সম্প্রতি ‘Foundation Literacy & Numeracy Index’ বিচারে রাজ্যভিত্তিক তালিকা ঘোষণা করা হয়েছে। আর এই পরিসংখ্যানেই জানা গেছে, দেশের সব রাজ্যের তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষার হারে এগিয়ে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের মুকুটে এই নতুন পালক সংযোজন বিষয়ে লিখছেন কার্তিকচন্দ্র মান্না
পেটকাটি চাঁদিয়াল মোমবাতি বগ্গা
আকাশে ঘুড়ির ঝাঁক, মাটিতে অবজ্ঞা।
এসব এখন অতীত। ছবিটা পাল্টেছে, দ্রুত পাল্টাচ্ছে। দশ বছরেই বদলে গিয়েছে। ‘The Economic Advisory Council to the Prime Minister’ সংক্ষেপে EACPM প্রথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সবার থেকে এগিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গকে। অবহেলা, অবজ্ঞা, প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন করার বিরুদ্ধে যোগ্য জবাব। এই স্বীকৃতি!
আরও পড়ুন-সংক্রমণ বাড়লে কলকাতায় কনটেনমেন্ট জোন, হবে স্কুল-কলেজ বন্ধ, জানিয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিকে শীর্ষ স্থান অর্জন করেছে ‘Index on foundation literarure numeracy’ এর ভিত্তিতে। অর্থাৎ, আমাদের ছেলেমেয়েরা ভাষা ও গণিত এই দুটি বিষয়ে খুব ভাল করেছে। যার ভিত গড়ে উঠেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায়!
মূলত পাঁচটি বিষয়ে উৎকর্ষের ভিত্তিতেই এই স্বীকৃতি। সেগুলি একটা একটা করে আলোচনা করা যাক।
১। শিক্ষাগত পরিকাঠামো (Educational infrastructure)
মা মাটি মানুষের সরকার ২০১১তে প্রথমবার রাজ্যে সরকার চালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর, বিদ্যালয়গুলির শ্রেণীকক্ষ নির্মাণ, সম্প্রসারণ, পুনঃনির্মাণ সম্ভব হয়েছে। ছাত্র এবং ছাত্রীদের জন্য পৃথক শৌচালয়, পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি পরিষ্কার পরিছন্নতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ফলে ‘নির্মল বাংলা’ প্রকল্পের আওতায় এসে বিদ্যালয়ের বাড়ির পরিবেশে আমূল পরিবর্তন এসেছে।
২। শিক্ষায় প্রবেশাধিকার (Access to education)
সকল শিশুকে তাদের বয়সের অনুসারে নির্দিষ্ট শ্রেণীতে ভর্তি করার দায়িত্ব এই সরকার নিয়েছেন। অর্থাৎ রাজ্যের ১০০ শতাংশ শিশুকে সরকারী বিদ্যালয়মুখী করে তোলাই এই রাজ্য সরকারের প্রধান লক্ষ্য। যার জন্য সব জায়গায় ওয়ার্ড, বুথ, পল্লী,পঞ্চায়েত ধরে ধরে শিশুদের সরকারী বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছে এবং হচ্ছে। মাইগ্রেশন বা অন্য কোনও কারণ বাদ দিলে সাফল্যর হার ৯৯.৮ শতাংশ। এই মানদণ্ডের বিচারেও সারা ভারতের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম।
আরও পড়ুন-হাসপাতালে মেডিক্যাল বোর্ড গঠন
৩। প্রাথমিক স্বাস্থ্য (Basic health)
প্রাথমিক স্বাস্থ্যর বিষয়েও এই সরকার গুরুত্ব দিয়েছেন বলেই ‘মিড ডে মিল’ সকল স্কুলে চালু হয়েছে। ‘মিড ডে মিল’ এর কর্মীদের জন্য পাঁচশো টাকা করে অতিরিক্ত ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া পরিকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য মানে থালা-গ্লাস,বাসন, রান্নার বিবিধ সরঞ্জামের জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছে।
মিড ডে মিল এবং পানীয় জলের জোগানের ফলে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। যাকে body index বলে, অর্থাৎ ‘উচ্চতা অনুযায়ী ওজন’এর নিরিখে আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েদের শরীর সব চাইতে ভালো।
এছাড়া, আয়রন ফলিক অ্যাসিড ট্যাবলেট, হুইপস প্রোগ্রামের মাধ্যমে পেটে যাতে কৃমির কারণে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে না পড়ে তার জন্য ওষুধ, ভিটামিন ট্যাবলেট সরকার প্রতিনিয়ত স্কুলগুলির মাধ্যমে সরবরাহ করছে।
আরও পড়ুন-নতুন বছরে গোয়ার মানুষের জীবনে সুখ-সমৃদ্ধি প্রার্থনা করে রুদ্রেশ্বর মন্দিরে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়
