বারোয়ারি পুজোর একটা মজা আছে। স্থানিক সর্বজনীনতা ঝেড়ে বাড়তে বাড়তে সে পুজো যে কখন দেশের আত্মার সঙ্গে জুড়ে যায়, জাতীয় বোধের সঙ্গে অন্বয় ঘটে তার, টেরই পাওয়া যায় না।
এরকমটাই ঘটেছিল বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গাপুজোয়।
বিশাল প্রতিমা, বিরাট মুকুট। একচালার ঠাকুরের রাজকীয়তা। এই ঠাকুর না দেখলে কলকাতার মন ভরে না। এটুকু জানা কিংবা বলায় বাগবাজার সর্বজনীন নিয়ে সব কথা বলা হয়ে যায় না। উত্তর কলকাতার গঙ্গাপাড়ের একটা পুজো কী করে বঙ্গজীবনস্মৃতি ও সত্তার অংশ হয়ে উঠল, সে কথা আলোচিত, পুনরালোচিত, পুনঃ পুনঃ বিবৃত না হলে, বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব বুঝি অনালোকিত থেকে যায়।
বিশ শতক-শুরুর উত্তর কলকাতা। তখন দুর্গাপূজা করতেন মূলত পয়সাওয়ালা ‘বাবু’রা। সে ছিল যত না পূজা, তারও বেশি টাকার গরম আর আভিজাত্যের গুমোর দেখানোর উৎসব। পুজোর ক’টা দিন ধনীর ঘরে গরিব মানুষকে খাওয়ানোয় যত না সেবার মিষ্টি, তার চেয়ে ঢের বেশি অহমিকা আর হামবড়াইয়ের ঝাল। এমনই এক বাবুর পুজোয় একবার অপমানিত হয়ে প্রসাদ না পেয়েই ফিরে গিয়েছিলেন এলাকার কিছু মানুষ। তার পরেই ঠিক হয়, সবাই মিলে দুর্গাপুজো করবেন, যেখানে উঁচু-নিচু ভেদ থাকবে না। ১৯১৮ সালে এই সিদ্ধান্ত, ১৯১৯-এই শুরু হল পুজো; কাছেই নেবুবাগানে। স্থান-নাম অনুযায়ী পুজোর নাম হল ‘নেবুবাগান বারোয়ারী’। ১৯২৬-এ এই ‘নেবুবাগান বারোয়ারী’ই নাম পাল্টে হল ‘বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গোৎসব’।
আরও পড়ুন-শিবিরে সুনীল, মাস্ক পরে খেলবেন সন্দেশ
১৯৩০-এ সলিসিটর দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে হয় পুজোর রেজিস্ট্রেশন। দুর্গাপুজোর সঙ্গে ‘প্রদর্শনী’ চালু করার ক্ষেত্রেও তাঁরই ভূমিকা। তখন শিল্পে স্বদেশি জোয়ার, দেশজ শিল্পের উন্নতিকল্পে বিবিধ প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দুর্গাচরণ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ যাঁকে বলতেন ‘মুকুটহীন রাজা’। আজকের পুজো-লাগোয়া মেল আসলে স্বদেশি শিল্প প্রদর্শনীরই রূপান্তর। সেদিন থেকে বাগবাজারের মাতৃ-আরাধনা আধ্যাত্ম বোধের সঙ্গে দেশাত্মবোধ-মেশানো কর্মযোগের উদযাপন।
কত যে বড় বড় মানুষের নাম জড়িয়ে বাগবাজারের পুজোর সঙ্গে! চিত্তরঞ্জন দাশ তখন কলকাতার মেয়র, তাঁরই সহায়তায় পাওয়া গেল কর্পোরেশনের মেটাল ইয়ার্ড, পুজোর আগে-পরে মিলিয়ে ৩০-৪০ দিনের জন্য। সেই থেকে সেখানেই পুজো চলেছে। পুজোর সভাপতি-তালিকায় শুরুতেই দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সভাপতি ছিলেন ১৯৩০-৩৩। দু’দফায় সভাপতি ছিলেন স্যর হরিশঙ্কর পাল, প্রেসিডেন্সি কলেজের এই ছাত্রটি বাবা বটকৃষ্ণ পালের ওষুধের ব্যবসা সামলেছেন, তিরিশ না পেরোতে ইউরোপ গিয়েছেন, টানা ২৪ বছর কলকাতা কর্পোরেশনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৪০-৪২ সভাপতি কুমার বিশ্বনাথ রায়, দেশব্রতী, শিক্ষা ও খেলাধুলোর উন্নতিতে অকুণ্ঠ দাতা, তদুপরি সাংবাদিক-সম্পাদক। সবচেয়ে জ্বলজ্বলে নাম সুভাষচন্দ্র বসু— ১৯৩৮-৩৯ সালে বাগবাজারের পুজোর সভাপতি ছিলেন। ১৯৩৮-এর প্রদর্শনীতে সার্টিফিকেট অব মেরিট পেয়েছিল ‘ক্যালকাটা কলাপসিবল গেট কোম্পানি লিমিটেড’, সুভাষচন্দ্রের সই-করা সেই শংসাপত্রের কপি আজও সযত্নে রাখা আছে পুজোকর্তাদের কাছে। এই বাগবাজার থেকেই আধুনিক রসগোল্লার যাত্রা শুরু, রসগোল্লার দুই প্রাণপুরুষ, নবীনচন্দ্র ও কৃষ্ণচন্দ্র দাশের সুযোগ্য উত্তরসূরি সারদাচরণ দাশ পুজোর সভাপতি ছিলেন ১৯৬১-৬৫।
