আড়ালের প্রতিমারা

আসন্ন দুর্গোৎসবের রঙে যখন চারদিক মাতোয়ারা, তখন কুমোরটুলির সরু গলিতে চলছে অন্যরকম লড়াই। আলো-আঁধারির ভেতর, খড়ের গাদার পাশে, কাদামাখা আঙুলে মূর্তির গড়ন তুলছেন একঝাঁক নারী-শিল্পী। তাঁরা কেবল মা দুর্গার প্রতিমা গড়ছেন না, নিজেদের অস্তিত্বের লড়াইও গড়ে তুলছেন প্রতিটি বাঁকে, প্রতিটি ছাঁচে। তাঁদের সঙ্গে কথা, তাঁদের কথা বললেন অঙ্কিতা ব্যানার্জি

Must read

নারীশক্তির জাগরণ
পুরাণে বলা আছে— যখন দেবতারা অসুরের শক্তির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন, তখন তাঁদের মিলিত শক্তিতে জন্ম নিলেন এক নারীশক্তি— মা দুর্গা। তিনিই একমাত্র সক্ষম হলেন অশুভ শক্তিকে দমন করতে। আজ-কালের স্রোত পেরিয়ে সেই সত্য যেন মিলে যায় কুমোরটুলির গলিতে। এখানে মাটির সঙ্গে লড়াইয়ে নামা নারীরা প্রমাণ করছেন— যেখানে ইচ্ছাশক্তি, সাহস আর দক্ষতা আছে, সেখানে নারীর পদক্ষেপ থামানো যায় না।
একসময় প্রতিমাশিল্পে নারীর ভূমিকা সীমিত ছিল সহায়কের গণ্ডিতে। কিন্তু আজ তাঁরা একাহাতে কাঠামো গড়েন, মাটি গড়েন, রঙে প্রাণ দেন, আবার সংসারের দায়িত্বও সমান তালে সামলান। চিকিৎসা, আইন, রাজনীতি বা গণমাধ্যমের মতোই এই শিল্পক্ষেত্রেও নারী আজ পুরুষের সমকক্ষ। তাঁরা সহকর্মী নন, প্রতিযোগীও নন— বরং সমান মর্যাদায় শিল্পের আসনে প্রতিষ্ঠিত। রান্নাঘরের ধোঁয়া, সংসারের চাপ, সন্তানের যত্ন— সব সামলে তাঁরা নেমেছেন মাটির সঙ্গে যুদ্ধ করতে। সমাজে এখনও অনেক সময় প্রশ্ন ওঠে— ‘নারী কি আদৌ পারবে প্রতিমা গড়তে?’ কিন্তু কুমোরটুলির এই নারীরা প্রতিদিনই সেই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন। তাঁদের ঘামের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক অদম্য বার্তা— নারী শুধু সংসার গড়েন না, সমাজও গড়েন। তাঁরা তাঁদের কাজের দ্বারাই মনে করিয়ে দেন— নারীশক্তি কেবল ঘরের অন্দরে সীমাবদ্ধ নয়, সমাজ গড়ার ক্ষেত্রেও তিনি সমান অবদান রাখেন। তাঁদের চোখের দৃঢ়তা আর হাতে মাটির ছোঁয়া যেন নতুন ভাষায় বলে দেয়, সৃষ্টির মূলে নারীশক্তি চিরকাল ছিল, আছে এবং থাকবে। আর স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতালের মতো মানবজীবনের প্রতিটি স্তরেই আজ সেই নারীশক্তির উপস্থিতি সমানভাবে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই শিল্পযাত্রা প্রমাণ করে— লিঙ্গভেদ নয়, যোগ্যতাই শিল্পীর আসল পরিচয়।

