কারোর সর্বনাশ, তো কারার পৌষমাস। —বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া এই আপ্তবাক্য আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে উৎসবমুখর এই বাংলার শারদীয়ার মরশুমে। প্রকৃতি সর্বশক্তিমান। মানুষ তার সামনে পরাভূত হয়েছে বারংবার। কিন্তু প্রকৃতির রোষানলে পর্যদুস্ত হওয়ার পরও জেদ, প্রত্যয়, পরিশ্রম ও মানবসেবার সংকল্প নিয়ে ফিনিক্স পাখির মতো যারা ঘুরে দাঁড়ায়, তারাই প্রকৃত যোদ্ধা। বিদ্রুপের শাণিত বাণকে দৃঢ় পায়ে মাড়িয়ে যারা সুরক্ষার ইমারত গড়তে পারে, ইতিহাস গল্প বলে তাদেরই। অপরদিকে ব্যঙ্গের সিঁড়ি ধরে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা খুঁতধরা বুড়োরা জনমননে অবলুপ্ত হতে হতে কখন যে পৌঁছে যায় মহাশূন্যে, বুঝে উঠতে পারে না তারা নিজেরাও।
আরও পড়ুন-পাঁচদিনের পুজোর সাজে
গত তেইশে সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে কল্লোলিনী কলকাতা প্রত্যক্ষ করেছে তার ইতিহাসের অন্যতম আকস্মিক প্রাকৃতিক মহাবিপর্যয়কে। মাত্র ছয় ঘণ্টায় আড়াইশো মিলিমিটার বৃষ্টি! তাও আবার মধ্যরাতে! মেঘভাঙা বর্ষণে অভ্যস্ত উত্তরাখণ্ডের পার্বত্য অঞ্চলেই যেখানে এমন দুর্যোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের পরিকাঠামো অমিল, সেখানে অনভ্যস্ত গাঙ্গেয় উপত্যকা তো কোন ছার! শুধুমাত্র উন্নয়ন ও তৎপরতা দিয়েই যদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে বশীভূত করা যেত, তাহলে বিশ্বের প্রযুক্তি ও কারিগরিবিদ্যার অন্যতম আঁতুড়ঘর জাপান ২০১১-এর ভূমিকম্পে ধূলিসাৎ হয়ে যেত না। কিন্তু সাম্প্রতিককালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব ও আন্তরিকতায় পশ্চিমবঙ্গকে আমরা ধ্বংসস্তূপের ওপরেই ঘুরে দাঁড়াতে দেখেছি বারংবার। আমফানের ঘটনা আমাদের স্মৃতিতে টাটকা এখনও। করোনাকালীন পরিস্থিতির মধ্যেই সুপার সাইক্লোনে কার্যত তছনছ হয়ে গেছিল গোটা বাংলা। ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষয়ক্ষতিকে সামাল দিয়ে আবারও স্বমহিমায় ফিরে এসেছে বাংলার অর্থনীতি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে রুখে দেওয়া মানুষের সাধ্যের বাইরে হলেও দুর্যোগ-পরবর্তী ছন্নছাড়া ধ্বংসস্তূপে সৃষ্টির চারাগাছ লালনের মধ্যে দিয়েই পরীক্ষিত হয় ক্ষমতাসীন সরকারের কার্যকারিতা আর সেখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরোপুরি সফল।
রাজনীতির লাল-গেরুয়া চশমা খুলে যুক্তির মন্থনে যে প্রকৃত সত্য উঠে আসে, তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বৃষ্টির গড় হিসাব করা হয় SRRG (Self-Recording Rain Gauge) বা অটোমেটিক রেইন গেজ থেকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় (Hourly) ডেটা নিয়ে । প্রতিটি ঘণ্টার মোট বৃষ্টিপাত (মিমি/ঘণ্টা) যোগ করে দিনের, মাসের বা মৌসুমের গড় Hourly Rainfall বের করি আমরা। গড় = (মোট বৃষ্টিপাত ÷ ঘন্টার সংখ্যা)। শহরের নিকাশি ব্যবস্থার নকশা করা হয় শুধুই গড় বৃষ্টিপাতের