৪। শিখন সামর্থ্য (Learning outcome)
শ্রেণীকক্ষে ছাত্রছাত্রীরা যখন পাঠ নিচ্ছে, তখন শিখন প্রক্রিয়া ঠিক আছে কিনা তার জন্য শিক্ষকদের ব্যাপকহারে প্ৰশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং হচ্ছে । বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকার অনুপাত ঠিক আছে কিনা তার দিকে নজর দেওয়া হয়েছে। ফলে এমন কোনও স্কুল নেই যেখানে শিক্ষকের অপ্রতুলতা আছে।
শিক্ষকদের প্ৰশিক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম যেমন চক -ডাস্টার তো ছিলই, তার সাথে চার্ট, কম্পিউটার, এলসিডি, প্রজেক্টর, ছবি ইত্যাদি দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে পঠনপাঠনে আমূল পরিবর্তন এসেছে। শেষ বেঞ্চে বসে আছে যে ছাত্র বা ছাত্রী সে-ও এই শিখন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করছে এবং তার কাম্য সামর্থ্য অনুযায়ী শিক্ষা অর্জন করতে পারছে।
স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে ছাত্র-ছাত্রীদের এই সার্বিক মূল্যায়ন আমরা করলাম কী ভাবে?
আরও পড়ুন-বরফের চাদরে সান্দাকফু
আমাদের যে বিভিন্ন মূল্যায়ন পদ্ধতি আছে তাতে ধরা পড়েছে, রাজ্যের বাইরেও কেন্দ্রীয় স্তরে NAS (National Achievement Survey)যখন হয়, তখনও দেখা গেছে, আমাদের বাচ্চারা ‘learning outcome’ বা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে , গণিত শিক্ষার ক্ষেত্রে বা সাধারণ জ্ঞান, সাধারণ পরিবেশ বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি উত্তর দিতে পেরেছে।সবথেকে বেশি শিখন প্রক্রিয়াতে সাফল্য দেখাতে পেরেছে।
৫। নিয়ন্ত্রণ (Governances)
পরিদর্শন ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও রাজ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। নিয়মিত স্কুলগুলোতে পঠনপাঠন দেখা, তার মান নির্ণয় করা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থাগ্রহণ, এসবের জন্য আমাদের জেলা স্তরে প্রতিটি জায়গায় ‘প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ’ আছে। এঁদের কাজ হচ্ছে পরিদর্শন ব্যবস্থাকে সচল রাখা। মূল্যায়ন ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা দেখা। প্ৰশিক্ষণ ব্যবস্থা ঠিক আছে কিনা দেখা। এই তিন চারটে বিষয়ে কোন গাফিলতি না থাকার দরুন আমাদের শিক্ষা প্রশাসন সার্বিকভাবে ভালো অবস্থাতেই আছে।
আরও পড়ুন-শুধু দার্জিলিঙের নয়, ভারী তুষারপাত হয়েছে সিকিমেও
উল্লেখ্য, উল্লিখিত এই পাঁচটি বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সেরা।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় নিজে উদ্যোগ নিয়ে সময়ে সময়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি দেখেছেন। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মুহুর্মুহ জেলার প্রশাসনিক প্রধানদের সাথে বৈঠক করেছেন। প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে শিক্ষা প্রশাসকদের সাথে বসেছেন। শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রকের প্রধান সচিবের থেকে সময় সময় রিপোর্ট তলব করেছেন, নিজ দেখেছেন, খেটেছেন – এ স্বীকৃতি তাঁরই প্রাপ্তি! এই সাফল্যর নেপথ্যে তাঁর দূরদৃষ্টি, নজর, নিরলস কাজ এবং উৎসাহের অবদান অনস্বীকার্য।
এক্সপার্ট কমিটিও নানা ব্যবস্থা করেছেন। নতুন নতুন পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুতে ছবি, চার্ট, সহ, প্রশ্ন উত্তর সহযোগে নানা আকর্ষক পরিবর্তন এসেছে। যা শিখন প্রক্রিয়ার খোলনলচে বদলে দিয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের কাছে পঠনপাঠনকে সহজ ও আধুনিক করেছে। এটি রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি অনন্য, নজিরবিহীন কাজ। শিক্ষার অঙ্গনে এই আধুনিক প্রয়োগের ফলেই বাংলা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে আছে।
আর এজন্যই বড় রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ প্রথম স্থান অধিকার করেছে।
শিক্ষার অঙ্গনেও এগিয়ে বাংলা।