২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এবং আরএসএস-নিয়ন্ত্রিত বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতায় থাকাকালীন গত দশ বছরে হিন্দিবলয়ের কর্পোরেট হিন্দুত্বের প্রতিশোধমূলক প্রচেষ্টা তীব্রভাবে দেখা গেছে। স্বাধীন ভারতের গত ৭৭ বছরে এত জনবিরোধী, ধনীপন্থী, সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন আর কখনও দেখা যায়নি।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং এর সংঘ পরিবার হল সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎস এবং আজ ভারতে বিজেপির মেরুদণ্ড। স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ে হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতার প্রতিনিধিত্ব করেছিল। এখন হিন্দু মহাসভা বিস্মৃতিতে চলে গেছে, কিন্তু বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে ওঠার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। বিভিন্ন মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন যেমন জামাত-ই-ইসলামি, সিমি, এসআইও, মুসলিম লিগ, এমআইএম, পিএফআই, পাকিস্তান-সমর্থিত সন্ত্রাসী সংগঠন; এবং বিভিন্ন খালিস্তানি গোষ্ঠীর মতো শিখ মৌলবাদী সংগঠন সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতার প্রতিনিধিত্ব করে। আর বিজেপি ও তার মদতদাতা সংঘ শক্তি সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতার প্রতিনিধিত্ব করে। ইতিহাস বলছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা একে অপরের উপর নির্ভর করে এবং একে অপরকে বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। যদিও সকল ধরনের সাম্প্রদায়িকতা বিপজ্জনক, তবুও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতা আরও বড় বিপদ কারণ এটি জাতীয়তাবাদের ছদ্মবেশ ধারণ করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে দেশ এবং অনেক রাজ্যে ক্ষমতা দখল করার শক্তি প্রদর্শন করেছে।
আরও পড়ুন-বিষাক্ত কাফসিরাপ খেয়ে ১১ শিশুর মৃত্যু বিজেপির মধ্যপ্রদেশ-রাজস্থানে
১৯২৩ সালে হিন্দু মহাসভা নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব’ শীর্ষক বইয়ের আবির্ভাবের সাথে সাথে ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির জন্ম বলে অনুমিত হয়। আরএসএস কর্তৃক প্রকাশিত আরএসএসের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের জীবনী অনুসারে, ‘হিন্দুত্বের ধারণার উপর সাভারকরের অনুপ্রেরণামূলক এবং উজ্জ্বল ব্যাখ্যা, যা অকাট্য যুক্তি এবং স্পষ্টতা দ্বারা চিহ্নিত, ডক্টরজির (হেডগেওয়ারের) হৃদয়বীণায় ঝংকার তুলেছিল। হেডগেওয়ারের মৃত্যুর পর আরএসএসের দ্বিতীয় প্রধান মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর সাভারকরের হিন্দুত্বকে একটি মহান বৈজ্ঞানিক চিন্তাদর্শন বলে মনে করেছিলেন। গোলওয়ালকরের লেখা আরও দুটি বই, যার শিরোনাম ‘উই অর আওয়ার ন্যাশনহুড ডিফাইন্ড’ এবং ‘বাঞ্চ অফ থটস’, হিন্দুত্ববাদী শক্তির আদর্শগত ত্রিধারা বা ত্রিশূল প্রতীককে পূর্ণতা দেয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, হিন্দুত্ব এবং হিন্দুধর্ম ভিন্ন দর্শন। হিন্দুধর্ম একটি ধর্ম। হিন্দুত্ব স্পষ্টতই ঘৃণা ও বর্জনের উপর ভিত্তি করে এবং মনুস্মৃতির প্রতি মৌলিক আনুগত্যের ভিত্তিতে একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক প্রোজেক্ট।
বিজেপির এই কর্পোরেট-মনুবাদী হিন্দুত্ব ভারতের সামনে এবং এর গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সার্বভৌমত্ব, যুক্তরাষ্ট্রীয়তা এবং আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচারের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ। আর এগুলোই আমাদের সংবিধানের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। এটি এদেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার পক্ষে মারাত্মক হুমকি। এটি নির্লজ্জভাবে পুঁজিবাদপন্থী, জমিদারপন্থী, সাম্রাজ্যবাদপন্থী এবং তার শ্রেণি চরিত্রে ফ্যাসিবাদী। এটি ‘ভারতের ধারণা’র উপর আক্রমণ, যা আমাদের সমন্বিত ইতিহাস এবং সংস্কৃতিকে ধারণ করে। এদের লক্ষ্য কোনও উন্নয়ন নয়, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ। সেটা তীব্র করার পর, তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল ভারতের সংবিধান পরিবর্তন যাতে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা যায়।
ভারত হিন্দু রাষ্ট্র হলে যাঁরা ভাবছেন, মন্দ কী! তাঁদের অবগতির জন্য কতিপয় কথা।
এক, হিন্দুত্ব এবং মনুবাদ অভিন্ন। মনুস্মৃতি হল ২০০০ বছরের পুরনো একটি গ্রন্থ যা তথাকথিত আইন প্রণেতা মনু লিখেছিলেন। এটি হিন্দুধর্মের অন্যতম ভিত্তি। এটি সম্পূর্ণরূপে ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং শূদ্র (স্বামী বিবেকানন্দ যাঁদের শ্রমজীবী জনসাধারণ বলে চিহ্নিত করেছিলেন) এবং নারীদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে না।