হিসেব করে নয়। সাধারণত Return Period Rainfall ব্যবহার করে । যেমন— ‘১০ বছরে একবার’ বা ‘২৫ বছরে একবার’ যে ধরনের ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টি হয়, সেটাকে মাথায় রেখেই। যেমন , কলকাতার মতো শহরের নিরিখে ২৫ মিমি/ঘণ্টা বৃষ্টি আয়ত্তের বাইরে থাকা High-Intensity Rainfall। কাজেই এবার ধরুন ঘণ্টায় ৭০ থেকে ৮০ মিমি এর বেশি বৃষ্টি হচ্ছে , তাহলে গ্রিক গড পোসেইডন এলেও ড্রেনেজ সিস্টেম ভেঙে পড়া আটকাতে পারবেন না। ভারতীয় শহরে সাধারণত আধুনিক নিকাশি ব্যবস্থার নকশা করা হয় ২৫ মিমি/ঘণ্টা থেকে ৫০ মিমি/ঘণ্টা বৃষ্টির জন্য। প্রযুক্তির দিক থেকে খুব উন্নত দেশগুলিতে সেটা হয় ৭৫–১০০ মিমি/ঘণ্টা পর্যন্ত। কাজেই কলকাতার মত শহরে ৫০ মিমি/ঘণ্টা এই হারে ২–৩ ঘণ্টার বৃষ্টিপাত মানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ারই কথা। অপরদিকে, কলকাতার মতন ঘিঞ্জি শহরে সমস্ত ড্রেনেজ আর সুয়েজ ব্যবস্থাকে রাতারাতি বদলে ফেলে পুনর্নবীকরণ করতে গেলে জনজীবন স্তব্ধ রাখতে হবে বহুদিন। যার দোষ এসে পড়বে সরকারের ঘাড়েই। সাথে প্লাস্টিক আর পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও জনগণকে ভুল বুঝিয়ে রাজ্যকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে পিছ-পা হয় না অবিবেচক বিরোধীরা।
আরও পড়ুন-দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে এবার বিশেষ আকর্ষণ রাজস্থানের সোনার কেল্লা
বাম আমল থেকেই কলকাতায় বিদ্যুৎ পরিষেবার দায়িত্ব একটি বেসরকারি সংস্থার হাতে এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণজনিত গাফিলতিতেই বৃষ্টি পরবর্তী কলকাতায় গত মঙ্গলবার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছে কয়েকজন মানুষের। সেই সংস্থাকে কড়া বার্তাও দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের তরফে। কিন্তু ডাবল ইঞ্জিন সরকারের পূজারী বিজেপি এটা ভুলে গেছে যে কোনওরকম মেঘভাঙা বৃষ্টি ছাড়াই সামান্য রাস্তার জমা জলে গত পরশু বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে উত্তরপ্রদেশের বেলিয়ার দুই কিশোরী বোনকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই ঘটনা নিয়ে কিন্তু কোনও রক্তের রাজনীতি করেনি, উপরন্তু ওই দুই বোনের সুস্থতা কামনা করেছে মা দুর্গার কাছে। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনদিনে মাত্র ১৬৭ মিলিমিটার বৃষ্টিতেই মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের আমলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে এই কলকাতাতেই মারা গিয়েছিলেন ১৫ জন। জল জমার ইতিহাস ঘাঁটতে গেলেই মাথায় আসে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বর্ষার দমদম নিয়ে লেখা সেই বিখ্যাত কবিতা —
“রিক্সা ডুবেছে আর ট্যাক্সি অচল
রাস্তায় দাঁড়িয়েছে এক গলা জল।
চাকাওলা যাবতীয় বাহন বেকার,
এমন কি ভ্যাবাচ্যাকা ডাবল ডেকার।
কলকল খলখল জল ছুটে যায়
শ্যামবাজারের থেকে ধর্মতলায়।
এই নাকি কলকাতা? আরে দূর দূর!
