টাইগার হিলে উল্লাস
সূর্যোদয়ের মুখে কাঞ্চনজঙ্ঘায় (kanchenjunga) সিঁদুর-রঙের ছোঁয়া। উল্লাসে ফেটে পড়লেন টাইগার হিলে অপেক্ষারত মানুষেরা। তাঁদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। রাজ্যের বিভিন্ন জেলার তো বটেই, এসেছেন অন্য রাজ্য, অন্য দেশের পর্যটকেরাও। সাক্ষী থাকলেন আশ্চর্য সূর্যোদয়ের। মেঘমুক্ত আকাশ। কাঞ্চনজঙ্ঘার পাশাপাশি দেখা মিলল মাউন্ট এভারেস্ট-সহ হিমালয়ের অন্যান্য চূড়ার।
অথচ কিছুদিন আগেও এই দৃশ্য ছিল অকল্পনীয়। কারণ, উত্তরবঙ্গের সম্প্রতিক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবে রাজ্য সরকারের তৎপরতায় দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আঁধার সরিয়ে আলো ফুটেছে উত্তরের আকাশে। ফলস্বরূপ, জমজমাট দার্জিলিং। পাহাড়ের রানি চেনা ছন্দে। বিপর্যয়ের খবরে পড়েছিলাম মহাচিন্তায়। সফর বাতিলের পরামর্শ দিয়েছিলেন কেউ কেউ। বলা যায়, ঝুঁকি নিয়েই হাওড়া স্টেশনে চড়েছিলাম বন্দে ভারতে। নিউ জলপাইগুড়ি নেমে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে পাহাড়ে এসে হাসিখুশি দার্জিলিং দেখে মনে হয়েছে, ভুল সিদ্ধান্ত নিইনি।
উৎসবের আবহ
পুজোর ছুটিতে প্রতি বছর দার্জিলিং-সহ উত্তরের বিভিন্ন ট্যুরিস্ট-স্পটে পর্যটকের ঢল নামে। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় দার্জিলিং ম্যালে চোখে পড়ল উৎসবের আবহ। গরম চায়ে চুমুক, আড্ডা, ঘোড়ায় চড়া, কেনাকাটা— স্বাভাবিকভাবেই চলছে সবকিছু। কোনও মুখেও দেখা গেল না আতঙ্কের চিহ্ন। গিটার বাজিয়ে গান, স্কেটিং— মন মাতানো পরিবেশ। অনেকেই ছবি তুলছেন কবি ভানুভক্তের স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে।
কথা হল কয়েকজনের সঙ্গে। ডায়মন্ড হোম-স্টের পরিচালক গোলাম মোস্তফা জানালেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরেও বুকিং ক্যানসেল করেননি কেউই। সবাই এসেছেন। গাড়ি-চালক হেমন্ত ছেত্রী বললেন, ‘পর্যটকের ভিড় ভালই। মানুষ না এলে আমাদের চলবে কী করে? সুখে-দুঃখে রাজ্য সরকার আছে আমাদের পাশে।’ আরেক গাড়ি-চালক শিরিন তামাং বললেন, ‘প্রাকৃতিক বিপর্যয় জোর ধাক্কা দিয়েছিল। তবে দ্রুত সামাল দেওয়া গেছে রাজ্য সরকারের তৎপরতায়।’ এঁরা প্রত্যেকেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি।
আরও পড়ুন-মেডিক্যালে ৪৭৪ আসন বৃদ্ধি বাংলায়
পরিশ্রমী এবং সৎ
টাইগার হিল, ম্যালের পাশাপাশি ভিড় চোখে পড়ল বাতাসিয়া লুপ, ঘুম মনাস্ট্রি, জাপানিজ টেম্পল, রক গার্ডেন, চুন্নু গ্রীষ্মকালীন জলপ্রপাত, চিড়িয়াখানা, রোপওয়ে, চা-বাগান প্রভৃতি জায়গায়। কয়েকটি স্পটে যাওয়ার জন্য কাটতে হয় টিকিট। চোখে পড়ল লম্বা লাইন।
শহরের পাহাড়ি পথ ধরে ছুটে চলেছে টয় ট্রেন, গাড়ি। শিলিগুড়ি থেকে আসছে যাত্রীবোঝাই বাস। দার্জিলিং এবং ঘুম স্টেশন দু’টি সুন্দর। পরিচ্ছন্ন। আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য দোকান। বিক্রি হচ্ছে চা, গরম পোশাক, স্মারক ইত্যাদি। বড় বড় রেস্টুরেন্টের পাশাপাশি আছে মহিলা পরিচালিত বেশকিছু ছোট ছোট খাবারের দোকান। পাওয়া যাচ্ছে মোমো, থুকপা, চাউমিন, ম্যাগি ইত্যাদি স্থানীয় খাবার। রীতিমতো গরম-গরম। ধোঁয়া-ওঠা। অসাধারণ স্বাদ।
