কোটি কোটি ডলারের জায়েন্ট সায়েন্স বলা চলে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের তাই বুক ঢিপঢিপ। আগে কখনও এত বিপজ্জনক, এত বড় প্রকল্পে নামেননি ওঁরা। মুহূর্তের ভুলে ২৫ বছরের স্বপ্ন চুরমার হয়ে যেতে পারে। প্রাণের উৎসের উত্তর খুঁজে আনার যাত্রা শুরু করা এক টেলিস্কোপ মহাশূন্যের পথে পাড়ি দিতে ২০২১-এর বড়দিনকেই বেছে নিল। কিন্তু, হাবল থাকতেও কী সেই লক্ষ্য, যার জন্য আরও এক টেলিস্কোপ-এর দরকার পড়ল? উদ্দেশ্য, আরও গভীরে পৌঁছে ব্রহ্মাণ্ডকে জানা। এ-যাবৎ যত স্পেস টেলিস্কোপ তৈরি করা হয়েছে, তার মধ্যে এই জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপই বৃহত্তম অর্থাৎ সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী।
আসলে, ৩১ বছর আগের ঘটনা। ১৯৯০ সালে নাসা মহাকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য হাবল স্পেস টেলিস্কোপ পাঠিয়েছিল। সেই বিন্দু থেকেই আরও এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে এবার ব্রহ্মাণ্ডের আরও গভীরে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করা তাই জরুরি হয়ে উঠছে বিজ্ঞানীদের। এর জন্য মহাকাশে এবার হাবল-এর চেয়েও কয়েকগুণ শক্তিশালী টেলিস্কোপ পাঠাল নাসা, আরিয়েন ৫ ইসিএ রকেটে চেপে, উৎক্ষেপণ করা হল দক্ষিণ আমেরিকার ফরাসি গায়ানা থেকে। টাইমমেশিনে পৃথিবীর ১৩.৫ বিলিয়ন বা ১৩,৫০০ কোটি বছর আগে ফিরে যাবে এই টেলিস্কোপ।
১৯৬১ সাল ও তার পরবর্তী বেশ কিছু বছর পর্যন্ত নাসার প্রশাসক ছিলেন জেমস ই ওয়েব (James E. Webb)। তাঁর নামেই বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী টেলিস্কোপের নামকরণ করা হয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। নাসা, ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ESA) এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি (CSA)— এই তিন সংস্থার উদ্যোগে তৈরি হয়েছে এই টেলিস্কোপ যা হাবল স্পেস টেলিস্কোপের (Hubble Space Telescope) পরিপূরক এবং উত্তরসূরি।
আরও পড়ুন-রাশিয়ার প্রথম নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী পাভলভ
মানুষের তৈরি টাইম মেশিন
হাবল থাকতে এই টেলিস্কোপটি কেন? কারণ, এক কথায় এটি মানুষের তৈরি টাইম মেশিন। যে-যন্ত্রে চেপে মানুষ ঘুরে আসতে পারবে, ১৪ হাজার কোটি বছর আগের সময়ে। খুঁজে পাবে, কীভাবে প্রাণের জন্ম হয়েছিল! মহাবিশ্বের ইতিহাসের প্রতিটি পর্যায় অধ্যয়ন করবে— বিগ ব্যাং-এর পরে প্রথম আলোকিত দীপ্তি থেকে শুরু করে সৌরজগতের গঠন, মহাবিশ্বের অন্যান্য গ্রহ-ব্যবস্থার বিবর্তন পর্যন্ত। বিশ্বের ১৪টি দেশ ও ২৯টি মার্কিন অঙ্গরাজ্যের ৩ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্থা ও কোম্পানির শতশত বিজ্ঞানী প্রায় ৩০ বছর ধরে এটি তৈরি করেছেন। মহাকাশে এটি থাকবে সম্ভবত ১০ বছর। তুলনায়, হাবল রয়েছে প্রায় ৩০ বছর।
কোন ৬ প্রশ্নের অনুসন্ধান?