আরও পড়ুন-নিম্নচাপের জেরে অতিবৃষ্টি রাজ্যে দুর্যোগ লক্ষ্মীতেও
মনুস্মৃতি ঐতিহ্য অনুসারে দলিতেরা এমনকী শূদ্রও নয়; তারা আরও নিম্নস্তরের এবং চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার বাইরে। মহাত্মা জোতিরাও ফুলে এ-জন্য তাঁদের অতিশূদ্র বলে উল্লেখ করেছিলেন।
হিন্দুত্ববাদীদের কাছে মনুস্মৃতি কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝানোর জন্য সভারকরের ভাবনা-চিন্তার ওপর আলো ফেলা যেতে পারে। সাভারকর লিখেছেন, ‘মনুস্মৃতি হল সেই ধর্মগ্রন্থ যা আমাদের হিন্দু জাতির জন্য বেদের পরেই সবচেয়ে পূজনীয় এবং প্রাচীনকাল থেকে আমাদের সংস্কৃতি-প্রথা, চিন্তাভাবনা এবং অনুশীলনের ভিত্তি হয়ে উঠেছে। …আজ মনুস্মৃতি হল হিন্দু আইন।’
আর গোলওয়ালকর মনুকে ‘বিশ্বের প্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ আইনদাতা’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ঠিক এই কারণেই ডঃ বি আর আম্বেদকর, একটি সত্যিকারের ঐতিহাসিক ঘটনায়, ২৫ ডিসেম্বর ১৯২৭ সালে মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলার মাহাদে জনসমক্ষে মনুস্মৃতি পুড়িয়েছিলেন। তিনি ১৯৩৮ সালে মহারাষ্ট্রের নাসিক জেলার মানমাদে ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমার মতে, এই দেশের শ্রমিকদের দুটি শত্রুর মুখোমুখি হতে হবে। এই দুটি শত্রু হল ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং পুঁজিবাদ।’ সুতরাং বিজেপি যে হিন্দুত্ববাদী চিন্তা-ভাবনায় বিশ্বাস করে, সেটি দেশব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হলে লিঙ্গ-বর্ণ নির্বিশেষে সকল হিন্দু নিরাপদে থাকবেন না, একথা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়।
দুই, ২০০২ সালের গুজরাতে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক হত্যাকাণ্ডে মোদির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা মনে রাখবেন। ২০০০ জনেরও বেশি মুসলিম নিহত হয়েছিল, শত শত নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, এমনকী অসংখ্য শিশুকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। নিঃসন্দেহে এটি ছিল দেশভাগের পর ভারতে সবচেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাবানল। আর এরই সাম্প্রতিক রূপ দেখা গেছে গণপিটুনিতে।
গণপিটুনির জন্য যে প্রধান ‘কারণ’গুলি দেওয়া হয়েছে তা হল গরু জবাই, গরুর মাংস বহন, গরু ও ছাগল চুরি, লাভ জিহাদ ইত্যাদি। প্রায় সবসময়ই, প্রদত্ত কারণগুলি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। গণপিটুনির এই অভিযান সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়, সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে গুন্ডা দলগুলিকে ক্ষমতার বিকৃত অনুভূতি দেয়, সমাজে ঘৃণা ও ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীব্র করে তোলে। এটি শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ২৬ মে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম শপথ গ্রহণের ঠিক এক সপ্তাহ পর থেকে। তার পর থেকে গত ১০ বছরে অসংখ্য নৃশংস ঘটনা ঘটেছে। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান, দিল্লি, জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচলপ্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মণিপুর, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, গুজরাত, মহারাষ্ট্র এবং কর্নাটকের মতো রাজ্যগুলিতে।
তিন, বিজেপি শাসনকালে নারীদের উপর ভয়াবহ সব আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশের হাথরাস এবং উন্নাওতে নারী ও তাদের আত্মীয়দের গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা দেশবাসীকে হতবাক করেছে।
দেশকে সবচেয়ে নাড়া দিয়েছিল অলিম্পিক পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিরদের, যা তৎকালীন রেসলিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার (ডব্লিউএফআই) সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিং, যিনি তখন বিজেপি সাংসদ ছিলেন, যৌনহয়রানির বিরুদ্ধে আন্দোলন। ২০২৩ সালে দিল্লিতে কুস্তিগিরেরা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পরেও, অভিযুক্ত বিজেপি সাংসদকে এখনও গ্রেফতার করা হয়নি; বিপরীতে, মোদি যেদিন নতুন সংসদ ভবন উদ্বোধন করেছিলেন, সেদিনই কুস্তিগিরদের মারধর করা হয়েছিল।
যদি পশ্চিমবঙ্গকে এই হিন্দুত্ববাদী অপশক্তির মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করতে চান, তবেই এদের ভোট দেওয়ার কথা ভাবতে পারেন। নচেৎ এই বিজেপিকে একটি ভোটও নয়।