গেরুয়া কুনাট্য

অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। চিত্রনাট্যের ছাপ তাতে স্পষ্ট। লিখছেন সত্যান্বেষী সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

ক্রমশ স্পষ্টতর হচ্ছে। কমলকুমার মজুমদারের ‘অন্তর্জলি যাত্রা’র ভাষা ধার করে বললে বলতে হয়, আলো ক্রমে আসিতেছে।
প্রসঙ্গ, উত্তরবঙ্গের নাগরাকাটা কাণ্ড।
খগেন মুর্মু ও শঙ্কর ঘোষের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ঘটনা।
ঘটনা না দুর্ঘটনা নাকি কাঁথির মেজ খোকার করে দেওয়া একটি দুর্বল চিত্রনাট্যে দুই শিশু শিল্পীর অভিনয়!
ঘটনাক্রমটা পুনর্বীক্ষণ করা যাক!
৪ অক্টোবর, ২০২৫। হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, জম্মু ও কাশ্মীর, পাঞ্জাবের পর লন্ডভন্ড উত্তরবঙ্গের পাহাড়-ডুয়ার্স। সঙ্গে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত সিকিম এবং প্রতিবেশী দেশ নেপাল ও ভুটান। সব মিলিয়ে চারদিকে শুধুই ধ্বংসের চিহ্ন। এক লহমায় ম্লান মলিন হয়ে গিয়েছে উৎসবের পরিবেশ। ভয়াবহ বিপর্যয়ের ধাক্কায় মিলিয়ে গিয়েছে বাসিন্দাদের মুখের হাসি। দুধিয়া-মিরিক, দার্জিলিংয়ের বিজনবাড়ি বা জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা, বানারহাট, গয়েরকাটা, ক্রান্তি­—সর্বত্রই হাহাকার। বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। প্রবল বর্ষণ ও ধসের কারণে রবিবারই পাহাড় ও ডুয়ার্স মিলিয়ে ২৮ জনের প্রাণহানির খবর মিলেছিল। সোমবার নাগরাকাটার বামনডাঙা চা-বাগানের মডেল ভিলেজ থেকে পুলিশ উদ্ধার করেছে আরও চারটি মৃতদেহ। এগুলি ধরলে ওই অঞ্চল থেকে মোট নয়টি মৃতদেহ উদ্ধার হল। পাশাপাশি, তোর্সা নদীতে ভেসে এসেছে আরও দুটি দেহ। কোচবিহারের পুন্ডিবাড়িতে উদ্ধার হওয়া দেহ দুটির পরিচয় ওইদিন পর্যন্ত অজ্ঞাতই ছিল। জলঢাকার স্রোতে কোচবিহারের মাথাভাঙা-১ ব্লকের জোড়শিমুলিও বিধ্বস্ত। সেখানে রবিবার পুকুর ও নদীতে তলিয়ে যাওয়া দু’জনের দেহ সোমবার উদ্ধার হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন বালক এবং অন্যজন বৃদ্ধ। সব মিলিয়ে ডুয়ার্স এলাকায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬! আরও অনেকে নিখোঁজ বলে অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে প্রশাসন সূত্রে। দার্জিলিংয়ের বিজনবাড়ি ও সিওক অঞ্চলে নিখোঁজ দু’জন। নাগরাকাটার বামনডাঙাতেও বিপর্যয়ের পর থেকে বেশ কয়েকজনের হদিশ মিলছে না। স্বজন হারানোর হাহাকার সর্বত্র। জলের তোড়ে ভেসে গিয়েছে বহু বাড়িঘর, গবাদি পশু। ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ।
তাঁদের ভরসা কেবলই সরকারি সহায়তা। এবং সেই সহায়তা, ত্রাণ ও আশ্বাস নিয়ে পাহাড়ে পৌঁছে গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে রাজ্যের মা-মাটি-মানুষের সরকারি টিম। তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং মন্ত্রীরা ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলে পড়ে থেকেই এই কাজে প্রশংসনীয় তদারকি করে চলেছেন।
এই আবহে ঘটে গেল একটি ঘটনা। অপ্রীতিকর, অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত।
দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর নাম করে কনভয় নিয়ে হাজির হলেন বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু এবং বিধায়ক শংকর ঘোষ, সঙ্গে বিজেপির কিছু কর্মী-সমর্থকও। ত্রাণ দেওয়ার কথা মুখে বললেন, কিন্তু তাঁদের গাড়িতে কোনও ত্রাণসামগ্রী নেই।
নগরাকাটার সুলকাপাড়ায় তাঁরা গাড়ি থেকে নামতেই ক্ষুব্ধ দুর্গত নরনারীরা তাঁদের ঘিরে ধরেন। কেন তাঁরা এত দেরিতে এবং কোথায় বিজেপির স্থানীয় নেতৃত্ব— এই সংগত প্রশ্ন তুলে তাঁরা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। দুর্গত মানুষজনকে সামনে রেখে কদর্য ফটোশ্যুটকে কেউই ভালো চোখে দেখেননি। অতঃপর কী কী ঘটল? টিভি চ্যানেলের ক্যামেরায় আমরা কী দেখলাম?