হাবল থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকা এই টেলিস্কোপের যাত্রা শুরুর মূলত ৬টি উদ্দেশ্য। ১. ভিনগ্রহী প্রাণের অনুসন্ধান : একটি সাধারণ প্রশ্ন— “পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও কি জীবন রয়েছে?” আমরা হয়তো এই টেলিস্কোপের সাহায্যে এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতে পারি। কারণ ওই টেলিস্কোপের মাধ্যমে অন্য গ্রহের প্রাণ ধারণের উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে কিনা জানা যাবে। ২. বিগ ব্যাং-এর পর প্রথম গ্যালাক্সির অনুসন্ধান : এই টেলিস্কোপের অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্য হল বিগ ব্যাং-এর পর প্রথম গ্যালাক্সির অনুসন্ধান করা। এখন পর্যন্ত সর্বাধিক দূরবর্তী গ্যালাক্সি পৃথিবী থেকে ১৩.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। কিন্তু এই টেলিস্কোপ দিয়ে, এরও আগে বিগ ব্যাং-এর প্রথম দিকে যেসব গ্যালাক্সি সৃষ্টি হয়েছিল সেগুলো খুঁজে পাওয়া যাবে, যা দেখে বোঝা যাবে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম দিকের অবস্থা কেমন ছিল। ৩. সৌরজগতের গ্রহগুলো পর্যবেক্ষণ করা : এই টেলিস্কোপ আমাদের সৌরজগৎ ছাড়াও অভ্যন্তরীণ গ্রহ, উপগ্রহ, বামনগ্রহ, গ্রহাণু, ধুমকেতু— এ-সবও পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হবে। ৪. নক্ষত্রের গঠন এবং তাদের বির্বতন অনুসন্ধান করা : এই টেলিস্কোপের বিশেষ ক্ষমতা হচ্ছে এটি ইনফ্রা-রেড লাইট বা অবলোহিত আলো দেখতে পারবে। হাবল টেলিস্কোপে সমস্যা ছিল, বিভিন্ন নক্ষত্র থেকে নির্গত আলো আসার সময় মহাজাগতিক ধূলিকণার জন্যে বাধা পায়। যার ফলে আমাদের নক্ষত্রগুলোকে স্পষ্ট করে দেখা সম্ভব হয় না। কিন্তু এই টেলিস্কোপে ইনফ্রা-রেড লাইট থাকায় সমস্ত মহাজাগতিক নক্ষত্র আগের তুলনায় অনেক ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হবে। (৫) পৃথিবীর মতো গ্রহগুলোর অনুসন্ধান করা : মানুষ কিন্তু অনেক আগে থেকেই নিজেদের সভ্যতা রক্ষা করার জন্য বসবাসযোগ্য গ্রহ খুঁজে চলেছে। আমাদের পৃথিবী হ্যাবিটেবল জোনে অবস্থান করছে। আমরা হাবল স্পেস টেলিস্কোপ দিয়েও অনেকগুলো গ্রহের সন্ধান পেয়েছি যেগুলো পৃথিবীর মতো হ্যাবিটেবল জোনে অবস্থান করছে এবং জল থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ আরও বেশি এ-জাতীয় গ্রহ খুঁজবে এবং এই গ্রহগুলোর মধ্যে যেগুলোর বৈশিষ্ট্য আমাদের পৃথিবীর সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিলবে, সেখানে পরবর্তী প্রজন্মের বসবাস-উপযোগী করার চেষ্টা করা হবে। ৬. বিভিন্ন গ্রহ পর্যবেক্ষণ এবং তাদের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা : এখনও আমরা অনেক গ্রহ সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমাদের পৃথিবীর মতো ছোট-ছোট অনেক গ্রহ রয়েছে যেগুলো দেখা সম্ভব হয়নি। কিন্তু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে ছোট ছোট দূরবর্তী গ্রহগুলোও দেখা সম্ভব হবে।
এই টেলিস্কোপ এক মহাপ্রকল্প
পৃথিবী থেকে ১.৫ মিলিয়ন কিলোমিটার গন্তব্যে পৌঁছতে হবে এই টেলিস্কোপকে। এটি তৈরি করতে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৭৫,৩৩০ কোটি টাকা। নাসার সাদাহাতি ওই দূরবিন বানাতে এত খরচ হয়েছে যে ওই সংস্থার পক্ষে বিশ্বতত্ত্বের অন্য অনুসন্ধান হাতে নেওয়া সম্ভব হয়নি। নাসা জানিয়েছে, প্রায় ১৪০০ বছর আগে ঘটা বিগ ব্যাং বা মহা-বিস্ফোরণের পর থেকে এখনকার সময় পর্যন্ত ঘটে চলা বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুর উৎপত্তি-বিকাশ-ধ্বংসের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। আগামী অন্তত ১০ বছর ধরে এই টেলিস্কোপই হবে নাসা, এসা, সিএসএ, ইসরো ইত্যাদির মহাকাশ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার প্রধান অবলম্বন। মহাকাশে যে জায়গায় এই টেলিস্কোপটিকে বসানো হবে সেই জায়গাটি পৃথিবী থেকে ১০ লক্ষ মাইল বা ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে। উৎক্ষেপণের পর সেই পথ পাড়ি দিতে টেলিস্কোপের এক মাস সময় লাগবে। আর সেখানে পৌঁছে তার আয়না ও সানশিল্ড ইত্যাদি খুলতে ও অন্যান্য যন্ত্র চালু করতে সময় লাগবে আরও অন্তত মাস ছয়েক। বিশ্বের ১৪টি দেশের বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী দ্বারা নির্মিত এই টেলিস্কোপটি রকেটের উপরে লক করতে ৪০ মিলিয়ন ঘণ্টা লেগেছিল। টেলিস্কোপটি এতই সংবেদনশীল যে এটি তাত্ত্বিকভাবে পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বে অবস্থিত বস্তুকে শনাক্ত করতে পারে। অর্থাৎ, এক গন্ধমাদন পর্বতপ্রমাণ ওই টেলিস্কোপ।
এখন শুধুই মহাবিশ্বের প্রাণের মুহূর্ত দর্শনের অপেক্ষা।