সহায়ক থেকে স্বনির্ভর : কুমোরটুলির নারীদের মাটির লড়াই
পুরুষসর্বস্ব সমাজে বহুদিন প্রতিমা গড়া ছিল পুরুষদের দখলে। একসময় নারীরা শুধু সহায়ক হিসেবে পুরুষদের কাজে হাত বাড়াতেন, কিন্তু আজ কুমোরটুলির গলিতে নিজেরাই মূর্তির খুঁটিনাটি গড়ে তুলছেন। সংসারের চাপ, রান্নাঘরের ধোঁয়া সামলেও তাঁরা মাটির সঙ্গে লড়াই করছেন নিরন্তর। উৎসব যত ঘনিয়ে আসে, ততই বাড়ে তাঁদের শ্রম আর ঘাম। দেবীর চোখে যেমন থাকে শক্তি ও মাতৃত্ব, তেমনি এই শিল্পীদের চোখেও জ্বলে ওঠে সংগ্রাম আর সৃষ্টির দীপ্তি— প্রমাণ করে, মা শুধু সংসার নয়, সমাজও গড়ে তোলেন। তাঁদের সৃষ্টিশীলতা সমাজের এক অমূল্য অংশ এবং নারীশক্তির প্রকৃত প্রতীক।
মাটির মন্ত্রে নতুন বিপ্লব
কুমোরটুলির নারীদের শিল্পযাত্রা শুরু হয়েছিল সাহসী পথিকৃৎ কামাখ্যাবালা পালের হাত ধরে। আজ তাঁর সেই দেখানো পথে একঝাঁক নতুন নারী শিল্পী মাটি, রঙ আর ঘামে গড়ে তুলছেন নিজেদের স্বপ্ন— যাঁদের মধ্যে আছেন ছ’জন অনন্য শিল্পী, যাঁদের কাহিনি একেকটা সংগ্রামের ইতিহাস। প্রতিটি মূর্তিতে ফুটে ওঠে তাঁদের সংগ্রাম, ধৈর্য ও সৃষ্টিশীলতা; প্রতিটি রেখা যেন বলতে চায়, ‘আমরাও সমাজকে দেখাতে চাই আমাদের স্থান।’

মালা পাল : কুমোরটুলির পথপ্রদর্শক নারী-শিল্পী
কুমোরটুলির নারী-শিল্পীদের মধ্যে প্রথমেই উঠে আসে মালা পালের নাম। মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর দাদার পাশে দাঁড়িয়ে প্রতিমাশিল্পে হাতেখড়ি পান। তখনও সমাজ নারীর হাতে মাটির কাজ মেনে নিতে দ্বিধা করত, কিন্তু দাদার উৎসাহে তিনি ছোট-ছোট প্রতিমা গড়া শিখতে শুরু করেন। ১৯৮৬ সালে দিল্লির হ্যান্ডক্রাফট মিউজিয়াম তাঁর প্রতিভা দেখে ছ’মাসের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়। সেই অভিজ্ঞতা তাঁর দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে আরও সমৃদ্ধ করে এবং শিল্পী হিসেবে আলাদা পরিচয় দেয়। কলকাতায় ফিরে এসে তিনি প্রতিমাশিল্পী হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষিকা হিসেবেও কাজ শুরু করেন। আজ মালা পালের উদ্যোগে কুমোরটুলিতে একটি স্কুল গড়ে উঠেছে। ৬ থেকে ৬০ বছর বয়সি মানুষ সেখানে নিয়মিত মৃৎশিল্প শিখছে। প্রতি রবিবার প্রায় পঞ্চাশ জন শিক্ষার্থী তাঁর কাছ থেকে হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ নেয়। মালা পাল বিশ্বাস করেন— যে সুযোগ একসময় তিনি পাননি, সেই সুযোগ নতুন প্রজন্মকে দেওয়াই তাঁর দায়িত্ব। মালা পাল শুধু একজন শিল্পী নন; তিনি সাহস, সংগ্রাম ও ধৈর্যের প্রতীক। তাঁর কাজ নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করছে এবং সৃজনশীলতার আগুন জ্বালাচ্ছে।
মালা পাল কুমোরটুলির পরিচিত এক মুখ; তিনি বিশেষভাবে খ্যাত ছোট ও ‘ফোল্ডেবল’ মিনিয়েচার দুর্গা তৈরিতে, যেগুলো সহজে ভাঁজ করে পরিবহিত করা যায় এবং প্রবাসী বাঙালিদের পুজোয় পাঠানো হয়— ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ইত্যাদি গন্তব্যে তাঁর মূর্তিগুলো পৌঁছায়। মালা সরকারি ও স্থানীয় স্তরের পুরস্কারও পেয়েছেন এবং বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তাঁর কাজ দেখানো হয়েছে। ছোট মাপের এই মূর্তিগুলো সাধারণ বড় প্রতিমার অনুকরণ নয়; এগুলো নকশা ও উপকরণে হালকা— তাই বিদেশে পাঠানোর খরচ কমে এবং প্রবাসীরা নিজেদের বাড়িতেই সহজে পুজো করতে পারেন। মালা একই সঙ্গে শিক্ষকও— নতুন প্রযুক্তি ও দক্ষতা শিখিয়ে তিনি কুমোরটুলিতে নারীদের অনুপ্রাণিত করেছেন।

