বাদশা আকবর আর হরিপদ কেরানির বিভেদ মোছার ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থেকে গেল এ বছরের শারদীয়া দুর্গোৎসব (durga puja)। আভিধানিক ‘সর্বজনীন’ শব্দটিকে সামাজিক এবং বাস্তবিক ভিত্তিতে জনজীবনে মিশিয়ে দেওয়ার আশ্চর্য প্রদীপ যেন এতদিন অপেক্ষায় ছিল সেই আলাদিনেরই। কলকাতার কর্পোরেট মণ্ডপের সীমা ছাড়িয়ে চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতির কল্যাণে দুর্গাপুজো সত্যিই আজ গ্রাম-বাংলার প্রতিটি নিম্নমধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের উৎসব। এই বাংলার জনমানসে উচ্ছ্বাসের আজ নতুন স্লোগান— ‘নীল-সাদা আঁকিবুকি শরৎ আকাশে, ঘাসফুলের হাত ধরে কাশফুল হাসে।’ উৎসব, উদযাপন, উপার্জন ও উন্নয়ন— মানুষের ভাল থাকার চারটি স্তম্ভের পুনর্নির্মাণে আটপৌরে এক নারীর হাত ধরে অভিনব জনকল্যাণমূলক অর্থনৈতিক বিপ্লবের সাক্ষী হয়ে থাকল গোটা বিশ্ব। জিতল বাঙালিয়ানা। চিৎকার করে গোটা দুনিয়া বলছে — ‘What Bengal thinks today, India thinks tomorrow.’ একটা ধর্মীয় পুজোকে আন্তর্জাতিক হেরিটেজের পর্যায়ে উন্নীত করে কীভাবে অর্থনীতির চাকায় ত্বরণ আনতে হয়, তা গোটা বিশ্বকে আবারও দেখিয়ে দিল পশ্চিমবঙ্গ। সৌজন্যে সত্তরের এক সংগ্রামী, লড়াকু নারী।
বিরোধীদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ, আর্থিক শ্রদ্ধাঞ্জলিকে ‘ভাতা’ হিসেবে দাগিয়ে দেওয়ার নেতিবাচক রাজনীতিকে উপেক্ষা করেই বাংলার প্রায় ৪৫ হাজার পুজো কমিটির হাতে শারদ শ্রদ্ধাঞ্জলিরূপে এক লক্ষ দশ হাজার টাকা করে তুলে দিয়েছিলেন এই বাংলার ঘরের মেয়ে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর তার সুফল মিলল হাতেনাতে। মা দুর্গার আগমনীবার্তা ধ্বনিত হতেই উচ্ছ্বাসে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল লিলুয়ার লাইটকাকু থেকে ঢাপাইডাঙার ঢাকভাইপো। পাড়ার প্যান্ডেলে অষ্টমীর পরিবর্তে এবার মধ্যাহ্নভোজের মহোৎসব চলেছে তিনদিন ধরে। মুখের হাসি চওড়া হয়েছে বাজারের সবজিদাদা থেকে মুদিখানার জেঠু কিংবা কানাগলিতে ডেকরেটর্সের নতুন দোকান খোলা ভাইটির। সেই টাকাই ঘুরপথে আবার বাজারে এসে মণ্ডপের পাশের ঘুগনি, চাউমিন কিংবা মোমোর স্টলকে দাঁড় করিয়েছে শক্ত আর্থিক পরিকাঠামোয় অর্থাৎ অর্থনৈতিক প্রগতির রিলে রেসের ব্যাটনটা ঘুরছে এখন সবার হাতেই। সার্থক তাই দিদির স্বপ্নের মডেল— ‘এগিয়ে বাংলা।’ প্রাক্পুজো বিক্রিবাট্টা মারকাটারি ইনিংসে শুরুতেই জানান দিয়েছিল, অর্থনৈতিক চক্রকে অব্যাহত রাখতে দুর্গোৎসবকে সুচারুভাবে কার্যকরী করে তোলার পরিকল্পনা নিঃসন্দেহে মুখ্যমন্ত্রীর ঊর্বর মস্তিষ্কের জনকল্যাণমুখী এক সফল ফসল। সংগঠিত খুচরা বিক্রেতারা ২০২৪ সালের তুলনায় দ্বিগুণ রাজস্ব বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন সানন্দে। উচ্ছ্বাসের স্বরে