সঙ্ঘ পরিবার মতাদর্শগতভাবে মেয়েদের হীন চোখে দেখে, পুরুষের সমান মর্যাদা তাদের দেয় না, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্তরেও সঙ্ঘ মূলত পুরুষতান্ত্রিক ও পিতৃতান্ত্রিক। ২০১৪ সালে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপিশাসিত রাজ্যে রাজ্যে মেয়েদের উপর অত্যাচার কতটা বেড়েছে, তা সাম্প্রতিক এনসিআরবির কেন্দ্রীয় রিপোর্টেই প্রকাশিত। রিপোর্ট অনুযায়ী এই নিয়ে পরপর মোট চারবার দেশের নিরাপদতম শহর কলকাতা। বিজেপির প্রোপাগান্ডা মেশিনারি অল্প কিছু ঘটনাকে হাতিয়ার করে যতই বাংলায় মেয়েদের সম্মান লুন্ঠিত হচ্ছে বলুক, এটাই বাস্তব যে, মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে বাংলার সরকার বিগত দেড়দশকব্যাপী একধরনের সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছে বলেই এখনও বাংলা মেয়েদের জন্য নিরাপদ। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকার আসার পর মেয়েদের উপর অত্যাচার, হিংসা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিছু নতুন অপরাধের প্রবণতাও বেড়েছে। যেমন, দলবদ্ধ ধর্ষণের লাইভ ভিডিও ভাইরাল করা বা গ্যাংরেপের ভিডিও বিক্রির চোরাবাজার। অতি সম্প্রতি ধর্ষণের পর অপরাধী যুবক গুলি করে ধর্ষিতাকে হত্যা করছে এরকম ভিডিও ভাইরাল করানো হচ্ছে। উত্তর-পশ্চিম ভারতের উচ্চবর্ণবাদী পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় যে নারীবিদ্বেষী, বিশেষত দলিত নারীবিরোধী হিংস্র সমাজমন এখনও বিপুল সক্রিয়, এইসব ভিডিও তারই প্রমাণ। উল্টোদিকে বাংলা মাতৃতান্ত্রিক দেশ। এখানে আবহমানকালব্যাপী শাক্তসাধনা ও মাতৃকা-আরাধনা প্রচলিত। স্বাধীন পশ্চিমবঙ্গদের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একের পর এক সরকারি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন।
আরও পড়ুন-কোন মুখে বড় বড় কথা বলেন মোদি? গেরুয়া ওড়িশাতেই গুলিতে নৃশংসভাবে খুন হলেন বিজেপির আইনজীবী নেতা
এক্ষেত্রে একটা কথা স্পষ্ট বোঝা দরকার। পশ্চিমবঙ্গ কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়। এটি একটি অঙ্গরাজ্য। রাজ্যের আর্থিক ও অন্যান্য শক্তি সীমাবদ্ধ। বিশেষত বিজেপির মতো একটি আগ্রাসী কর্তৃত্ববাদী শক্তি একদশকের উপর ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর এমনকী রাজ্যের নিজস্ব সীমিত উদ্যোগে নেওয়া জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত করার কাজেও ক্রমাগত বাধা দিয়ে চলেছে। ঠিক এই জায়গাতেই মমতা ব্যানার্জির বিকল্প উন্নয়ন-ভাবনা রাজ্যের ব্যাপক সংখ্যক মানুষের জন্য কার্যকরী হচ্ছে। রাজ্য সরকার যে প্রায় ৯৪টা জনকল্যাণমূলক প্রকল্প চালাচ্ছে কেন্দ্রের কাছে ১ লক্ষ ৯৫ হাজার কোটি টাকার বিপুল বকেয়া থাকা সত্ত্বেও, তার মধ্যে অনেকগুলো প্রকল্পই সরাসরি নারী-উন্নয়নের স্বার্থে। সেটা ‘মাতৃ মা প্রকল্প’, ‘কন্যাশ্রী’, ‘স্বপ্নভোর’, ‘স্বাবলম্বন’, ‘আনন্দধারা’ প্রকল্পের আওতায় ‘বহুমুখী প্রাথমিক মহিলা সঙ্ঘ সমবায়’, ‘সৃষ্টিশ্রী’, ‘খাদ্যছায়া’, ‘বাংলাশ্রী’, মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত অজস্র ‘হোম স্টে’, ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’, ‘রূপশ্রী’, ‘তেজস্বিনী’, ‘সুকন্যা’, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’র মতো প্রকল্প যেগুলো সরাসরি মেয়েদের উন্নয়নকল্পে ব্যবহৃত। এমনকী ‘বাংলার বাড়ি’ প্রকল্পের টাকাও বাড়ির মেয়েদের অ্যাকাউন্টে যাচ্ছে। মমতা ব্যানার্জি একজন ‘ভিশনারি’, রাজনৈতিক স্বপ্নদ্রষ্টা। এই প্রকল্পগুলো তারই ফল। তাঁর সরকার সরাসরি মেয়েদের পাশে দাঁড়াবার বার্তা দিচ্ছে বলেই বাংলা মেয়েদের জন্য গোটা ভারতে ‘সেফ জোন’।