আরও পড়ুন-বাবরি মসজিদ নির্মাণ ও অযোধ্যা-রায় নিয়ে চন্দ্রচূড়ের মন্তব্যে বিতর্ক

চায়না পাল : কুমোরটুলিতে নারীর চালনাশক্তি
কলকাতার কুমোরটুলি, যেখানে শতাব্দী ধরে পুরুষশাসিত মৃৎশিল্পের জগৎ চর্চা হয়, সেখানে চায়না পাল নিজস্ব শক্তি ও ধৈর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ১৯৯৪ সালে পিতার অসুস্থতার কারণে দুর্গাপূজার প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব হাতে নেন— এটাই তাঁর শিল্পজীবনের সূচনা। সেই সময় থেকেই তিনি প্রমাণ করেছেন, নারীর হাতেও জীবন্ত প্রতিমা তৈরি করার ক্ষমতা আছে। তাঁর প্রতিমা শুধু মাটির কাজ নয়; এটি যেন অনুভূতি, শ্রম এবং সৃজনশীলতার এক জীবন্ত প্রকাশ। চায়না পাল বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন এবং তাঁর প্রতিমা কলকাতার বাইরে ও দেশের বাইরে প্রদর্শিত হয়েছে। ২০১৮ সালে চিনের কুনমিং শহরে অনুষ্ঠিত শিল্প উৎসবে অংশগ্রহণ তাঁর শিল্পযাত্রার এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। পুরুষশাসিত পরিবেশে নিজের জায়গা তৈরি করে চায়না পাল প্রমাণ করেছেন, নারীর সৃজনশীলতা কোনও বাধা চেনে না।
চায়না পাল ১৯৯০-এর দশকে বাবার অসুস্থতার কারণে পরিবারের স্টুডিও সামলাতে শুরু করেন এবং ধীরে ধীরে নিজের স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। তিনি কেবল প্রচলিত দুর্গা নয়, বরং পরীক্ষামূলক থিম ও সামাজিক বার্তা বহনকারী কাজও করে থাকেন — উদাহরণ হিসেবে তিনি কখনও–কখনও অর্ধনারীশ্বর বা ভিন্নধর্মী আঙ্গিকে প্রতিমা তৈরি করেছেন, যাতে লিঙ্গবৈচিত্র্য ও সমাজচেতনার কথাও উঠে আসে। তাঁর স্টুডিওতে একসময় কয়েকজন সহকর্মী/শ্রমিক থাকত এবং তিনি তরুণ নারীশিল্পীদের কাজে যুক্ত করে রেখেছেন। চায়না পালের যাত্রা কুমোরটুলির পুরুষ-প্রাধান্য ভেঙে নারীদের মাটির শিল্পে প্রতিষ্ঠার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
বৃষ্টিতেও আলোকিত শিল্প : কাকলি পালের সংগ্রামী যাত্রা
‘সংসারের ফাঁকে, প্রতিমার প্রতিটি ছোঁয়ায় আমি আমার গল্প বলি।’
