দেবী চৌধুরাণী

মুক্তি পেয়েছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কালজয়ী উপন্যাস ‘দেবী চৌধুরাণী’ অবলম্বনে পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্রের পিরিয়ডিক ড্রামা ‘দেবী চৌধুরাণী’। কে এই দস্যুরাণী! তিনি বাস্তব নাকি মিথ! ইতিহাস, স্বপ্ন, কল্পনা, জনশ্রুতির মেলবন্ধনে তৈরি এই ছবি কেমন হল। দেখে এসে লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু
দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে
যাত্রীরা হুঁশিয়ার’
এই মন্ত্র যুদ্ধেও সত্য আবার জীবনেও সত্য। পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’ (devi chowdhurani) ছবির শেষে ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজছিল এই গানটি। দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বড় প্রিয় এই গান। ‘দেবী চৌধুরাণী’ বাংলার এক দুর্ধর্ষ ডাকাতরানির রোমহর্ষক গল্প, রক্ত-গরম-করা এক দেশপ্রেমের, স্বাধীনতা সংগ্রামের কাহিনি। দেবী চৌধুরাণীকে বাঙালির জনমানসে চিরস্থায়ী করেছেন সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ‘আনন্দমঠ’, ‘দেবী চৌধুরাণী’ ও ‘সীতারাম’— এই তিনটিকে বঙ্কিমচন্দ্রের বিখ্যাত ‘ত্রয়ী উপন্যাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় তার মধ্যে অন্যতম এই ‘দেবী চৌধুরাণী’ (devi chowdhurani)। ১৮৮৪ সালে প্রকাশিত এই উপন্যাস এই ২০২৫-এও কত প্রাসঙ্গিক! এই নিয়ে তিনবার সেলুলয়েডে। ১৯৪৯ সালে সুমিত্রা দেবী অভিনীত, ১৯৭৪ সালে সুচিত্রা সেন অভিনীত এবং এ-বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘দেবী চৌধুরাণী’ মুক্তি পেল। এ ছবি যেন পুরুষতান্ত্রিকতার মাঝে নারীশক্তির উদযাপন, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে মাতৃতন্ত্রের সজোর প্রতিবাদ। এমন এক নারীর গল্প যে আমাদের ঘরের মেয়ে। বাংলার সেন্টিমেন্ট। বাংলার মাটির গন্ধ তাঁর গায়। কোন দক্ষিণী স্টান্ট নয় যিনি রানির মতো বিদ্যুতের ঝলকে তলোয়ার চালাতেন। তাই এখানেই মনে হয় শেষ হবে না ‘দেবী চৌধুরাণী’র চলচ্চিত্রায়ণ। এক কালাতীত গল্প, মিথ, ফ্যাক্টস, স্বপ্ন, ইতিহাস, জনশ্রুতি— সব মিলিয়ে এ এক এমন কাহিনি যা বারংবার দেখতে সমান আগ্রহী হবেন দর্শক আর বারবার তৈরি হবে এমন ছবি।
গল্পের প্রেক্ষাপট বাংলার সন্ন্যাসী-ফকির বিদ্রোহ। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের কয়েক বছর আগে সাল ১৭৭২ তখন বাংলার বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস। সেই সময় বাংলার শোচনীয় অবস্থা। সেই অবিভক্ত বাংলার রংপুরের সরলা পল্লিবালা প্রফুল্লর ডাকাতরাণী হয়ে ওঠা এবং তার স্বাধীনতা সংগ্রাম ছবির বিষয়। ছবিতে খোলা চুলে কপালে রক্ততিলক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা পরে তিনি যখন ইংরেজ বাহিনীকে দমন করতে যান, সত্যিই তাঁকে ‘দেবী’ মনে হয়। আজও জলপাইগুড়ির শিকারপুরের মন্দিরে ‘দেবী’ হিসেবেই পূজিতা হন ‘দেবী চৌধুরাণী’। জলপাইগুড়ি, বক্সার, শিকারপুর, বৈকুণ্ঠপুরের জঙ্গলমহল ছিল ডাকাতরাণী দেবী চৌধুরাণীর চারণভূমি। কথিত আছে তিনি নাকি রাণীর বেশে ডাকাতি করতেন। আর ধনী জমিদারদের লুঠ করে গরিব প্রজাদের অকাতরে সেই অর্থ দান করতেন। দেবীর গুরু দস্যু সন্ন্যাসী ভবানীচরণ পাঠক তাঁকে উদ্ধার করে নিজে হাতে দলের প্রধান মহিলা নেত্রী হিসেবে তৈরি করেছিলেন। দেবী চৌধুরাণীর জীবনে ভবানী পাঠকের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। ভবানী পাঠক ও তার দলবল রঙ্গরাজ, নিশি, দেবী চৌধুরাণী খাজনা আদায়ের নামে জমিদারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। শুধু তাই নয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিলেন। ছবি নিয়ে বেশ গবেষণা করেছেন পরিচালক বোঝাই যায়। ছবির চিত্রনাট্য, সংলাপ, সৃজন— সবটাই পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্রের। গল্পে অনেক সৃজনশীল বদল এনেছেন যেগুলো দেখলে কোথাও সুর-তাল কাটে না। জীবন্ত ইতিহাসকে টানটান করে বুনেছেন। এই ছবি যেন শেষ হয়েও ঠিক শেষ হয় না তাও ছবির শর্ত মেনে ক্লাইম্যাক্স রাখতেই হয় সেটা তোলা থাক যাঁরা এখনও ছবিটা দেখেননি তাঁদের জন্য।

