বিজয়া দশমী আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠা তিথি। শতবর্ষ আগে এই সংঘের প্রতিষ্ঠা।
গতকাল ছিল এবছরের বিজয়া দশমী। ২ অক্টোবর। মহাত্মা গান্ধী এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রীর জন্মদিবস।
আরএসএস চিরকাল গান্ধীর চিন্তা দর্শনের সামূহিক বিনাশের কাজে আত্মনিয়োগ করেছে। আর এখন গৈরিক সংঘ পরিবার লালবাহাদুর শাস্ত্রীর পরম্পরাকে নিজেদের বলে চালাতে চাইছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামে আরএসএস ব্রিটিশের দালালি করে কাটিয়েছে। এখন তাদের এবং তাদের পরম্পরার উত্তরসূরি বিজেপি দেশপ্রেমের ঐতিহাসিক পরম্পরার মিথ্যা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিজেদের লোক হিসেবে দেখাতে উদ্যোগী। এই রাজনৈতিক সুবিধাবাদের কারণেই আরএসএস তথা বিজেপি সহ গোটা গেরুয়া-পরিবার শাস্ত্রীজিকে গিলতে চাইছে।
আরও পড়ুন-পুরসভা-পুলিশই ম্যান অফ দ্য ম্যাচ, নির্বিঘ্নে নিরঞ্জন
এবং এই প্রবণতা ইদানীং স্পষ্টতর হচ্ছে।
আরএসএস-এর সাপ্তাহিক মুখপত্র ‘অর্গানাইজারে’র একটি নিবন্ধে শাস্ত্রীকে ‘একনিষ্ঠ কংগ্রেসম্যান’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন আদবানি। লিখেছিলেন, নেহরুর মতো, লালবাহাদুর শাস্ত্রীজি জনসংঘ এবং আরএসএসের প্রতি কোনও আদর্শগত বিদ্বেষভাব পোষণ করতেন না। জওহরলাল নেহরুর প্রয়াণের পর ১ জুন, ১৯৬৪ থেকে ১১ জানুয়ারি, ১৯৬৬ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। ১৯৬০ সালে ‘অর্গানাইজারে’ সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদানকারী আদবানি বলেন, সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বেশ কয়েকবার শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন এবং প্রতিবারই এই উল্লেখযোগ্যভাবে ছোট চেহারার কিন্তু বিশাল হৃদয়ের প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে তাঁর ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল।
বাদ যাচ্ছেন না মোহন ভাগবতও। তিনি শাস্ত্রীজিকে ‘লোক নেতা’, এবং ‘গণনেতা’ বলে উল্লেখ করতে কুণ্ঠিত হচ্ছেন না।
এই ঔদার্য, সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধা কিন্তু গান্ধী কিংবা নেহরুর বিষয়ে অপ্রদর্শিত। অথচ ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের (অক্টোবর-নভেম্বর) পর নেহরু,উদার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বস্ত জওহরলাল নেহরু ১৯৬৩ সালের ২৬ জানুয়ারি নয়াদিল্লিতে সাধারণতন্ত্র দিবসে আরএসএস স্বেচ্ছাসেবকদের অংশ নিতে বলেছিলেন আর লালবাহাদুর শাস্ত্রীই নেহরুর বার্তা আরএসএসকে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
সেসব না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু এই মোদি -পক্ষর গৈরিক হিন্দুত্ববাদীরা কি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর পরম্পরা বহনের যোগ্য?
গুজরাতে আরএসএস প্রকাশিত একটি ম্যাগাজিনে লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে একজন নম্র ব্যক্তিত্ব (an unassuming personality), ভিত্তিপ্রস্তর (foundation stone) এবং অখ্যাত জাতীয়তাবাদী (unsung nationalist) হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল তিনি সংবর্ধনা এবং সম্মাননা থেকে দূরে থাকতেন।
আচ্ছা, মোদিজির ক্ষেত্রে কি আমরা উল্টোটাই দেখি না? সংবর্ধনা এবং সম্মাননা থেকে দূরে থাকা তিনি মোটেই পছন্দ করেন না, তাঁর আচার-আচরণে কি এমনটাই মনে হয় না?
নইলে কোন আক্কেল কলকাতার দুর্গাপুজো তাঁর উদ্যোগে, কেন্দ্রের চেষ্টাতেই ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে বলে দাবি করে বসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি? ২০২৬-এর নির্বাচনী প্রচারের অংশ এই মিথ্যাচার, সেটা বুঝতে কি কারও বাকি আছে?