কাকলি পাল শুধু একজন শিল্পী নন; তিনি মা, গৃহিণী এবং সমাজচেতনা সম্পন্ন নারী। সংসারের নানা দায়িত্বের মাঝেও প্রতিদিন নিঃশব্দে নিজের প্রতিভা দিয়ে কুমোরটুলির প্রতিমাকে জীবন্ত করে তোলেন। প্রতিমা তৈরির প্রতিটি ধাপে— রঙ, কাঠামো ও কাঠামোগঠন— নারীর সংগ্রাম, শক্তি এবং সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টি বা বাধা আমার কাজকে থামাতে পারে না।’ প্রতিটি ছোঁয়ায় তাঁর শিল্প শুধুমাত্র চোখের আনন্দ দেয় না, বরং নারীর শক্তি ও সংগ্রামের গল্পও বলে। কাকলির মতো শিল্পীরা আমাদের শেখান, বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও নারীরা সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে। তাঁর কাজ শুধু শিল্প নয়, নারীর ক্ষমতায়ন ও সমাধিকার প্রতিষ্ঠার বার্তাও বহন করে।
২০০৩ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর বাধ্য হয়েই প্রতিমাশিল্পে নামেন কাকলি পাল। শুরুতে শিল্প নয়, জীবিকার পথ হিসেবে মাটি ধরলেও আজ তিনি কুমোরটুলির এক পরিচিত মুখ। পুরুষ-প্রধান সমাজের সন্দেহ ও প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে তিনি ধীরে ধীরে নিজের হাত পাকিয়েছেন প্রতিমায়। এখন তাঁর তৈরি দেবীমূর্তি শুধু স্থানীয় নয়, কুমোরটুলির বাইরেও বিক্রি হচ্ছে— যা কাকলির দৃঢ়তা আর সংগ্রামী জীবনযাপনের সাক্ষ্য বহন করে।
শুভ্রা পালের সূক্ষ্ম শিল্প
‘প্রতিমার সৌন্দর্য কেবল রং বা কাঠামোতে সীমাবদ্ধ নয়, প্রতিটি অলঙ্কারই তাকে জীবন দেয়।’
কুমোরটুলির ব্যস্ত গলিপথে লুকিয়ে আছে শুভ্রা পালের শিল্পজগৎ। তিনি মাটির মূর্তিতে সূক্ষ্ম অলঙ্করণ ও হাতের কারুকার্যের জন্য পরিচিত। প্রতিমার মুখ, পোশাক ও গহনার প্রতিটি খুঁটিনাটি কাজ তিনি হাতে গড়ে তোলেন। তিনি বলেন, ‘মুকুট, হস্তকার্য বা শোলার কাজ— প্রতিটি ছোঁয়া প্রতিমাকে জীবন্ত করে তোলে।’ প্রতিমার এই সূক্ষ্ম অলঙ্করণে তিনি যোগ করেন রাজকীয় ঔজ্জ্বল্য। শুভ্রা বড় মূর্তির কাজের পাশেই এই সূক্ষ্ম অলঙ্করণ করেন। সংসারের দায়িত্ব সামলে তিনি নিজের অস্তিত্ব ও শিল্পী পরিচয়কে প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিটি ছোঁয়ায় তিনি লুকিয়ে রাখেন কুমোরটুলির ঐতিহ্য ও নতুনত্বের মিলন। শিল্পীর নিঃশব্দ সংগ্রাম ও সূক্ষ্ম প্রতিভা প্রতিমাকে দেয় এক অনন্য রূপ।