অষ্টমীর দিনটা বাগবাজারের পুজোয় ‘বীরাষ্টমী’। এই বীরাষ্টমী যত না শাস্ত্রবিহিত, তারও বেশি জাতীয়তাবোধ আর দেশপ্রেমের গন্ধমাখা। স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে স্বদেশি হাওয়ায় অষ্টমীর সকালে এই পুজোর মাঠে লাঠিখেলা, ছুরি খেলা, কুস্তির মতো দেশজ খেলা হত। সাহেবরাই শক্তিমান, বাঙালি ভীরু, দুর্বল, এই বিশ্বাস ভাঙতেই বীরাষ্টমীর উদযাপন। বীরাষ্টমীর দিন জনতার ভিড়ে মিশে যেতেন অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী সদস্যরাও। জনসংযোগের এমন সুযোগ হারাতে চাইতেন না তাঁরা।’’
এই পুজোর ‘উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি’ তালিকাও জাতীয়তাবাদের তারায় তারায় খচিত। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। পুজোর সমাপ্তি অনুষ্ঠানেও নানান বছরে সভাপতিত্ব করেছেন সুভাষচন্দ্র বসু থেকে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। সবাই জাতীয়তাবাদী, ব্রিটিশ বিরোধী মুক্তি আন্দোলনের সৈনিক, পরোক্ষ ভাবে নয়, প্রত্যক্ষ কার্যক্রমের সূত্রেই।
শুধু তাই কলকাতার বারোয়ারি পুজোর সাবেকিয়ানা নয়, ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বিপ্লবের আঁতুড়ঘরও বাগবাজার সর্বজনীন।
একই কথা প্রযোজ্য সিমলা ব্যায়াম সমিতির পুজোর সম্পর্কেও। সিমলা ব্যায়াম সমিতির দুর্গাপুজো আসলে স্বামী বিবেকানন্দের পাড়ার পুজো।
১৯২৬ সালে সর্বসাধারণের জন্য দুর্গাপুজোর সূচনা করেছিলেন বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসু সিমলা ব্যায়াম সমিতির মাঠে। স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ির এলাকায়।
সিমলা ব্যায়াম সমিতির হাত ধরেই প্রথম এ শহরে প্রচলন হয় সর্বজনীন পুজোর। এই ক্লাবটি ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ঘাঁটি। এখনে শরীরচর্চা, লাঠি খেলা, ছুরি খেলা ইত্যাদির অনুশীলন করতেন বিপ্লবীরা।
১৯২৬-এর ২ এপ্রিল ‘বীরাষ্টমী’ উৎসব উপলক্ষে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যায়াম সমিতি। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে পিতা অতীন্দ্রনাথ ও পুত্র অমর বসু একসঙ্গে পাঁচ বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য।
এখানে বলা দরকার, অতীন্দ্রনাথ বসুদের নিজেদের বাড়িতেও দুর্গোৎসব পালিত হত মহাসমারোহে। কিন্তু নিমন্ত্রিত ছাড়া কারওর অধিকার ছিল না বাড়ির পুজোয় প্রবেশ করার। সেই বিধিনিষেধ ভাঙার জন্যই অতীন্দ্রনাথ নিয়ে আসেন সর্বজনীন পুজোর পরিকল্পনা। যাতে জাত-ধর্মের পরোয়া না করে, আর্থিক বৈষম্যকে অস্বীকার করে সর্বস্তরের মানুষ একত্রিত হতে পারে শারদীয় পুজোর আয়োজনে। পাশাপাশি আর একটা কারণ।
স্বাধীনতা সংগ্রাম তখন তুঙ্গে। বাংলার যুবক-যুবতী শক্তিমন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছে ব্রিটিশ সিংহের বিরুদ্ধে। অসুরদলনী মা দুর্গা যেন হয়ে উঠলেন স্বাধীনতাকামী মানুষের স্পর্ধার মূর্তরূপ। প্রথম বছরের পুজোতে সেই চেতনাকে বাস্তব চেহারা দিল ব্যায়াম সমিতি। জাতীয়তাবাদী উন্মাদনার প্রতিকৃতিকে দর্পের সঙ্গেই সকলের সামনে প্রতিষ্ঠা করল তারা। পলাশির যুদ্ধ থেকে সিপাহি বিদ্রোহ পর্যন্ত ভারতের মুক্তি আন্দোলনের অসংখ্যা ঘটনাকে তুলে ধরা হল পুতুল ও পোস্টারের মাধ্যমে। যার শিরোনামে থাকত বিভিন্ন উক্তি। যেমন, ‘রক্তাম্বুদি আজি করিয়া মন্থন তুলিয়া আনিব স্বাধীনতার ধন’, কিংবা ‘বাহুতে তুমি মা শক্তি হৃদয়ে তুমি মা ভক্তি, তোমারি প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে’। আরেকটি মূর্তির উপরে পোস্টারে লেখা ছিল, ‘সময় হয়েছে নিকট এখন বাঁধন ছিঁড়তে হবে’। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে ছিল বাঘা যতীনের লড়াই, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, কোহিমার যুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা। ব্রিটিশ পুলিশের চোখের সামনে দিয়েই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ নিয়ে যেত স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র। ‘অন্নকূট’ অনুষ্ঠানেও নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র বসু। এছাড়াও তাঁর দাদা শরৎচন্দ্র বসু, বিবেকানন্দের ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বিপ্লবী উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ব্যক্তিত্ব ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিলেন ব্যায়াম সমিতির সঙ্গে।
১৯৩০ সালে নারায়ণচন্দ্র দে ও ভূপাল বসু বোমা মারলেন অত্যাচারী পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্টের গাড়ি লক্ষ্য করে। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন টেগার্ট। ধরা পড়ে গেলেন দুই বিপ্লবী। শুরু হল বিখ্যাত ডালহৌসি স্কোয়ার বোমা মামলা। ঘটনাচক্রে নারায়ণচন্দ্র দে ছিলেন সিমলা ব্যায়াম সমিতির গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক। ফলে কোপ এসে পড়ল তাঁদের উপরেও।
আরও পড়ুন-প্রয়াত রাজনীতিক, ক্রীড়া প্রশাসক বিজয় মালহোত্রা, শোকবার্তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
ব্রিটিশ সরকার ১৯৩২ সালে এই ক্লাবকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল। সে বছর ৭ অক্টোবর আদালত থেকে বেআইনি করে দেওয়া হয় সমিতিকে। ব্যায়ামের যাবতীয় সরঞ্জাম বাজেয়াপ্ত করে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয় মূল দরজায়। পুজোও বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৯৩৪ সালে নিষেধাজ্ঞা উঠলে ফের পুজো শুরু হয়। তখন এর সভাপতি হন সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৩৬-এর সংবাদপত্রের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দুর্গাপুজোর প্রত্যেক দিন তিন হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল এখানে। জাতপাত নির্বিশেষে অঞ্জলি দেওয়া হয় অষ্টমী তিথিতে।
কয়েক বছর পরে এখানে একচালার বদলে শুরু হয় পাঁচচালার পুজো। সংশয় প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই, হয়েছিল সমালোচনাও। কিন্তু অতীন্দ্রনাথের পরিষ্কার উত্তর, “মার পূজার ধ্যানে কোথায় আটকাচ্ছে?” তারপর শিল্পী নিতাই পালকে ডেকে সংস্কৃত শ্লোকের মাধ্যমে তুলে ধরেন নতুন মাতৃপ্রতিমার শাস্ত্রীয় যুক্তি।
ইতিহাস বলছে, কলকাতার সর্বপ্রথম বারোয়ারি দুর্গাপূজা ভবানীপুরের বলরাম বসু ঘাট রোডের ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পুজো, শুরু ১৯১০ সাল। তারপর ১৯১১ সালে শ্যামপুকুর আদি সর্বজনীন, ১৯১৩ সালে শিকদার বাগান, ১৯১৯ সালে নেবুবাগান, যা বর্তমানে বাগবাজার সর্বজনীন এবং ১৯২৬ সালে সিমলা ব্যায়াম সমিতি।