বাতের ব্যথায়

বাতের ব্যথার এখন আর কোনও বয়স-সীমা নেই। যে-কোনও বয়সের মানুষ এই সমস্যা নিয়ে অতিষ্ঠ। এমন এক বিরক্তিকর রোগ না কমে, না নির্মূল হয়। সামনেই ওয়ার্ল্ড আর্থ্রাইটিস ডে বা ‘বিশ্ব বাত দিবস’। রিউম্যাটিক অ্যান্ড মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজিজ সম্পর্কে বিশ্ব জুড়ে সচেতনতা বাড়াতে এই দিনāটি পালিত হয়। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

সদ্য দুর্গাপুজো শেষ হল। এই ক’দিন দিন-জেগে, রাত-জেগে হেঁটে ঠাকুর দেখতে গিয়ে পায়ের পুরনো ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠেছে অনেকেরই। আট থেকে আশি না হলেও পঁচিশ, তিরিশ বছর বয়স থেকেই ইদানীং বাতের ব্যথায় ভুগছেন নারী-পুরুষ নির্বিশেষ। এই ব্যথার না আছে স্বস্তি না আছে কোনও সমাধান। কোমরে ব্যথা বা পিঠ ব্যথা, হাত ব্যথা সবকিছুরই কারণ হতে পারে বাত। সামনেই ‘বিশ্ব বাত দিবস’ বা ‘ওয়ার্ল্ড আর্থ্রাইটিস ডে’। রিউম্যাটিক অ্যান্ড মাস্কুলোস্কেলিটাল ডিজিজ (RMDs) সম্পর্কে বিশ্ব জুড়ে সচেতনতা বাড়াতে এই দিনটি পালিত হয়। সোজা বাংলায় বাত বা আর্থ্রাইটিস। ১৯৯৬ সাল থেকেই আর্থ্রাইটিস অ্যান্ড রিউম্যাটিজম ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে প্রতি বছর ১২ অক্টোবর দিনটি পালিত হয়ে আসছে। বাতের ব্যথায় ভুগছেন না এমন মানুষ এখন বোধহয় খুব কম আছেন। ভারতে প্রায় ২০ কোটি মানুষ অস্টিওআর্থ্রাইটিসে ভুগছেন। বিশ্ব জুড়ে ৪০ কোটির বেশি মানুষ এই রোগে ভুগছেন। ৬০ বছরের উপরে ১৮ শতাংশ মহিলা ও ৯.৬ শতাংশ পুরুষ বাতের ব্যথায় ভুগছেন। (WHO) ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশনের সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় ২৫% মানুষের পঙ্গুত্বের অন্যতম প্রধান কারণ আর্থ্রাইটিস। অলিম্পিক্স পদকজয়ী সাইনা নেহাওয়াল ৩৪ বছর বয়সেই ভাবতে শুরু করেছেন অবসর নেওয়ার কথা। শোনা গেছে বাতের ব্যথার কারণেই এই সিদ্ধান্ত সাইনার।
আর্থ্রাইটিস আসলে কী
চিকিৎসকদের মতে, আর্থ্রাইটিস কোনও নির্দিষ্ট অঙ্গের ব্যথা নয় এটা একাধিক অঙ্গেই হতে পারে। এমনকী আঙুলের গাঁটে গাঁটে ব্যথা হলেও তাকে আর্থ্রাইটিসই বলা হয়। এই রোগটি কোনও আঘাত না লাগলেও দেখা দিতে পারে। আর্থ্রাইটিস আসলে হল অস্থিসন্ধির প্রদাহ। প্রায় একশোরও বেশি অস্থিসন্ধির রোগ রয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল অস্টিও আর্থ্রাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এছাড়া সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস এবং গেঁটেবাত ইত্যাদিও হয়। তবে প্রথম দুটিই অনেক বেশি। আর্থ্রাইটিস অস্থিসন্ধিকে প্রভাবিত করে এর ফলে ব্যথা, ফোলাভাব, শক্ত হয়ে যাওয়া এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই নির্দিষ্ট কার্যকারিতা কমে যাওয়া ইত্যাদি দেখা যায়।

আরও পড়ুন-কোন মুখে বড় বড় কথা বলেন মোদি? গেরুয়া ওড়িশাতেই গুলিতে নৃশংসভাবে খুন হলেন বিজেপির আইনজীবী নেতা