২০১৪ সালে উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ তাঁর নিজস্ব ওয়েবসাইটে নিজের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। লেখাটির শিরোনাম— ‘মাতৃশক্তি ভারতীয় সংস্কৃতি কে সন্দর্ভ মে’। এই নিবন্ধে যোগীজি একেবারে সঙ্ঘের নিজস্ব ভাবধারাতেই চূড়ান্ত নারীর ক্ষমতায়নবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল কিছু মন্তব্য করেছিলেন, যা নিয়ে সমকালীন ভারতীয় রাজনীতিতে ঝড় বয়ে যায়। এতে যোগীজি লিখেছিলেন—“শাস্ত্রে নারীদের সুরক্ষা দেবার কথা বলা হয়েছে। যেমন উর্জার (শক্তি) অবাধে এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে ধ্বংসের কারণ হয়, তেমনি নারীদেরও স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই, তাদের সুরক্ষা এবং সঠিক চ্যানেলাইজেশনের প্রয়োজন। স্ত্রীশক্তি সন্তানের সময় পিতা, প্রাপ্তবয়স্ক হলে স্বামী এবং বৃদ্ধ বয়সে পুত্র দ্বারা সুরক্ষিত। নারীদের স্বাধীন বা মুক্ত রাখা যায় না”। স্পষ্টতই উত্তর ভারতের ‘গোবলয়ের’ মাটিতে পশ্চাৎপদ সামন্তবাদী, মনুবাদী জলহাওয়ায় মেয়েদের সম্পর্কে এ-ধরনের ভাবধারার বহিঃপ্রকাশ খুব একটা অস্বাভাবিক নয়। এই সেই যোগী আদিত্যনাথ যিনি মুখ্যমন্ত্রী হবার পর সন্ধের পর নির্দিষ্ট সময়ে মেয়েদের কোচিং সেন্টার থেকে বাড়ি ফেরার নিদান দিয়েছিলেন এক জনসভায়, যা নিয়ে তুমুল শোরগোল হয়েছিল। পূর্বোক্ত নিবন্ধটিও যোগীজি তাঁর ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হন প্রবল সমালোচনার মুখে পড়ে। গোটা উত্তরপ্রদেশে প্রাত্যহিক নারী-ধর্ষণ ও নারী-অবমাননার ক্রমবর্ধমান প্রবণতার সঙ্গে এই মধ্যযুগীয় সামন্তবাদী মানসিকতার প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে।
ঠিক এর বিপরীত ভাবনা মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির। তাঁর লেখা সাম্প্রতিক বই ‘লিপিবদ্ধ কিছু কাজ’-এর একটি অধ্যায় ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে’ থেকে খানিকটা অংশ তুলে ধরছি— ‘আমি নিজে একজন নারী। এ রাজ্যে মা-মাটি-মানুষের সরকার গঠন করার অনেক আগে থেকে আমি সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত, ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রক সামলেছি। দীর্ঘদিন লোকসভার সাংসদ থেকেছি। দেশের এবং রাজ্যের কোনায় কোনায় গেছি। লক্ষ্য করেছি আমাদের দেশ তথা বাংলায় আমার মা-বোনেদের অবস্থা। যত দেখেছি তত খারাপ লেগেছে। অসহায় লেগেছে তাদের সামাজিক্ শৃঙ্খল দেখে, ভিতর থেকে অনুভব করেছি নারীদের আর্থিক স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা। পরিবারে তাঁদের সম্মানের প্রয়োজনীয়তা, আর সর্বোপরি নারীদের নিজের কাছে নিজের গুরুত্ব বুঝতে শেখা। সর্বদা তাই মনে হত যদি কখনো রাজ্যে ক্ষমতায় আসি, নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করব আমাদের রাজ্যের মেয়েদের সার্বিক উন্নয়ন ঘটাতে।’ এই ভাবনার প্রত্যক্ষ ফলাফলই ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নারী-উন্নয়নে একের পর এক সাফল্য।
আরও পড়ুন-সুপ্রিম নির্দেশ, বিজেপি নেতা টেনি ও ছেলের বিরুদ্ধে এফআইআর
এই মুহূর্তে বাংলার ১২৭টি পৌরসভায় নির্বাচিত মহিলা কাউন্সিলরের সংখ্যা ১১১৪ যা মোট আসনের ৪২ শতাংশের বেশি। জেলা পরিষদে মহিলা সদস্য ৫৬%, পঞ্চায়েত সমিতিতে ৫৩%, গ্রাম পঞ্চায়েতে ৫৫%। রাজ্য বিধানসভায় মহিলা বিধায়কের সংখ্যা ৪৪ এবং রাজ্য থেকে নির্বাচিত সাংসদের মধ্যে ১১ জন মহিলা। সবচেয়ে বড়ো কথা মমতা ব্যানার্জি নিজে যেমন অত্যন্ত সাধারণ ঘর থেকে মাটি কামড়ে লড়াই করে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় এসেছেন, তেমনই গ্রাম-শহরের অতিসাধারণ মেয়েদের মনের কথাটি তিনি বোঝেন। এখানেই সংঘী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বাংলার নারীসমাজের ‘দিদি’ই হয়ে উঠেছেন প্রতিরোধের দেয়াল।