এযে দেখি সুতানূটি গোবিন্দপুর।”
পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে ছোট বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় আমরা আগেও দেখেছি। কিন্তু ফিরহাদ হাকিমের মতো করে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে কোনও দিন হাঁটু জলে হাফপ্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে দমকল কর্মীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শহরবাসীর পরিত্রাণের চেষ্টা করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। স্মৃতির সরণি ধরে চিরুনি তল্লাশি চালালেও স্বর্গীয় জ্যোতি বসু কিংবা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ধুতি কলকাতার জমা জলে ভেজার কথা মনে পড়ে না কিছুতেই। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যতিক্রমী, ব্যতিক্রমী তার সহমর্মিতা। মানুষের সুখ-দুঃখ ভাগ করে দেওয়ার মধ্যে দিয়েই তিনি হয়ে উঠেছেন এই বাংলার ঘরের মেয়ে। বিপর্যয় আগেও এসেছে,ভবিষ্যতেও আসবে। কিন্তু এই বাংলার বিরোধীরা আজ তৃণমূলকে ফাঁদে ফেলতে গিয়ে কোথাও যেন দুর্যোগকামী হয়ে উঠেছেন। বাংলার অমঙ্গলের আরাধনা চলছে বিরোধী দলগুলির সদর দফতরে। গঠনাত্মক বিরোধিতা ভুলে আজ তারা মেতেছে মানবিকতার ধ্বংসলীলায়। তাই রামমোহন সম্মিলনীর কুণাল ঘোষের মতো করে কোনও বাম নেতাকে দেখা যায়নি টানা বারোঘণ্টা জলের মধ্যে বসে থেকে এলাকার সাধারণ মানুষ ছাড়াও বাইরে থেকে আসা মণ্ডপশিল্পীদের খাবার জোগানের তত্ত্বাবধান করতে। বাংলা তথা বাঙালির ঘোর বিরোধী বিজেপির বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের রাজনৈতিক ফায়দা লুঠতে ব্যঙ্গ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুজো উদ্বোধনের সময়কালকে। শাস্ত্রমতে, পুজো শুরু করতে পারেন কেবলমাত্র পুরোহিত। কাজেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুজো নয়, মণ্ডপের উদ্বোধন করেন। এছাড়াও ষষ্ঠীর আগেই তৃতীয়াতে মুর্শিদাবাদের লালবাগে নিজেই পুজো উদ্বোধন করে এসেছেন হিপোক্রিট হাম্পিং ডাম্পিং অধিকারী। আর বাঙালি উমাকে মনে করে নিজেদের ঘরের মেয়ে। এই বাংলার পুজোয় প্রাধান্য পায় হৃদ্যতা। মেয়েটাকে দু-দিন আগে বাপের ঘরে আনতে বাংলা সমস্ত মায়েরাই অশ্রুসজল চোখে চেয়ে থাকে। অবশ্য এ আবেগ বঙ্গবিরোধী বিজেপির অনুধাবনের বাইরে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে পুজোর পুতুল বিক্রেতা, এগরোলের দোকানদার, খেলনা বিক্রেতা, ঘুগনি মাসি, দোলনা কাকু সর্বোপরি মৃৎশিল্পীদের চোখের জল ও বৃষ্টিকে এক পাল্লায় মেপে ফেলেছে রাজনৈতিক চিল-শকুনকুল।
কিন্তু মা যে সর্বজ্ঞ। এই বাংলাকে বাঁচাতে আরেক মায়ের সংকল্প ও আত্মত্যাগ তার দৃষ্টি এড়ায় না। কলকাতার বেশিরভাগ অঞ্চল থেকেই দশঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যেই তাই বৃষ্টির জমা জল নামানো সম্ভব হয়েছে। আজ কলকাতার রাজপথ স্বাভাবিক। আসলে বাংলার মমতাময়ী মা আন্তরিক, তাই বিশ্বজননী মহামায়া দু-হাত ভরা আশীর্বাদ নিয়ে সবসময় তাঁর পাশে আছেন।