধা মিলল কি? বাজার ঘুরলেই বোঝা যাচ্ছে, খুচরো পণ্যে জিএসটির সুরাহা এখনও পাচ্ছেন না ক্রেতারা। তবে স্বস্তি ছিল পাইকারি কেনাকাটায়। নয়া হারে জিএসটির বিল নেওয়ার ক্ষেত্রেও জিইয়ে রইল প্রযুক্তির ঝঞ্ঝাট। বড় বড় ভাষণ দেওয়ার আগে মোদি এদিকে নজর দিন, প্লিজ।