আরও পড়ুন-সামনে SIR-আড়ালে NRC! বিস্ফোরক অভিযোগ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

ছবির নাম ভূমিকায় শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায় এককথায় দুর্দান্ত। গ্রামের সরলা সাহসী প্রফুল্ল থেকে ক্ষুরধার দস্যুরাণী হয়ে ওঠার প্রতিটা ধাপ গায়ে কাঁটা দেয়। তিনি কামব্যাক করলেন অনবদ্যভাবে। তবে এই ছবির ভরকেন্দ্র ভবানীচরণ পাঠক। তাঁকে দেখে একটা কথাই মনে হয় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় সত্যি কি ৬৩ বছরে পা রেখেছেন! এতটা ফিটনেস কী করে! পাগড়ি বাঁধা, রক্তবর্ণ পোশাক পরিহিত দুরন্ত এক দুস্য-সন্ন্যাসী। তিনিই এই ছবির নায়ক, গল্পের চালিকাশক্তি। বিদ্রোহী, দরিদ্রের মসিহা, দুর্দমনীয়। তাঁর যোগ্য সহযোগী দস্যুরাণী দেবী চৌধুরাণী। প্রসেনজিতের পাশে শ্রাবন্তী যেন চট্টোপাধ্যায় জানপ্রাণ লড়িয়ে দিয়েছেন। নিজেকে ‘দেবী চৌধুরাণী’ (devi chowdhurani) করে তুলতে সবটুকু ঢেলে দিয়েছেন। প্রসেনজিৎ এবং শ্রাবন্তীর অনবদ্য রসায়ন গোটা ছবি জুড়ে। দেশেপ্রেমের জয়গান, নিপুণ যুদ্ধকলা, শাণিত তলোয়ারে সম্মুখ সমর, দেশমাতৃকার প্রতি সমর্পণ, লালমুখো ইংরেজ এবং ইংরেজ তোষণকারী ও গরিবের রক্তশোষণকারী জমিদারদের ওপর প্রতিশোধ রক্ত গরম করে দেয়। সেই সঙ্গে লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস, মুনরো এবং ম্যাকেনঞ্জি সাহেবের বিরুদ্ধে মজনু শাহ আর ভবানী পাঠকের একযোগে লড়াই একতা ও সম্প্রীতির ভাবনাকে তুলে ধরে। নিশি চরিত্র বিবৃতি চট্টোপাধ্যায়ের উপরি পাওনা। তাঁর অভিনয় ভীষণভাবে মনে থেকে যাবে, রঙ্গরাজের চরিত্রে অর্জুন চক্রবর্তী অসাধারণ। সাগর-বউয়ের চরিত্রে দর্শনা বণিক খুব ভাল। দেবী চৌধুরাণীর শ্বশুর জমিদার হরবল্লভের চরিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তী সাবলীল। আবহ সঙ্গীত এবং সঙ্গীত এই ছবির আসল সম্পদ। সঙ্গীত পরিচালক বিক্রম ঘোষ সত্যিই অতুলনীয়। গান গেয়েছেন উজ্জয়িনী মুখোপাধ্যায় ও তিমির বিশ্বাস, ইমন চক্রবর্তী, দুর্নিবার সাহা প্রমুখ। ক্যামেরায় অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় দারুণ। সম্পাদনার জন্য প্রশংসা প্রাপ্য সুজয় দত্তরায়েরও।

Latest article