আর্থ্রাইটিসের ধরন
আর্থ্রাইটিসের সবচেয়ে প্রচলিত রূপ অস্টিও আর্থ্রাইটিস। প্রায়শই বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অস্থিসন্ধির তরুণাস্থির ক্ষয় হতে থাকে এবং ব্যথা শুরু হয়। অন্যদিকে, আর্থ্রাইটিস জিনগত কারণেও হয়। পরিবারের কারও থাকলে, পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও তা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার এক ধরনের আর্থ্রাইটিস হয় আমাদের ইমিউন সিস্টেমেই অর্থাৎ যে শক্তি শরীরে রোগ প্রতিরোধ করে, সেটিই টিস্যু-মাসলের জন্য ক্ষতিকারক অ্যান্টিবডিও তৈরি করে। একে বলে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস একটি অটোইমিউন রোগ এটা হলে আমাদের রোগ প্রতিরোধ শক্তি অস্থিসন্ধিগুলোয় আক্রমণ করে, যার ফলে প্রদাহ তৈরি হয়। যিনি শারীরিক ভাবে অতি-সক্রিয় যেমন ফুটবল খেলোয়াড় তাঁদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়েই হাঁটুতে অতিরিক্ত চাপ পড়ে ফলে আর্থ্রাইটিস হয়। আবার একটানা বসে কাজ করলে দৈনন্দিন হাঁটাচলা কম হলে, ওজন বেড়ে গেলে আর্থ্রাইটিসের প্রবণতা বাড়ে। একটি পরিসংখ্যান বলছে, ভারতে রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আক্রান্ত হওয়ার হারও অন্যান্য দেশের থেকে বেশি। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে হিপ জয়েন্ট বিকৃত হয়ে হাঁটা-চলা বন্ধ হয়ে যায়, অন্য দিকে যন্ত্রণায় খুব কষ্ট পেতে হয়। হিপ ফ্র্যাকচার, সেপটিক আর্থ্রাইটিস, বোন ডিসপ্লেশিয়া-জাতীয় সমস্যা হলে একদিকে স্থবির হয়ে বসে থাকতে হয়, অন্য দিকে ব্যথার কষ্টে জীবন শেষ হয়।
কী করে বুঝবেন কোন বাত
বয়সের কারণে যে বাতের ব্যথা বা আর্থাইটিস হয় তার বেশিটাই শরীরে অতিরিক্ত চাপ পড়ার কারণে। এগুলো হয় সাধারণত হাঁটু, কোমর, শিরদাঁড়ার অস্থিসন্ধিতে। এতে কার্টিলেজ নষ্ট হয়। কার্টিলেজ কী? অস্থিসন্ধি বা দুটি হাড়ের সংযোগস্থলে অর্থাৎ, হাড়ের আগায় সাদা রঙের রবারের মতো দুটি তন্তুর মতো বস্তু থাকে। এদের কাজ অস্থিসন্ধির দুটি হাড়ের মধ্যে ঘর্ষণ কমানো। তা ছাড়া কোনও আঘাত লাগলে এগুলি ‘শক অ্যাবজরভার’ হিসাবে কাজ করে। এটাই কার্টিলেজ। কোনও কারণে ওই কার্টিলেজ ক্ষয়ে গেলে হাড়ের ক্ষয় শুরু হয় এবং বাতের উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করে। অস্থিসন্ধির মধ্যে থাকা ফাঁকা জায়গা ছোট হয়ে আসে। এই ধরনের আর্থ্রাইটিস অপেক্ষাকৃত কম বিপজ্জনক। এটা অস্টিও আর্থ্রাইটিস। এর উপসর্গ হল সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট, উঠতে, বসতে ব্যথা, টানা বসে থাকলে অথবা ঘুম থেকে ওঠার পরেও হাঁটুতে ব্যথা। আবার হাঁটু ভাঁজ করতে গেলেও কষ্ট। ঘুমের মধ্যেও ব্যথায় ঘুম ভেঙে যেতে পারে।
দ্বিতীয় ধরনের আর্থ্রাইটিস দ্রুত চিহ্নিত করা জরুরি। কারণ, এখন ওষুধের মাধ্যমে ওই আর্থ্রাইটিসের সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। কিন্তু যদি চিকিৎসায় দেরি হয়, তবে অস্ত্রোপচার জরুরি হয়ে পড়ে। এটা হল রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস। যা কম বয়সেও আগাম সংকেত না দিয়েও হতে পারে। হাঁটু বা হিপে থাকা অস্থিসন্ধি ক্ষয় হতে হতে এমন পর্যায়ে চলে যায় যে সেই ব্যক্তি চলাফেরা পর্যন্ত করতে পারেন না। সঙ্গে থাকে অস্বাভাবিক ব্যথা। আক্রান্তদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মান নেমে যায়। অথচ সঠিক চিকিৎসার সাহায্য নিলেই ব্যথার এই কষ্ট কমিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা যায়।

আরও পড়ুন-মন্তেশ্বরে বিজয়া সম্মিলনীতে জনজোয়ার, জেলার সব আসনে জেতানোর আহ্বান

খাওয়াদাওয়া
ভিটামিন-ডি এবং ক্যালসিয়ামের অভাবে বাতের রোগ হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তা ছাড়া ফ্যাট জাতীয় খাবার বেশি খাওয়ার ফলে ওজনও বেড়ে যায়। দেহের ওজন বাড়লে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
বাতের হাত থেকে সম্পূর্ণ রেহাই পাওয়ার কোনও ওষুধ বা পদ্ধতি এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। ওযুধ প্রয়োগ করে বাতের সমস্যাগুলি থেকে সাময়িক রেহাই মিলতে পারে। রোগ যাতে না বাড়ে তার জন্য নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে। ফিজিওথেরাপি করতে হবে। কয়েক ধরনের সাপ্লিমেন্ট রয়েছে যেগুলো খেলে বাতের ব্যথা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকে।
এমন কোনও নির্দিষ্ট ওষুধ নেই যা প্রয়োগে বাত সেরে যেতে পারে। যদি রোগীর দৈনন্দিন কাজে অসুবিধা হয় বা প্রতিদিন ব্যথার ওষুধ খেতে হয়, তখন অস্ত্রোপচার একমাত্র পথ। যাকে ‘জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট’ বলে। সেক্ষেত্রে হাড়ের আগায় ঘষা লেগে ক্ষয়ে যাওয়া অংশগুলিকে বাদ দিয়ে বাইরে থেকে ধাতব অংশ বসানো হয়।

Latest article