স্থানীয় পথচারী, গাড়ি চালক, দোকানদার সবার মুখেই লেগে রয়েছে নির্মল হাসি। এঁরা কঠোর পরিশ্রমী এবং সৎ। এক কথার মানুষ। ভোর চারটে নাগাদ টাইগার হিলে যাওয়ার পথে দেখলাম একা-একাই প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন এক তরুণী। বাংলার এই পাহাড়ি শহরে তিনি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
ঢেউ জাগে পাহাড়ে
সময় বিশেষে বদলে যায় পাহাড়ের রূপ। ভোরে আকাশ পরিষ্কার থাকলে দেখা যায় বরফের চাদরে মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার ঝকঝকে রূপ। বেলা গড়ালেই ঢাকা পড়ে যায় মেঘ-কুয়াশায়। উদাসী মন খুঁজে বেড়ায় তাকে। কিন্তু পায় না। পরের দিনের জন্য অপেক্ষা। গভীর খাদে চোখ রাখলেই শিহরন জাগে। পাহাড় জুড়ে চেনা-অচেনা গাছের সারি। নানা রঙের ফুল। আলোকালো পরিবেশ। ঢেউ শুধু সমুদ্রে নয়, পাহাড়েও জাগে। ধীর ঢেউ, স্থির ঢেউ। সবার চোখে নয়, কারও কারও চোখে ধরা পড়ে।
দার্জিলিংয়ে উপর চাপ কমাতে গত কয়েক বছরে বেশকিছু নতুন স্পট তৈরি হয়েছে। যেমন লেপচা জগৎ, লামাহাটা, তিনচুলে, দাওয়াইপানি, তাবাকোশি, বিজনবাড়ি, সিটং, লবচু ইত্যাদি। ছুঁয়ে গেলাম কয়েকটি স্পট। হোম-স্টেগুলোয় পর্যটকের ভিড় ভালই। পেশক ভিউ পয়েন্টে দাঁড়িয়ে দেখলাম রঙ্গিত মিশেছে তিস্তায়। সেখানেও বহু মানুষের ভিড়।
তিস্তা সেতু পেরোতেই কালিম্পং জেলা। শহরটি সাজানো গোছানো। পর্যটকের ভিড়। এখানেও আছে বেশকিছু অফবিট ট্যুরিস্ট স্পট। যেমন লাভা, লোলেগাঁও, ইচ্ছেগাঁও, চারখোল, রিশপ, ঋষিখোলা, রামধুরা ইত্যাদি। কোলাখামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ। এখানে আছে নেওড়া ভ্যালি অভয়ারণ্য, ছাঙ্গি জলপ্রপাত। রহস্যময়, গা ছমছমে পরিবেশ। সিলেরি গাঁও ছবির মতো সুন্দর। এখান থেকে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা (kanchenjunga), সিকিমের গ্যাংটক শহর। বিভিন্ন স্পটের হোটেল ও হোম-স্টেগুলো প্রায় খালি নেই বলা যায়।
অর্থাৎ, সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘরবন্দি রাখতে পারেনি পর্যটকদের। টেলিভিশন-অ্যাঙ্করদের ভয় ধরানো চিৎকার, অকারণ লাফালাফি বিভ্রান্ত করতে পারেনি। তাই তো নেমেছে মানুষের ঢল। এটা রাজ্য সরকারের বিরাট সাফল্য। আমি তার প্রত্যক্ষদর্শী।
হাতছানি দেয় পাহাড়? ট্রেনের টিকিট কাটা থাকলে, ঘর বুকিং থাকলে নিশ্চিন্তে বেরিয়ে পড়ুন। এই মুহূর্তে পুরোপুরি স্বাভাবিক দার্জিলিং। পুরোপুরি স্বাভাবিক কালিম্পং।
কীভাবে যাবেন?
ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে গাড়িতে দার্জিলিং অথবা কালিম্পং। এই দুটি স্পট থেকে ঘোরা যায় আশপাশের স্পটগুলো।
কোথায় থাকবেন?
দার্জিলিং, কালিম্পং এবং আশপাশের অফবিট স্পটগুলোয় আছে বেশকিছু হোটেল, হোমস্টে। থাকা-খাওয়ার কোনও সমস্যা হবে না।