‘কাল্পনিক’ ‘বানানো’ সব শারদীয় উপন্যাস

উপন্যাস সর্বগ্রাহী। সার্থক শিল্পী জানেন যে মানুষের অন্তর্মুখিনতা বা হৃণ্ময়তা ও দ্বন্দ্বময়তাকে তিনি যখন সামাজিক মানুষের সম্পর্ক সূত্রে গ্রথিত করে দেখাতে চান, তখনই সেটা কবিতা কিংবা নাটক না-হয়ে উপন্যাস হয়ে ওঠে। উপন্যাস গদ্যে বর্ণিত কল্পিত আখ্যানের মাধ্যমে জীবন ব্যাখ্যা। সমকালের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম দুইজন, প্রচেত গুপ্ত ও স্মরণজিৎ চক্রবর্তী তাঁদের সর্বশেষ প্রকাশিত উপন্যাসে কীভাবে এই সৃজন-দর্শন রূপায়িত করেছেন এবারের দুটি পত্রিকার পুজো সংখ্যায়, তারই আলোচনায় দেবাশিস পাঠক

Must read

দুটি বই। ‘আনন্দলোক’, পূজাবার্ষিকী ১৪৩২ এবং ‘দেশ’, শারদীয় ১৪৩২৷ জঁরের দিক থেকে দুটির অবস্থান পরস্পর বিপরীত৷ যদিও দুটি একই সংবাদপত্র সংস্থার শারদীয়া সংখ্যা৷ ‘আনন্দলোক’ বিনোদন জগতের পত্রিকা হিসেবে স্বীকৃত আর ‘দেশ’ সাহিত্য-বিষয়ক পত্রিকা রূপে মান্যতাপ্রাপ্ত৷

আরও পড়ুন-পরিস্থিতি ব্যয়সঙ্কুল, কেনাকাটা কমাচ্ছেন ৪০% ভারতীয় গ্রাহক

কিন্তু এই দুটি পত্রিকাতেই পাওয়া গেল পুজোর সময়কার সেরা উপন্যাসগুলো৷ ‘দেশ’ অভিজাত সাহিত্য পত্রিকা৷ তাই তাতে উপন্যাসের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত বেশি৷ একেবারে আধডজন৷ এতে আছে স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর ‘বাউল সুতো’, নলিনাক্ষ ভট্টাচার্যের ‘যেমন দেখেছি তাকে’, সুবর্ণ বসুর ‘ধূম্রলোচন’, অভিনন্দন সরকারের ‘পথিকের ঘরবাড়ি’, শ্যামলী আচার্যের ‘ছায়াপথ’ এবং শান্তনু দে-র ‘অলীক যাপন’৷ পক্ষান্তরে বিনোদন জগতের পত্রিকা হিসেবে ‘আনন্দলোক’-এর সূচিপত্রে সিরিয়াস সাহিত্যের গম্ভীরতার চেয়ে খানিকটা লঘুতা ঈপ্সিত৷ সেই হিসাবে, এখানে উপন্যাসের সংখ্যা মোটে দুটি৷ প্রচেত গুপ্তের ‘সোনাইগঞ্জের উপাখ্যান’ এবং অন্বেষা রায়ের ‘পুষ্পবতী’৷
পরিচিতি অনুযায়ী লঘুতাব্যঞ্জক পত্রিকার পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত হলেও ‘সোনাইগঞ্জের উপাখ্যান’ একটি আশিরনখ সেই গোত্রীয় উপন্যাস, যে ধরনের উপন্যাস একদা বাংলাতে তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়রা লিখতেন৷ আক্ষরিক অর্থে এই উপন্যাস একটি কাল্পনিক স্থানের বিবর্তনের আখ্যান৷ একেবারে শুরুতেই ঔপন্যাসিক পটচিত্রের পরিচিতি দিয়েছেন একেবারে চিত্রনাট্যের অনুপুঙ্খতায়৷ আর সেখানেই সামান্য একটি বাক্যাংশের সাহায্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন কাহিনির আরম্ভ ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতবর্ষে৷
ব্রিটিশ শাসকের শাসনের রাশ তখন অনেকটা ঢিলে৷ সবকিছু সুনির্দিষ্ট যথাবিহিত নিয়মে চলছে না৷ শাসক সেটা টের পাচ্ছে, কিন্তু কার্যত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে৷ কারণ, দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলার চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বের ক্ষয়িষ্ণু দশা৷ ‘ইংরেজ সরকারের… ডাকাতি ঠেকানোর ক্ষমতা নেই৷ … দেশের সর্বত্র খুন-জখম, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের এখন রমরমা৷ সাহেবদের এসব নিয়ন্ত্রণে নেই৷ তারা নিজেদের ‘গদি সামলাতে মন দিয়েছে৷’ কারণ, শ্বেতাঙ্গ-শাসক টের পাচ্ছে উপপ্লবের আঁচে তাদের ক্ষমতার আসন, তাদের রাজদণ্ড দ্যুতি হারাচ্ছে৷ সারা দেশে একটা টালমাটাল পরিস্থিতি৷ অশান্তির আবহ৷ ‘‘দিল্লিতে যেমন ব্রিটিশ শাসকের বিরুদ্ধে দেশের নেতাদের চাপ বেড়েছে, দেশের এদিক-ওদিক স্বাধীনতার লড়াইও বেড়েছে৷ অসহযোগ, বয়কট এসব তো রয়েছেই, তার ওপর উৎপাত বেড়েছে দাঙ্গা হাঙ্গামার৷ যারা ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ বলে সশস্ত্র লড়াইতে মেতেছে, তারাও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে৷ চোরাগোপ্তা হামলা বাড়িয়েছে৷ দেশের লোক ওদের বলছে ‘বিপ্লবী’, ইংরেজরা বলে ‘টেররিস্ট’৷”