আরও পড়ুন-ওয়ার্লির শৈলী, প্রাচীন গুহাচিত্রের ঝলক খিদিরপুর ২৫ পল্লিতে

কৃষ্ণা পালের সংগ্রাম ও সাফল্য
‘প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুটো পর্যন্ত শিল্পের সঙ্গে সংসার— এটাই আমার শক্তি।’
কৃষ্ণা পাল একজন মৃৎশিল্পী, যিনি মূলত মাকে সাজানো, সোলার কাজ ও প্রতিমার সূক্ষ্ম অলঙ্করণ করেন। নিজের স্টুডিও না থাকলেও তিনি কুমোরটুলির একজন শিল্পীর স্টুডিওতে কাজ করেন। প্রতিমার মুখ, পোশাক ও অলঙ্কার সবই তার নিখুঁত হাতে গড়ে ওঠে।
তিনি জানান, এই কাজের মধ্যেই আমি সংসার সামলাই, আর এটাই আমাকে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করেছে। প্রতিদিন সকালে স্টুডিওতে এসে দুপুরে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে আবার সংসারের দায়িত্ব সামলান। এই শিল্পচর্চার মাধ্যমে তিনি নিজের অস্তিত্ব ও পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করেছেন। কৃষ্ণা পালের প্রতিটি ছোঁয়ায় লুকিয়ে আছে শ্রম, ধৈর্য ও নারীর সংগ্রামের গল্প।
নারী তুমি অনন্যা
পুরুষ-প্রাধান্য সমাজে কুমোরটুলির মৃৎশিল্প কখনওই নারীদের জন্য সহজ ছিল না। বহু যুগ ধরে মাটির শিল্প, প্রতিমা গড়া এবং খুঁটিনাটি শিল্পে নারীরা কেবল সহকারী হিসেবে কাজ করতেন, পুরুষ শিল্পীদের হাত ধরে। তবুও সাহসী নারীরা এই বাঁধন ভেঙে নিজস্ব পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন। মালা পাল, শুভ্রা পাল, সুচন্দ্রিমা পাল, কৃষ্ণা পাল, চায়না পাল এবং অন্যান্য অগণিত নারী-শিল্পী আজ নিজেদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন, যে দক্ষতা, ধৈর্য ও সৃজনশীলতা কোনও লিঙ্গের বন্ধনে আবদ্ধ নয়। শারীরিক অসুবিধা, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এঁরা কখনও হাল ছাড়েননি। প্রতিটি নারী শিল্পীর সংগ্রাম আমাদের দেখায়, যে শিল্পের আসল সৌন্দর্য এবং শক্তি আসে সাহস, নিষ্ঠা ও ধৈর্যের সমন্বয়ে। তাঁদের প্রতিটি প্রতিমা শুধু মাটির নয়, বরং তাঁদের আত্মার ছোঁয়া, তাঁদের স্বপ্ন ও সংগ্রামের গল্প।
কুমোরটুলির মৃৎশিল্পে নারী-শিল্পীরা নিঃসন্দেহে একটি অভিন্ন দৃঢ়তার প্রতীক। তাঁরা প্রমাণ করেছেন যে, কোনও শারীরিক সীমাবদ্ধতা, সামাজিক বাঁধন বা পুরুষ-প্রাধান্যই সৃজনশীলতাকে আটকাতে পারে না। যেমন একটি প্রবাদ বলে— ‘সাহসী নারীর পা যেখানে পড়ে, সেখানে পথ সৃষ্টি হয়।’ কুমোরটুলির নারীরা সেই পথপ্রদর্শক, যাঁদের হাতে মাটি হয়ে উঠেছে জীবনের গল্প, স্বপ্নের প্রতিমা এবং স্বাধীনতার প্রতীক।
এভাবে কুমোরটুলির নারী-শিল্পীরা শুধু শিল্প জগতে নয়, সমাজে নারীর সম্ভাবনার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এঁরা আমাদের মনে করিয়ে দেন— ‘যে লড়াই করে, সে জেতেই’ এবং প্রতিটি নারী স্বপ্ন দেখতে পারেন, চেষ্টা করতে পারেন, আর তাঁর স্বপ্ন বাস্তব করতে পারেন। কুমোরটুলির নারীদের সংগ্রাম ও সাফল্য আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা। তাই মায়ের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিমার আড়ালে থাকা এই প্রতিমাদেরও সমাজ জানায় কুর্নিশ।
আজ কুমোরটুলির সরু গলিতে নারীদের সৃজনশীল শক্তি যেন মায়ের শক্তিকে অনুকরণ করে— যেখানে প্রতিটি হাতের ছোঁয়া হয়ে ওঠে শৈল্পিক পুজো, আর প্রতিটি মূর্তিতে প্রতিফলিত হয় নারীর অদম্য ক্ষমতা। এই গলিতে আজ নারী শিল্পীরা রাজত্ব করছেন, স্বপ্ন ও সৃষ্টির পতাকা হাতে, আর মাটির প্রতিমা হয়ে উঠেছে তাঁদের জীবনের প্রতিচ্ছবি।

Latest article