আরও পড়ুন-আদিবাসী বলেই আমার কেক খাওয়া নিয়ে বিদ্রুপ

পরিস্থিতি বেগতিক বুঝে এমএলএ-এমপি তাঁদের দলবল-সহ যখন গাড়ি ঘুরিয়ে পাততাড়ি গোটাবার মতলবে ছিলেন অমনি তাঁদের উপর জনরোষ আছড়ে পড়ল। তাতে এমপি জখম হন বলে অভিযোগ।
আমরা দেখলাম মানুষ জুতো ছুঁড়েছে শংকরবাবুর দিকে আর খগেনবাবুকে ধাক্কা মেরে গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। সরকারি নিরাপত্তারক্ষীদের তৎপরতায় অবশ্য বিজেপির লোকজন স্থানত্যাগ করেন। এবং শুধু নাগরাকাটায় নয়, ত্রাণ দেওয়ার নাটক করতে গিয়ে ডুয়ার্স-সহ উত্তরবঙ্গের আরও একাধিক স্থানে বিজেপি নেতৃত্ব ক্ষুব্ধ মানুষের অপ্রিয় প্রশ্নাবলি এবং ক্ষোভের মুখে পড়েছেন। এর পর আর কী কী দেখা গেল এবং জানা গেল?
যে লোকটার গাড়িতে ওঠার সময় পর্যন্ত গায়ে একটা কাদার দাগও দেখা যায়নি সেই লোকটার গাড়িতে উঠেই নাকি রক্তাক্ত হয়ে গেল। অভিযোগ, বিক্ষোভকারীদের ইটের আঘাতে ওঁদের গাড়ির কাচ ভেঙেছিল। কিন্তু বাস্তব বুদ্ধি বলছে, ১) স্কর্পিও গাড়ির কাচ ভেঙে কেউ অমন রক্তাক্ত হতে পারেন না।
২) সঙ্গের কেন্দ্রীয় নিরাপত্তারক্ষী যদি বিধায়ক সাংসদের নিরাপত্তা না দিতে পারে তবে ওরকম হীনবল রক্ষীদের তো চাকরি ‘not’ হওয়া উচিত। সুতরাং, পুলিশ জেরা করুক সঙ্গের ওই অপদার্থগুলোকে। সশস্ত্র নিরাপত্তা রক্ষী তো দু’জনেরই ছিল। তবু গাড়িতে উঠেই একজন রক্তাক্ত হলেন! আর একজনের স্রেফ হাতের কার্টিলেজে চোট লাগল (ডাক্তারি রিপোর্ট মোতাবেক। তবে কি গাড়ির ভেতরেই সংসদকে কেউ পেটালেন? না কি তাঁকে টমেটোর সস মাখলেন? সেটা পুলিশ অনুসন্ধান করুক। আমরা চাই এই নাটকের যবনিকা পতন হোক। আর যেন কেউ এই ধরনের নোংরা রাজনীতি করতে সাহস না পায়।
৩) কোনও কোনও মহল থেকে শোনা যাচ্ছে, বিধায়ক শঙ্কর ঘোষের ‘ব্যথা’ করছিল বাম হাতে, ডান হাত দিব্যি সচল স্বাভাবিক ছিল। নার্স বারবার বাম হাতে তুলো দিয়ে কিছু মোছার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু কিছু খুঁজে পাচ্ছিলেন না। আর উনি অর্থাৎ শিলিগুড়ির বিজেপি বিধায়ক প্রাণপণে গলার গামছা দিয়ে চে গুয়েভারার ট্যাটু লুকোনোর চেষ্টা করছিলেন। শিলিগুড়ির নেওটিয়া হাসপাতালের ছবি। নিন্দুকদের বক্তব্য, শঙ্কর ঘোষের ঘণ্টাখানেক আগের এক্কেবারে সচল স্বাভাবিক ডান হাত ঢুকে গেল ব্যান্ডেজে আর ‘ব্যথা’ লাগা বাম হাত হয়ে গেল এক্কেবারে সচল স্বাভাবিক! এ তো পি সি সরকারের জাদুকেও হার মানিয়ে দেওয়ার‌ মতো ব্যাপার!