আরও পড়ুন-বিজয়া সম্মিলনী থেকে বিজয় সম্মেলনের ভিত্তিপ্রস্তর

নির্দিষ্ট সন-তারিখের ফাঁস কাটিয়ে এ এক বৃহৎ সময়–প্রেক্ষিত৷ ভারতের স্বাধীনতা-পূর্ব অবস্থার এক বিরাট সময় পর্ব৷ এই কালপর্বের আধারে জেগে ওঠে প্রেম, শরীরী তাপ, দেওয়া-নেওয়া শরীর ও মনের৷ বিষ্ণুর ও সন্ধ্যার, বৈদ্যনাথ ও পারুল, শান্ত পাল ও কমলিকা৷ এবার সুনির্দিষ্ট সময়সীমায় আটকে পড়া, পারস্পরিক সম্বন্ধযুক্ত নরনারী নয়৷ তাই গল্প এগিয়ে পিছিয়ে এগোয়৷ সরলরৈখিক সম্মুখচলনে সীমায়িত হয় না৷ ফলে, এ গল্প ছেড়ে ও গল্পে শীতলপাটি বিছোতে হয়৷ সেখান থেকে খানিকটা এগিয়ে দিয়ে, কিংবা খানিক দূর পিছিয়ে গিয়ে৷ সময়ের নিরিখে৷ কিন্তু আখ্যানভূমি ধ্রুবক৷ সোনাইগঞ্জ ছেড়ে অন্য কোথাও সরে না৷ ঔপন্যাসিক নিজেও জানেন সে কথা৷ লেখেন, ‘সোনাইগঞ্জের উপখ্যান বলতে গিয়ে অনেক আগুপিছু হয়েছে৷ বেশ কিছু বছর এগিয়ে এসে উপাখ্যান শেষ করলে কেমন হয়?’
লেখকের অঙ্গুলি নির্দেশে কাহিনি পরিণতি খুঁজতে চলে আসে সমকালে৷ ব্রিটিশ যুগের সন্ধ্যা গায়েন আর কমলিকা করের উত্তরসূরি হয়ে৷ সোনাইগঞ্জ নিয়ে একটা কাহিনি রচনার ইচ্ছে নিয়ে৷
কালের বেড়া টপকালেও স্থান পরিধিরেখা অনতিক্রম্য এই উপন্যাসে৷ এই উপন্যাস তাই শেষ বিচারে নির্দিষ্ট কোনও চরিত্রের নয়, সোনাইগঞ্জ নামক একটি স্থানের অভিযোজনের বিবরণ হয়ে পাঠকের বুকের কোণে ঢুকে পড়ে৷
অন্তিমে আছে ঔপন্যাসিকের তরফে অস্বীকরণ। ‘এই কাহিনি কাল্পনিক। কোনও ঘটনা বা চরিত্রের সঙ্গে মিল পাওয়া গেলে তাকে আকস্মিক বলে মনে করতে হবে।’
সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু কোনও স্থানের গড়ে ওঠার গল্পের সঙ্গে যদি এই উপাখ্যানের মিল পাওয়া যায়, তাহলে কী হবে! সে-কথা উপন্যাসকার বোধহয় জেনে-বুঝেই এড়িয়ে গিয়েছেন।
এই উপন্যাস পাঠ করলে বোঝা যায়, রালফ ফক্স কেন বলেছেন, ‘The novel is the epic poem of our modern bourgeois society’।
এই উপন্যাসে আমরা মানুষদের, তাদের জীবনের বহু বিচিত্র রূপকে, সংগ্রাম ও তৃষ্ণাকে, ব্যর্থতা ও সাফল্যকে দেখি। এই উপন্যাস মানব-জীবনের দর্পণ। ‘সোনাইগঞ্জের উপাখ্যান’-এর প্রথম ও শেষ অন্বিষ্ট মানুষ, একট বিশেষ স্থান সংলগ্ন জীবনের আলেখ্য। এই আধুনিক শিল্প-প্রতিমা শুধু সমগ্রতা স্পর্শই নয়, এই শিল্পিত স্বরগ্রামে প্রকাশিত হয়েছে প্রচেত গুপ্তের জীবনবোধ আর তাঁর স্বদেশ, সমাজ ও ইতিহাসচেতনা। অরুণ সান্যাল এই উপন্যাস পড়লে নির্দ্বিধ চিত্তে বলতেন, বুর্জোয়া সমাজের সমূহ শক্তি ও সবিশেষ স্বাতন্ত্র্যে আত্মস্থ হয়ে ঔপনিবেশিক যুগের জীর্ণ ও ভঙ্গুর সামন্ত সমাজ কাঠামো ভেঙে দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা নিয়েই জন্ম হয়েছে ‘সোনাইগঞ্জের উপাখ্যান’-এর। ‘আনন্দলোক’-এ যেমন আছেন প্রচেত, ‘দেশ’-এ তেমনই স্মরণজিৎ। এই দু’জনেই তো এই সময়ের জনপ্রিয়তার নিরিখে এবং গদ্যশিল্পের মাপকাঠিতে শ্রেষ্ঠ দু’জন শিল্পী। স্মরণজিতের ‘বাউল সুতো’ সেই সময়কার প্রেক্ষাপটে লেখা উপন্যাস যখন পুরনো শহর বেনারসের নিরিখে ‘একদমই নবীন’ কলকাতা ‘ইংরেজ শাসনের মূল কেন্দ্র হলেও’ ‘গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।’
এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র হীরালাল। শৈশবে তার মা তাকে বলতেন, ‘তোকে ওই বাউল সুতোর মতো হতে হব। অমন মনের আনন্দে হাওয়ায় ভেসে থাকতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে। অপেক্ষা করতে হবে সেই মাটির জন্য, যাতে ভালবাসা আছে,…।’

