চিকিৎসা বিজ্ঞান ও শারীরতত্ত্বে নোবেল
ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন রকি পর্বতমালার বুকে বিজ্ঞানী ফ্রেড র্যামসডেল। যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানার একটি ক্যাম্পগ্রাউন্ডে তখন গাড়িটা পার্ক করছেন বিজ্ঞানী এমন সময় স্ত্রী লরা ও’নিল প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠলেন। র্যামসডেল একটু ঘাবড়ে গেলেন, ভাবলেন লরা বুঝি কোনও হিংস্র ভালুক দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করছেন। কিন্তু খানিক পরেই র্যামসডেল-এর কাছে পরিষ্কার হল বিষয়টা। লরা চিৎকার করে তাঁকে জানালেন, ‘‘তুমি তো নোবেল পুরস্কার জিতে গেছ!’’ র্যামসডেলের মন বিশ্বাস করতে চাইছিল না কিছুতেই। কিন্তু লরা তাঁকে দেখান প্রায় ২০০-র ওপর শুভেচ্ছাবার্তা তাঁর ফোনে জ্বলজ্বল করছে। নেটওয়ার্ক না থাকায় ১২ ঘণ্টা পর সেই সব শুভেচ্ছাবার্তা তাঁদের কাছে পৌঁছয়। ৬৪ বছরের র্যা মসডেল কীসের জন্য পেলেন নোবেল?
দেহের রোগ প্রতিরোধতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের রহস্য আবিষ্কারের কৃতিত্ব স্বরূপ আরও দুই বিজ্ঞানীর সঙ্গে যৌথভাবে র্যামসডেল ২০২৫-এ চিকিৎসাবিজ্ঞান এবং শারীরতত্ত্বে পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। অন্য দুই বিজ্ঞানী হলেন মেরি ব্রুনকো, শিমন সাগাগুচি। পেরিফেরাল ইমিউন টলারেন্স তথা শরীরের রোগ প্রতিরোধক কোষ জীবাণুদের সফলভাবে আক্রমণ করে কিন্তু নিজের টিস্যু বা অঙ্গকে আক্রমণ করে না, কীভাবে এটা সম্ভব হয় সেই নিয়ে গবেষণা করেছেন এই তিনজন। মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রোজ বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া এবং অন্য জীবাণু থেকে আমাদের শরীরকে রক্ষা করে এই রোগ প্রতিরোধ শক্তি। এটি দেহের রোগজীবাণুকে শনাক্ত করে এবং শরীরের নিজস্ব কোষ থেকে আলাদা করে। না হলে এটি নিজের শরীরের অঙ্গগুলিকেই আক্রমণ করত। এই রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কেন নিজ শরীরের ক্ষতি করতে বাধা পায়, কোন ক্ষেত্রে জীবাণুর উপর আক্রমণ করতে হবে, কোন ক্ষেত্রে করতে হবে না, তা কীভাবে স্থির করে এই নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা এবং জানতে পারেন, এর নেপথ্যে রয়েছে একটি বিশেষ ধরনের রোগ প্রতিরোধক কোষ। এই কোষগুলিকে বলা হয় ‘রেগুলেটরি টি সেল’। রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোষটি হল ‘টি সেল’। একে বলা হয় শরীরের প্রহরী। এই কোষগুলিই বিভিন্ন ভাইরাস বা জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত কোষগুলিকে ধ্বংস করে। এই কোষগুলিই মানবদেহে ‘অটোইমিউন’ ব্যাধি হওয়া আটকায়। তাঁদের এই গবেষণা ক্যানসার এবং অন্য ‘অটোইমিউন’ রোগ-সহ নানা রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত এনেছে। এই তিন বিজ্ঞানীর মধ্যে র্যা মসডেল এখন সান ফ্রান্সিসকোয় সোনোমা বায়োথেরাপটিক্সে বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা হিসাবে যুক্ত রয়েছেন। ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজি ফ্রন্টিয়ার রিসার্চ সেন্টারে অধ্যাপনা করছেন সাকাগুচি এবং সিয়াটেলে ইনস্টিটিউট ফর সিস্টেম্স বায়োলজিতে সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার হিসাবে কাজ করছেন ব্রুনকো।
আরও পড়ুন-যোগীরাজ্যে হকারদের তালিবানি শাস্তি!
পদার্থবিদ্যায় নোবেল
এতো গেল চিকিৎসা বিজ্ঞানের কথা। এ-বছর পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেয়েছেন আরও তিনজন মার্কিন বিজ্ঞানী। মাইক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিংয়ে বিশেষ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন বিজ্ঞানী জন ক্লার্ক, মিশেল দ্যভরে এবং জন এম মার্টিনিস। কী আবিষ্কার করলেন তাঁরা?
