‘Death for me would be a glorious deliverance rather than that I should be a helpless witness of the destruction of India, Hinduism, Sikhism and Islam’. [Gandhi-Neheru Correspondence: A Selection, pp. 239]
নেহরুকে লেখা চিঠিতে বলেছিলেন গান্ধী (gandhi jayanti), ১৯৪৮ সালের ১৩ জানুয়ারি। এর ঠিক সতেরো দিন পরে ৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮ নাথুরাম গডসে ও তার সঙ্গীরা পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে হত্যা করে জাতির পিতা গান্ধীকে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও হিন্দু মহাসভার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত নাথুরাম গডসের হাতে মহাত্মা গান্ধীর এই হত্যা কেবল এক উগ্র রাজনৈতিক কর্মীর দ্বারা ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় জননেতার হত্যাই নয়। এটা ছিল বিংশ শতকের প্রথমার্ধের ভারতীয় রাজনীতিতে উদার, অহিংস, ধর্মনিরপেক্ষ, দেশপ্রেমিক মানবতাবাদের সঙ্গে অন্ধ, ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক উগ্র জাতীয়তাবাদের দ্বন্দ্বের এক পরিণাম। এই লড়াইয়ের একদিকে ছিল জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে ভারতের অসাম্প্রদায়িক জনগণ, অন্যদিকে ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ ও হিন্দু মহাসভার মতো কট্টর সাম্প্রদায়িক সংগঠন, যারা বিশ্বাস করত হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতিতত্ত্বে, যারা প্রায় পাঁচহাজার বছর ধরে চলে আসা ভারতীয় উপমহাদেশের অসংখ্য জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়ের মিলিত সহাবস্থানের ঐতিহ্যকে স্বীকারই করেনি কোনওদিন। ১৯২৫ সালের বিজয়া দশমীর দিন মহারাষ্ট্রের নাগপুরে আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠা হয় ডাঃ কেশব বালিরাম হেডগেওয়ার ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের হাত ধরে। ঘটনাচক্রে এবছর বিজয়া দশমী পড়েছে ২ অক্টোবর। যেটি মহাত্মা গান্ধীরও জন্মদিন। এই সমাপতনের দিনটিতে আরেকবার মনে করা দরকার, একশো বছরে পা রেখে আরএসএস আজও তাদের বিভাজনের রাজনীতিকে সরকারি ক্ষমতার আনুকূল্যে গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু শারীরিক মৃত্যুর প্রায় আটদশক পেরিয়ে আজও গান্ধীর অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবতাবাদের রাজনীতি পরাস্ত তো হয়ইনি, উল্টে প্রতিনিয়ত প্রমাণিত হচ্ছে ভারতের মতো একটি বহুজাতিক, বহুভাষিক দেশে গান্ধীজির মতাদর্শই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য এবং দেশের সম্প্রীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে কোনও বিকল্প নেই।
নাথুরাম গডসে এবং নারায়ণ আপ্তে-প্রতিষ্ঠিত ‘অগ্রণী’ পত্রিকায় ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত সেই কার্টুনটি আজ সমাজমাধ্যমের কল্যাণে ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। যেখানে গান্ধীকে তুলনা করা হয়েছে দশমুণ্ডওয়ালা রাবণের সঙ্গে। সেই দশটি মাথার একটি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, একটি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, একটি মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, একটি রাজাগোপালাচারি, একটি আচার্য কৃপালনী—এরকম গান্ধী সমেত তৎকালীন জাতীয় কংগ্রেস-নেতৃত্বের শীর্ষ দশজনের মুখ। উল্টোদিকে সেই রাবণ-রূপী গান্ধীকে বাণ মারছেন দামোদর বিনায়ক সাভারকর এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। এই কার্টুনটি অত্যন্ত গভীর প্রতীকী তাৎপর্যবাহী। দেশপ্রেমিক, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের দশজন পুরোধাপুরুষকে অশুভ শক্তি হিসেবে হত্যা করতে উদ্যত হিন্দু মহাসভার দুই নেতা সাভারকর এবং শ্যামাপ্রসাদ। এঁরা দু’জনেই ছিলেন আরএসএস-এর সঙ্গেও অত্যন্ত গভীর সম্পর্কে জড়িত। অর্থাৎ স্বাধীনতা আন্দোলনে সর্বতোভাবে অন্তর্ঘাতমূলক কাজ চালিয়ে গেছে যে দুটি উগ্র দক্ষিণপন্থী সংগঠন—আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভা, তারা সেইসময় থেকেই জানত তাদের প্রধান শত্রু কারা। এবং এই প্রধান শত্রুদের শিরোমণি আর কেউ নন, স্বয়ং মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এটাও আজ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত, ১৯৪৮-এর ৩০ জানুয়ারির আগেও গান্ধীকে হত্যার পাঁচবার চেষ্টা চালায় সংগঠনটি। গোটা জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতার যুদ্ধে ব্রিটিশের দালাল এই দুই উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন কেন গান্ধীকেই তাদের প্রধানতম শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল?