আরও পড়ুন-জঙ্গি দমন অভিযানে কাশ্মীরে দুই বাঙালি জওয়ানের মৃত্যু, শোকপ্রকাশ মুখ্যমন্ত্রীর

সেই হীরালাল পরবর্তীকালে বোঝে, ভগবান আছে এবং ‘মানুষের পরিকল্পনা ভেস্তে দিতে তার মতো আর কেউ পারে না।’ সে আরও বোঝে বসনের মতো মেয়ে চোখের সামনে থাকলে তার আর বাউল সুতো হয়ে উড়ে বেড়ানো সম্ভব নয়। তাকে ‘মাটির খোঁজই’ করতে হবে।
হীরালালের এই উপলব্ধিটা সেই সময়কার যখন ‘সংবাদ প্রভাকর’-এ বঙ্কিমচন্দ্র ধারাবাহিকভাবে ‘দুর্গেশনন্দিনী’ লিখছেন। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৫-র মার্চ মাসে।
বসন ওরফে বসন্তসেনার বিয়ে আটকানোর কথা বলতে গিয়ে হীরালাল ধরা পড়ে যায় পিশেবাবুদের কাছে। মার খায়। রক্তাক্ত হয়, বসনও। বসনে হীরালালে সেই ছাড়াছাড়ি।
যখন বসনের কথা ফের জানল হীরালাল, তখন গোপাল কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে পড়াশোনা করার সুবাদে হীরালালের কাছে চাকরির সন্ধানে এসেছে। কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুল তখন বছর তিনেক হয়েছে হেয়ার স্কুল হয়েছে, নাম বদলে। হীরালাল গোপালের কাছেই জানতে পারে বসনের জীবন সুখের হয়নি। বিয়ে হয়েছিল বটে, কিন্তু অচিরেই বৈধব্য এসেছিল তার জীবনে শরৎ-বঙ্কিমের নায়িকাদের মতো। হীরালাল ভেবেছিল, বসন ওকে ছাড়া ভাল আছে শুনলে ওর কষ্ট হবে, হিংসে হবে, ‘যন্ত্রণার বিষ ঘুরবে’, ‘বুকের মধ্যে… ছোবল মারবে পদ্মগোখরো। বসনের সঙ্গে আবার দেখা হয় হীরালালের, শনিবার বসন যখন বাগবাজারে আটচালার মন্দিরে এসেছিল তখন, সেদিনও বসন চলে গেছিল একটা কথাও না বলে।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য পিশেবাবুকে খুন করিয়ে বসনকে নিয়ে চলে যায় হীরালাল। উনিশ শতকের বাংলায় একটা নৌকার ওপর তার দুজন পরস্পরকে জড়িয়ে বসে থাকে। সূর্য আর একটু বেয়ে ওঠে আকাশে। আর নদী প্রবহমান থাকে চিরকালীন ভালবাসার অভিমুখে।
এও নাকি, লেখকের অন্তিম অস্বীকরণ অনুযায়ী, একটা বানানো গল্প। ঠিক সোনাইগঞ্জের উপাখ্যানের মতো।

Latest article