৪) বাংলায় তুলনামূলকভাবে উত্তরেই বিজেপির প্রভাব কিছুটা বেশি। আর সেখানেই তাদের ‘জনপ্রিয়তার’ এই দশা দেখে ছাব্বিশের ভোটের আগে গেরুয়া শিবির যে বিরাট হতাশ তা অনুমেয়। কিন্তু এর দায় নিজেরা নেওয়ার পরিবর্তে তা সটান চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যের শাসক দলের ঘাড়ে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের এবং গভীরতর উদ্বেগের বিষয় যে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় নিয়ে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নেন, কোনও উপযুক্ত অনুসন্ধানের জন্য অপেক্ষা না করেই। তা-ও আবার সেই সময়, যখন উত্তরবঙ্গের মানুষ ভয়াবহ বন্যা ও ধসের সঙ্গে যুঝছেন। যখন সমগ্র স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ ত্রাণ ও উদ্ধারের কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে, তখন। অথচ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ গোটা তৃণমূল কংগ্রেস দ্বিধাহীনভাবে হিংসার নিন্দা করেছে। মমতা নিজে হাসপাতালে গিয়ে খগেন মুর্মু ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন।
এরপরই ময়দানে আবির্ভাব গদ্দার কুলের পালের গোদা, মেজ খোকার। তিনি ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা সেই ক্লান্তিকর উত্তরবঙ্গ বনাম দক্ষিণবঙ্গের উপাখ্যানে ফিরতে চাইল, ভোটের আগে মেরুকরণের আশায়।
২০২৬ এর ভোটে তবে ফের স্পষ্ট হয়ে যাক: বাংলা এক— আবেগে, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে।
৫) পরিশেষে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া। তিনি দোষারোপ করেছেন কোনওরকম প্রমাণ ছাড়া, আইনানুগ কোনও তদন্ত ছাড়া এবং কোনও প্রশাসনিক রিপোর্ট ছাড়া। এটা শুধু রাজনৈতিক নিচুতা নয়, যে সাংবিধানিক নৈতিকতার শপথ প্রধানমন্ত্রী শপথ নিয়েছেন, সেই নৈতিকতারও লঙ্ঘন। গণতন্ত্রে আইন তার নিজস্ব পথ নেয় এবং কোনও ঘটনার দায় নির্ধারিত হয় যথাযথ প্রক্রিয়ায় কোনও রাজনৈতিক বেদির উচ্চতা থেকে করা একটি ট্যুইটের মাধ্যমে নয়। সংশ্লিষ্ট ঘটনা ঘটেছিল একটি কেন্দ্রে, যেখানে মানুষ নিজেরাই বিজেপির একজন বিধায়ককে নির্বাচন করেছেন। তথাপি এই ঘটনায় তৃণমূল কংগ্রেসের তথাকথিত ‘শক্তিমত্তা’ দেখতে পাওয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিস্ময়কর বলে মনে হল না! এই ধরনের অসার এবং অতি- সরলীকৃত সাধারণীকরণ শুধু অপরিণতই নয়, তা দেশের সর্বোচ্চ পদের সঙ্গে মানানসইও নয়। যে প্রধানমন্ত্রী মণিপুরে জাতি-হিংসা শুরু হবার ৯৬৪ দিন পরে সেখানে যাওয়ার অবকাশ পেয়েছিলেন, তাঁর কাছ থেকে বাংলার জন্য এই সহসা উদ্বেগ কোনও সমবেদনার পরিচয় নয়। বরঞ্চ, এটাকে সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নাটক বলেই মনে হচ্ছে।

Latest article