এগিয়ে বাংলা, লজিস্টিকেও নতুন দিগন্ত

দুর্গাপুজো মানে শুধু অসুরনাশিনীর আরাধনা নয়, সম্পদ দায়িনীর কাছে প্রার্থনাও বটে। সেই আবহে লজিস্টিক বা স্থানান্তরবিদ্যাও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। পণ্য, পরিষেবা ও সংশ্লিষ্ট তথ্যের পরিকল্পনা, কার্যকরীকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ— এই চতুর্বিদ্যার বাস্তুতন্ত্রই হল লজিস্টিক। সেই প্রকৌশলের পরিধিতেও এগিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গ। আসন্ন উৎসবের প্রতিবেশে এমন তাৎপর্যপূর্ণ সুসংবাদ দিচ্ছেন বারাসত কলেজের বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষক ড. রূপক কর্মকার

Must read

বর্তমান সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের নানান দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে। আর সেইসব দিগন্তের সাফল্য অনেকগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে, লজিস্টিক সাপোর্ট তার মধ্যে অন্যতম। লজিস্টিক সাপোর্ট হল সরবরাহ শৃঙ্খলের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়, যেখানে পণ্য ও পরিষেবা প্রবাহকে নিশ্চিত করা হয়। বিশ্বায়ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমবর্ধমান জটিল সরবরাহের শৃঙ্খল তৈরি করেছে। প্রযুক্তির উত্থানে কিন্তু লজিস্টিক প্রক্রিয়ায় ব্যবহার আরও বেশি করে হচ্ছে।
লজিস্টিক অনেকগুলি পর্যায় নিয়ে তৈরি হয় যেমন, ইনবাউন্ড লজিস্টিক অর্থাৎ সরবরাহকারীদের কাছ থেকে বিভিন্ন তথ্য এবং পণ্যের চলাচল পরিবহণ এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে গুদামে প্রেরণ করা হয় এবং তারপর তাকে প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং উৎপাদনের জন্য উৎপাদন সুবিধাস্থানগুলিতে স্থানান্তরিত করা হয়। তারপর আউটবাউন্ড লজিস্টিক যা পণ্যগুলি গুদাম থেকে ভোগস্থলে বা গ্রাহকদের কাছে স্থানান্তরিত করার পদ্ধতি। আর রিভার্স লজিস্টিক হল সংস্কার, মেরামত, বিনিময়, নিষ্পত্তি বা পুনঃ ব্যবহারের জন্য পণ্য প্রতিস্থাপন বা ফেরত দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এছাড়াও ৩ পিএল লজিস্টিক বা ৪ পিএল লজিস্টিকও বর্তমান। এই লজিস্টিক ব্যবস্থা পুরোটাই উন্নত করিডর ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। করিডরগুলো, যেমন ডেডিকেটেড মালবাহী করিডোর (Dedicated Freight Corridor) বা অর্থনৈতিক করিডোর (Economic Corridor) পণ্য পরিবহণের জন্য নির্দিষ্ট পথ তৈরি করে। এর ফলে যানজট কমে, পরিবহণ-প্রক্রিয়া দ্রুত হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করা সহজ হয়।
বিশেষ করে ই-কমার্স সেক্টরে নিরাপদে এবং সাশ্রয়ভাবে পণ্যের চলাচলে কিন্তু ব্যবসার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। গুদামজাতকরণ, পরিবহণ ব্যবস্থাপনা, চাহিদা পরিকল্পনা, অর্ডার পূরণ প্রভৃতি প্রত্যেকটি পর্যায় লজিস্টিকের উপরই নির্ভরশীল। সেখানে লজিস্টিক ব্যবস্থাকে যদি গুরুত্ব দেওয়া না হয় তবে বাণিজ্যের প্রসারও সম্ভব নয় সেটাও স্বাভাবিক। ২০২২-’২৩ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতবর্ষে জিডিপি খরচের প্রায় ১৪ থেকে ১৮ শতাংশ খরচ এই লজিস্টিক সিস্টেমের মাধ্যমে হয়ে থাকে। যদিও আন্তর্জাতিক স্তরে এই খরচের পরিমাণ ৮ শতাংশের কিছু বেশি।