বৈদ্যুতিক সার্কিটে ম্যাক্রোস্কোপিক কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল টানেলিং এবং শক্তির পরিমাণ নির্ধারণ। এটাই ছিল তাঁদের আবিষ্কার। শতাব্দীপ্রাচীন এই কোয়ান্টাম মেকানিক্স সমস্ত ডিজিটাল প্রযুক্তির ভিত। আমাদের আশপাশে কোয়ান্টাম প্রযুক্তির অন্যতম উদাহরণ হল কম্পিউটার মাইক্রোচিপের ট্রানজিস্টারগুলি। মোবাইল ফোন, বাড়ির কম্পিউটার, চিকিৎসা বা গবেষণার কাজে ব্যবহৃত ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ বা ঘরের এলইডি বাতির ভেতরের এলইডি বা লাইট এমিটিং ডায়োড—এসবই বানানো হয়েছে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার নিয়ম মেনে। রাতে ঘুমোনো থেকে সকালে অ্যালার্ম শুনে জেগে ওঠা পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোয়ান্টাম প্রযুক্তি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অদ্ভুতুড়ে জগতে যেসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটে সেই ঘটনাগুলো হাতে ধরে দেখিয়েছেন তাঁরা। তৈরি করেছেন এক সুপারকনডাক্টিং ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম বা অতিপরিবাহী বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা এই সিস্টেমটি এক দশা থেকে অন্য দশায় এমনভাবে চলে যেতে পারে যে মনে হবে জিনিসটা বুঝি কোনও দেওয়াল ভেদ করে অন্য পাশে চলে গেছে। সুড়ঙ্গ খোঁড়ার মতো বলে একে বলা হয় ‘টানেলিং’। বাংলায় ‘সুড়ঙ্গ প্রভাব’। তাঁরা আরও দেখিয়েছেন তাঁদের এই সিস্টেমটি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার ভবিষ্যদ্বাণীর মতো করেই নির্দিষ্ট আকার বা প্যাকেট করে শক্তি শোষণ ও নিঃসরণ করতে পারে। তাঁদের আবিষ্কার আজকের কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে দিয়েছে। যা ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটার, কোয়ান্টাম ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং সংবেদনশীল কোয়ান্টাম সেন্সর প্রযুক্তি উন্নয়নের পথ খুলে দেবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই মুহূর্তে আমেরিকার বার্কলের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত রয়েছেন জন ক্লার্ক৷ আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সান্তা বারবারায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিজ্ঞানী মিশেল এবং সান্তা বারবারায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন জন এম মার্টিনিস।
রসায়নে নোবেল
রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস ২০২৫ সালের রসায়নের নোবেল পুরস্কারজয়ী তিন বিজ্ঞানীর নামও ঘোষণা করেছে। এঁরা হলেন সুসুমু কিতাগাওয়া, রিচার্ড রবসন এবং ওমর এম ইয়াঘি। মেটিল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক বা ধাতব জৈব কাঠামো (MOF) নির্মাণ এবং সেই সংক্রান্ত দীর্ঘ গবেষণার সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ এই তিন বিজ্ঞানীকে রসায়নে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। কী এই আবিষ্কার? কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ? এই মেটাল অর্গানিক ফ্রেমওয়ার্ক কার্বন ও ধাতুর সংমিশ্রণে তৈরি এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা, গ্যাস সংরক্ষণ এবং বাতাস থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড সরাতে ব্যবহৃত হয়। মরুভূমির হাওয়া থেকে জল আহরণ-সহ পরিবেশ সুরক্ষায় এই প্রযুক্তি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এমওএফ-গুলির ন্যানোস্কোপিক কাঠামোর অন্দরমহল বিশ্লেষণ করে তিন বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, তার মধ্যে দিয়ে গ্যাস ও তরল প্রবাহিত হতে পারে। মরুভূমির বাতাস থেকে জল সংগ্রহ, কার্বন ডাই-অক্সাইড, বিষাক্ত গ্যাস সংরক্ষণ এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অনুঘটক হিসেবে এ সব কাঠামো ব্যবহার করা যায়। নোবেল কমিটি এই আবিষ্কারকে ‘আণবিক স্থাপত্য’ হিসেবে অভিহিত করেছে। কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই তিন বিজ্ঞানী এমন কাঠামো তৈরি করেছেন, যেখানে অণুগুলির মধ্যে বৃহৎ ফাঁকা স্থান রয়েছে। এই ফাঁকা স্থানগুলোর মধ্য দিয়ে গ্যাস এবং অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ প্রবাহিত হতে পারে। এই মুহূর্তে আমেরিকার বার্কলেতে অবস্থিত ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানী হিসেবে রয়েছেন ইয়াঘি, সুসুমু জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন, রবসন যুক্ত রয়েছেন এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হিসেবে।