অ্যাক্রপলিস মলের এক কর্মকর্তা ‘চমৎকার ভিড় এবং বিক্রি’র কথা স্বীকার করেছেন নির্দ্বিধায়। তৃপ্তির রেশ ধরা পড়েছে মার্লিন কর্পোরেট গ্রুপের জেনারেল ম্যানেজার (রিটেইল অ্যান্ড হসপিটালিটি) শুভদীপ বসুর গলাতেও— ‘গত বছরের তুলনায় খুচরো বিক্রেতারা দ্বিগুণ অঙ্কের ব্যবসায়িক বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন। গয়না বিক্রি প্রায় ২৫ শতাংশ, জুতো ২০ শতাংশ, পোশাক ২২ শতাংশ এবং খাদ্য ও পানীয় বিক্রি প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়েছে।’ সাউথ সিটি মলের দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা স্বস্তির সঙ্গে স্বীকার করেছেন, ‘প্রায় সবাই তাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। আর্থিক বৃদ্ধি ১০-১৫ শতাংশের মধ্যে। পঞ্চমী এবং ষষ্ঠী উইক এন্ডের সাথে মিলে যাওয়ায়, পুজোর মরশুম এবার শুরু হয়েছে খানিক আগেই এবং তাতে বেড়েছে বিক্রি।’ অর্থাৎ কোথাও গিয়ে মা দুর্গা যেন দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করেছেন অষ্টমী তিথিতে জন্ম নেওয়া তাঁর আটপৌরে কন্যাকে। প্রমাণিত হয়েছে, যুগে যুগে কালে কালে নিঃস্বার্থ মানবদরদি মহাত্মাদেরই সদা সাথ দিয়ে এসেছে ভাগ্য।
আরও পড়ুন- প্রধান বিচারপতিকে জুতো ছোড়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা মুখ্যমন্ত্রীর
কৌশলগত অভিনবত্বে চাঙ্গা এবার ই-কমার্সও। সমস্ত অনলাইন প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ে সার্বিক বিক্রি বৃদ্ধির পরিমাণ গত বছরের তুলনায় প্রায় চারগুণ। প্রিমিয়াম স্মার্টফোন এবং টিভি কোম্পানিগুলির অর্ডারের তালিকাতেও ঘুরপথে বর্ষিত হয়েছে মমতাময়ী আশীর্বাদ। অটোমোবাইল ব্যবসাতেও শারদীয়ায় যোগ হয়েছে এক নতুন মাত্রা।
রাজ্য সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই বছর বিদ্যুতের চাহিদা ১২,০৫০ মেগাওয়াট ইতিমধ্যেই ছুঁয়ে ফেলেছে, যেখানে গত বছর উৎসবে সর্বোচ্চ চাহিদা রেকর্ড করা হয়েছিল ৯,৯১২.৭১ মেগাওয়াট অর্থাৎ সার্বিক প্রগতির প্রতিচ্ছবি যেন প্রদর্শিত হয়েছে দুগ্গামায়ের দর্পণে। পুজো কমিটিগুলি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও তাদের খরচের পরিমাণ বাড়িয়েছে বহুগুণ, বিজ্ঞাপন সংস্থার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে, শহরের হোর্ডিংয়ের জায়গাগুলি এবছর অনেক আগে থেকেই বুক করা হয়েছিল। পাশাপাশি প্রতিটি পুজো বারোয়ারি স্পন্সসরশিপ ফি বিগত বছরগুলির তুলনায় ১৫ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি করেছে এবং তাতে রাজি হয়েছে কর্পোরেট সংস্থাগুলিও।
পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুজো ২০২৫ সালে অর্থনীতি দৃঢ়ভাবে পুনরুদ্ধার করেছে, গতবারের আকস্মিক পতনের পর বিগত বছরের তুলনায় আনুমানিক ১০-১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৪৬,০০০-৫০,০০০ কোটি টাকার ম্যাজিক মার্জিনে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন স্টেকহোল্ডাররা। তাঁদের দাবি— সরকারি অনুদান, উচ্ছ্বসিত কর্পোরেট স্পনসরশিপ, শপিং মলে সুস্থ দর্শক সমাগম, ভোগ্যপণ্যের উপর ক্রমবর্ধমান ব্যয় এবং মানুষের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাবই এই অর্থনৈতিক বৃদ্ধির প্রধান কারণ। ২০১৯ সালের ব্রিটিশ কাউন্সিলের একটি প্রতিবেদনে বাংলায় পুজো-সংশ্লিষ্ট সৃজনশীল শিল্পের পরিমাণ ৩২,৩৭৭ কোটি টাকা বলে অনুমান করা হয়েছিল, যা আজ ইতিমধ্যেই ৫০০০০ কোটির বর্ডার লাইন পার করেছে। সুদক্ষ বিশ্লেষক এবং শিল্পের অভ্যন্তরীণ ব্যক্তিরা অনুমান করেছেন ‘পুজো-পরবর্তী পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাবের পরও সামগ্রিক পুজোর বাজার ন্যূনতম ৫০,০০০-৬০,০০০ কোটি টাকার মধ্যে নিশ্চিতভাবেই থাকবে, যা কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে আবারও স্পনসরশিপ অফার করতে উদ্বুদ্ধ করবে এবং ভোগ্যপণ্যের উপর বিবেচনামূলক ব্যয় তীব্রভাবে বৃদ্ধি পাবে।’ ইউনেস্কো কর্তৃক ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত শারদীয়া দুর্গোৎসব বাংলার জন্য একটি প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে ইতিমধ্যেই প্রমাণিত যা এবার খুচরো, আতিথেয়তা, পরিবহণ এবং হস্তশিল্প খাতের বিকাশ ঘটিয়ে ব্যবসায়িক কার্যকলাপের যথোপযুক্ত বাস্তবায়নের মাধ্যমে জিডিপির কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ অবদান রেখেছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২০২৫-এর শারদোৎসব যেন সামগ্রিকভাবে এক শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল বাংলার অর্থনীতিকে।
বাঙালি উৎসবপ্রেমী (durga puja)। সময়ের নিয়ম মেনে প্রতিবছর শরতের আকাশ পেঁজা তুলোয় রাঙিয়ে মর্ত্যলোকে আসবেন উমা। বঙ্গদেশ মেতে উঠবে বাঙালিয়ানার উচ্ছ্বাসে। কিন্তু শহরকেন্দ্রিক এক উৎসবকে আমজনতার উপার্জনের উদযাপন হিসেবে সত্যিই সর্বজনীন করে দিলেন আটপৌরে এক নারী। উৎসবের সাথে উপার্জনকে যদি সম্পৃক্ত না করা যায়, তা হলে তা হারায় নিজস্ব কৌলিন্য ও গ্রহণযোগ্যতা; তখন উচ্ছ্বাসে আর প্রাণ থাকে না। ত্রিশূল হাতে বুদ্ধিদীপ্ত পন্থায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়ে দিলেন গ্রামবাংলার দারিদ্র্য দমনের এক আদর্শ কৌশল। মমতাময়ী মায়ের দেখানো পথ ধরেই এই বাংলায় আগামীতে শুধু কলকাতা নয়, কাকদ্বীপ থেকে কাঁকসা— থাকবে মায়ের আবাহনের অপেক্ষায় আর এখানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌরোহিত্যের সার্থকতা— যেখানে গ্রাম-শহর, জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে একসাথে ঢাকের তালে ধুনুচি হাতে কোমর দোলায় গোটা বাংলা।