প্রচারলোভী প্রধানমন্ত্রী ডাহা মিথ্যা বলেছেন। বামফ্রন্ট সরকার পুজোর বিষয়ে কোনও নজর দেয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারে এসে পুজোর ঐতিহ্য, অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও বিশ্বায়নে নজর দিয়েছেন। সব ফাইল রাজ্যই তৈরি করে পাঠিয়েছিল। কোনও ক্ষেত্রে কেন্দ্র ডাক পিয়নের ভূমিকা নিলে সেই কৃতিত্ব তাদের হয়ে যায় না।
২০২১ সালে বাংলার শারদোৎসব ইউনেস্কোর স্বীকৃতি অর্জন করেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরাসরি উদ্যোগেই সমস্ত নথি ও প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি তখন বহুবার বাংলায় এসেছেন। কিন্তু কোথাও তাঁকে এনিয়ে মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। এখন হঠাৎ ২০২৫ সালে এসে কেন তিনি এই দাবি করছেন? বোঝাই যাচ্ছে, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ এই মিথ্যাচার, চলতি বাংলায় যাকে বলে ‘ঢপবাজি’। এই মিথ্যে ‘ফোকাস’ খাওয়ার চেষ্টা নিঃসন্দেহে ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ।
এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। লালবাহাদুর শাস্ত্রী তখন রেলমন্ত্রী। তিনি কোন সাধারণ নাগরিকের মতোই প্যাসেনজার ট্রেনে বাড়ি এসে মাকে দেখেই আবার চলে যেতেন। একদিন তাঁর মা জিজ্ঞাসা করে বসলেন, দিল্লিতে তুই কী করিস? উত্তরে শাস্ত্রী মাকে বললেন, ভারতীয় রেলে ছোট্ট একটা কাজ করি। মা পাল্টা প্রশ্ন করে বললেন, তুই রোজ রোজ বাড়ি আসিস না কেন? সোজা উত্তর, ছুটি পাই না তাই আসতে পারি না। মা বললেন, ঠিক আছে ছুটি না পেলে আসার দরকার নেই। আমি গিয়েই তোকে দেখে আসব। কেমন করে যাব, শুধু তাই বল। শাস্ত্রীজি বললেন, তুমি এখান থেকে ট্রেনে উঠে দিল্লি স্টেশনে নামবে। তারপর স্টেশন মাস্টারের কাছে গিয়ে বললেই তিনি আমাকে ডেকে দেবেন।
পরের সপ্তাহে ছেলের জন্য ভালমন্দ খাবার বানিয়ে দিল্লি যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হলেন তাঁর মা। মা জানতেন না দিল্লির গাড়ি কখন আসে এবং কখন ছেড়ে যায়। তাই তিনি স্টেশনে পৌঁছেই দেখলেন একটি গাড়ি ছেড়ে গেল। পরের গাড়ির অপেক্ষায় তিনি একটি গাছতলায় বসে পড়লেন। তাঁকে একা বসে থাকতে দেখে একজন কুলি জিজ্ঞাসা করল, বুড়ি মা তুমি কোথায় যাবে? বিড়বিড়িয়ে বললেন, দিল্লি।
—দিল্লির গাড়ি তো এইমাত্র ছেড়ে গেল।
—তাতে কী হয়েছে। আবার যে গাড়ি আসবে সেই গাড়িতেই উঠে পড়ব।
—সেই গাড়িতো আসবে বিকেলে।
—তাহলে বিকেলেই যাব।
আর একজন জিজ্ঞাসা করল, বুড়ি মা তুমি দিল্লিতে কার কাছে যাবে? তিনি বললেন, ছেলেকে দেখতে যাব।
—তোমার ছেলের নাম কী? —আমার ছেলের নাম লাল।
—তোমার ছেলে দিল্লিতে কী করে?
—দিল্লি রেল স্টেশনে কাজ করে।
লোকজন হাসাহাসি করে বলে উঠল, হায় হায় তুমি তো তাহলে রেলমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মা!
না-না। আমার ছেলের নাম তো কেবলই লাল। আর সে তো মন্ত্রী না।
হইহুল্লোড় দেখে এলেন স্টেশন মাস্টার। তিনি তাঁকে উঠিয়ে নিয়ে অফিস রুমে বসালেন। এরপর কয়েকটি প্রশ্ন করে নিশ্চিত হলেন যে, এই বুড়িই রেলমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মা। তিনি বিষয়টি তার বার্তায় দিল্লিতে জানিয়ে দিলেন।
বিকেলের ট্রেনে রেলমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী এসে তাঁর মাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। বললেন, মা, তুমি সত্যি সত্যিই আমাকে দেখার জন্য দিল্লি যাওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়বে এটা আমার জানা ছিল না। আমি এসে গেছি, তুমি বাড়ি চলো।
লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে মা শুধু দু’টি প্রশ্ন করেছিলেন, “তু লাল সে লালবাহাদুর শাস্ত্রী কব বন গয়া? রেল কো ছোটা কর্মচারী সে মন্ত্রী কব বন গয়া? ইয়ে পাতা তু মুঝে কিউ নেহি দিয়া?’’ উত্তরে শাস্ত্রী বলেছিলেন মা, আমি এখনও তোমার সেই ছোট্ট লাল। আমি মন্ত্রী হলেও জণগণের সেবক।
বর্তমানে আমাদের দেশে কোটি কোটি টাকার সুট পরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এমন ঘটনা খাপ খায়? আসলে, প্রকৃত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে এসব বড়ই বেমানান। সত্যিকার দেশপ্রেমের উত্তরাধিকার বিজ্ঞাপনী মানসিকতা আর দেখনপনা কখনও বহন করতে পারে না। এটা বোঝা ও বোঝানোর সময় এসেছে।