এর উত্তর খুঁজতে গেলে বুঝতে হবে গান্ধীর (gandhi jayanti) আজীবনের রাজনৈতিক-সামাজিক আদর্শকে। যে আদর্শ পরিপূর্ণভাবে গান্ধীর ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও লিঙ্গসাম্যের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত এবং আরএসএস-এর চরম রক্ষণশীল ও ঘৃণার মূল্যবোধের সম্পূর্ণ বিপরীত। গান্ধী জাতপাতের বিভেদের অবসান চেয়েছেন, চেয়েছেন জনজীবনের সমস্ত সমস্যার গণতান্ত্রিক, যুক্তিসাপেক্ষ সমাধান। বিশেষত নাগরিক অধিকার নিয়ে তাঁর যে বিপুল ধ্যানধারণা তিনি লিখে গেছেন, তা আজকের ভারতে আরএসএস-বিজেপির কর্তৃত্ববাদী ও দমনমূলক শাসননীতির সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ। গান্ধীজি বলতেন, সাম্প্রদায়িকতা জিনিসটা কেবল জাতীয়তাবাদবিরোধীই নয়, হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে এটি হিন্দুবিরোধী এবং মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ক্ষেত্রে এটি সম্পূর্ণ মুসলমানবিরোধী। ১৯৪৭-এর মার্চ মাসে তিনি বলেছিলেন—”মুসলিমরা যদি হিন্দুদের নিশ্চিহ্ন করে দেয় তাহলে তারা ইসলামের কোনও উপকার তো করবেই না বরং তারা ইসলামকেই ধ্বংস করবে। আবার হিন্দুরা যদি ভাবে তারা মুসলিমদের ধ্বংস করতে সক্ষম হবে, তাহলে তারা হিন্দু ধর্মকেই ধ্বংস করবে”। (‘হরিজন পত্রিকা’, ১৩ মার্চ, ১৯৪৭, গান্ধী রচনাবলি, খণ্ড ৮৭, পৃ. ৪৫) গান্ধীর এই বিশেষ ধর্মনিরপেক্ষতাই স্বাধীন ভারতীয় সংবিধানের অন্যতম ভিত্তি, যা আজ এনআরসি-সিএএ আইনের মধ্য দিয়ে ধ্বংস করতে চাইছে বিজেপি। গান্ধীজিকেই লক্ষ্য করে এম এস গোলওয়ালকর লিখেছিলেন—“যাঁরা একথা ঘোষণা করেছেন যে, হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ছাড়া স্বরাজ চাই না, তাঁরা আমাদের সমাজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছেন… গান্ধীজির মতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য গঠন করার সবচেয়ে সোজা পথ হল হিন্দুদের মুসলিম বনে যাওয়া” (বাঞ্চ অফ থটস, পৃ.১৫১-১৫২, ১৯৬৬ সংস্করণ)।
আজকের ভারতে গান্ধীর হত্যাকারীরা ক্ষমতায় আসীন। দেশে হিংস্র সাম্প্রদায়িক বিভাজন, জাতিসংঘর্ষ, নারীবিদ্বেষী একের পর কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে তারা তাদের ভয়ের সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাইছে। কিন্তু স্বাধীনতার ৭৮ বছর পেরিয়েও আজও যে শতবর্ষ-স্পর্শ করা সংঘ তাদের কাঙ্ক্ষিত ফ্যাসিস্ট ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ গড়ে তুলতে পারেনি, বরং মণিপুর থেকে লাদাখ, উত্তরপ্রদেশ থেকে অসাম, দিল্লি থেকে পাটনা একের পর এক গণ-আন্দোলনের ঢেউ স্বৈরাচারী মোদি-শাহের ঘুম কাড়তে চলেছে, তার নেপথ্যে আসলে রয়েছেন সেই কৌপীনধারী অর্ধনগ্ন ফকির, ঘাতকের বুলেট যাঁর প্রাণ কেড়েছিল।
হারবে আরএসএস-বিজেপি। শেষ অবধি জিতবেন গান্ধী। জিতবে গণতান্ত্রিক ভারত।
আরও পড়ুন-গভীর হচ্ছে নিম্নচাপ: কলকাতায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস, কমলা সর্তকতা জারি