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ-বিষয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রদেয় বাজেটের তথ্য বলছে, ওয়েস্টবেঙ্গল লজিস্টিক পলিসি (WBLP) ২০২৩-এর অধীনে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সহায়তাপ্রাপ্ত প্রস্তাবিত ওয়েস্ট বেঙ্গল বুস্টিং লজিস্টিক এফিসিয়েন্সি (WBBLE) এবং ট্রেড ফেসিলিয়েশন (TF) প্রকল্পটি ডিপার্টমেন্ট অফ এক্সপেন্ডিচার, মিনিস্ট্রি অফ ফিনান্স (GOI)-এ দাখিল করা হয়েছে। এই প্রকল্পে মোট ২০৭২.৬৭ কোটি টাকা ধার্য হয়েছে। যার মধ্যে ১২৪৩.৬১ কোটি টাকা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া হবে এবং রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ৮২৯.০৭ কোটি টাকা প্রদান করা হবে।
দুটি প্রকল্পের জন্যই উল্লেখিত মিনিস্ট্রি (GOI)-র অনুমোদন প্রতীক্ষিত। এমনকী এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (ADB) এবং কোরিয়া এক্সিম ব্যাংক (KEXIM)-এর আর্থিক এবং প্রযুক্তিগত সহায়তায় রঘুনাথপুর-তাজপুর, ডানকুনি-ঝাড়গ্রাম, ডানকুনি-কল্যাণী, ডানকুনি-কোচবিহার, খড়্গপুর-মোড়গ্রাম এবং গুরুন্ডি, পুরুলিয়া-জোকা, কলকাতাতে ছটি রাজ্যব্যাপী শিল্প এবং অর্থনৈতিক করিডর স্থাপন করা হচ্ছে। রাজ্যের কৌশলগত ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধার জন্য এই পরিকল্পনা দক্ষ লজিস্টিক-এর উন্নয়নের জন্য আরও লগ্নিতে সাহায্য করবে। চারটি করিডরের জন্য প্রাথমিক প্রকল্পব্যয় প্রায় ৪৪০০ কোটি টাকা। অমৃতসর থেকে ডানকুনি পর্যন্ত ইস্টার্ন ফ্রেড করিডর নির্মাণের স্বার্থে রঘুনাথপুর-পুরুলিয়ার ২৪৮৩ একর জমিতে শিল্পের জন্য জমি বরাদ্দ-সহ ৭২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে ‘জঙ্গল সুন্দরী কর্মনগরী’ নির্মাণ করতে রাজ্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে।
কয়েকদিন আগেই রাজ্য সরকার তাজপুর-ডানকুনি রঘুনাথপুর আর্থিক করিডর তৈরির জন্য পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমকে প্রায় ২০০ একর জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটি সঠিক লজিস্টিক ব্যবস্থা পণ্য ও তথ্যের মসৃণ প্রবাহ নিশ্চিত করে শুধু নয়, খরচ হ্রাস করে, দক্ষতা বৃদ্ধি করে, গ্রাহক সন্তুষ্টি বাড়ায়, সরবরাহ শৃঙ্খলে স্বচ্ছতা আনে এবং ব্যবসায়ের লাভ আরও বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
বর্তমান সময়ে কোনও রাজ্যের সরকার যখন লজিস্টিককে শিল্পের চেহারা দেয় তবে সেই সরকারের দূরদর্শিতা কতটা তার প্রমাণ পাওয়া যায়। লজিস্টিককে যে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা পশ্চিমবঙ্গ সরকার করে দেখিয়েছে। লজিস্টিককে শিল্পের তকমা দেওয়ায় পরিকাঠামোগত উন্নয়ন, কর ছাড় এবং প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান করবে, যার ফলে নতুন বিনিয়োগ আসবে ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। লজিস্টিক পার্ক নির্মাণ, জমি রূপান্তর এবং একটি নিবেদিত লজিস্টিক সেল গঠনের মাধ্যমে রাজ্য সরকার এই খাতের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে তা রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্তেই পরিষ্কার। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পদক্ষেপ যে আগামী দিনে অন্যান্য রাজ্যকেও পথ দেখাবে তা সহজেই অনুমেয়। লজিস্টিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার অর্থ রাজ্যের পণ্য পরিবহণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা। এর ফলে ই-কমার্স ও পরিবহণ ক্ষেত্রে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করবে শুধু নয়, ব্যবসা ও বাণিজ্যক্ষেত্রেও যুগান্তকারী বিপ্লব আনবে।

আরও পড়ুন-ঝলমলে সপ্তমী-অষ্টমী, নবমী থেকে ভারী বৃষ্টি

Latest article