বৈদ্যুতিক বিড়ম্বনা

বেড়েই চলেছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ জনিত দুর্ঘটনা।ঝড়, বৃষ্টি,জমা জলে লুকিয়ে রয়েছে মৃত্যু ফাঁদ। প্রায়শই জীবনহানি ঘটছে। কেন এমনটা হচ্ছে ? এর কারণ কী? কী করণীয়। লিখেছেন ডঃ রামকৃষ্ণ দত্ত

Must read

সংবাদে প্রকাশ, সম্প্রতি ২২ থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে অন্তত ১২ জন মানুষ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, বজ্রপাতের জন্য নয়। টিভি এবং সংবাদপত্রে ভুল-ত্রুটি নিয়ে প্রচুর বাদানুবাদ হয়েছে। এর জন্য প্রকৃত সমস্যা সৃষ্টিকারী হচ্ছে ঘরোয়া বিদ্যুতের বিভব বা সোজা ইংরেজিতে ভোল্টের সমস্যা। আমাদের দেশে ঘরোয়া বিদ্যুতের ভোল্ট ২২০ এসি। যদিও ব্রিটিশ শাসনকালে, কলকাতা ও কলকাতা সংলগ্ন জায়গায় ঘরোয়া বিদ্যুতের ভোল্টেজ ২২০ ডিসি ছিল। এখনও সম্ভবত পুরোনো কলকাতায় কোনও কোনও জায়গায় ঘরোয়া বিদ্যুতের ভোল্ট ২২০ ডিসি। ভোল্ট ২২০ এসি মারাত্মক বিপজ্জনক। সামান্য ভুলে প্রচণ্ড জীবনহানির আশঙ্কা, বৃষ্টি-ভেজা শরীরে বিদ্যুতের তারের সামান্য স্পর্শ মৃত্যু ডেকে আনতে পারে। সেই হিসাবে ভোল্টেজ ২২০ ডিসি তুলনামূলকভাবে সামান্য কম বিপজ্জনক। কিন্তু বিদ্যুৎ পরিবহণে ভীষণ সমস্যা। এক জায়গা থেকে অন্য কোনও দূরবর্তী জায়গায় বিদ্যুৎ পরিবহণ করলে ভোল্টেজ খুব কমে যায়। তাই পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ
(আমেরিকা-সহ অন্তত ৩০টি) ঘরোয়া বিদ্যুতের ভোল্ট ১১০ এসি সরবরাহ করা হয়। এতে জীবনহানির আশঙ্কা অনেক কম। কারণ ওই সমস্ত দেশে ঘরোয়া বিদ্যুতের জন্য জীবনহানিতে, বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থাকে প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। সংস্থা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। এত বিপদ সত্ত্বেও বিদ্যুৎ ছাড়া বর্তমানে মানুষের জীবন যাপন প্রায় অসম্ভব।

আরও পড়ুন-চলে গেলেন আসরানি

বিদ্যুৎ বিভব বা ভোল্ট কী
চাপ, তাপমাত্রা ও বিদ্যুৎ বিভব বা ইলেকট্রিকাল ভোল্ট মোটামুটি সমতুল্য। এদের মাত্রা যত বেশি তত বেশি বিপদজ্জনক আবার তত বেশি কর্মক্ষম। জলের চাপ যত বেশি হবে, নলের সাহায্যে তত বেশি দূরে জল প্রেরণ করা সম্ভব। তেমনি জলের চাপ বেশি না হলে জলবিদ্যুৎ উৎপন্ন সম্ভব না। একই ভাবে তাপমাত্রা কম হলে স্টিম ইঞ্জিন চলবে না, বিদ্যুৎ উৎপন্ন হবে না। যেমন ঘরের বিদ্যুতের ভোল্ট ২২০ এসি, বৈদ্যুতিক ট্রেন-এর ভোল্ট বা বিভব ২৫০০০ এসি। বিভব কম হলে যন্ত্র খারাপ বা দক্ষতা কমে যায়।
বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে যে দুটি যন্ত্র মানুষের প্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে তার একটি হল ইঞ্জিন আর একটি হল বিদ্যুৎ উৎপাদক যন্ত্র, বা ডায়নামো। মাইকেল ফ্যারাডে ১৮৩১ সালে চুম্বকের সাহায্যে সর্বপ্রথম যান্ত্রিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎ শক্তি উৎপন্ন করেন। যদিও প্রথম অবিরাম বিদ্যুৎ উৎপন্নকারী যন্ত্র বা ডায়নামো তৈরি হয় ১৮৬০ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে। এরই কিছুদিন বাদে, ১৮৮২ সালে আমেরিকার পার্ল স্ট্রিটে ঘরোয়া বিদ্যুতের বিভব বা ভোল্ট ১১০ ডিসি ব্যবহার শুরু হয়। সাইকেলে আলো জ্বালাবার জন্য, চাকার সঙ্গে একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্র ঘোরানো হয়। এটিকেই ডায়নামো বলে। এর ভেতরে চুম্বক থাকে আর একটি তামার তারের কুণ্ডলী থাকে। উৎপন্ন বিদ্যুতের বিভব অনেকগুলি উপাংশের উপর নির্ভর করে, যেমন চুম্বকের ক্ষমতা, তামার তারের কুণ্ডলীতে প্যাঁচানো তারের সংখ্যা, কুণ্ডলীর ঘূর্ণন সংখ্যা এবং কী ধরনের ডায়নামো— এসি (অল্টারনেটিং কারেন্ট) বা ডিসি (ডাইরেক্ট কারেন্ট) ইত্যাদি। বস্তুত ডায়নামোর মধ্যে একটি ঘূর্ণন অংশ আর একটি স্থির অংশ। এই ঘূর্ণন অংশটিকে বাতাসের সাহায্যে, জলের সাহায্যে বা ইঞ্জিনের সাহায্যে ঘোরানো হয় আর বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।

এসি-ডিসি-র
সুবিধা-অসুবিধা
এসি বিভব বা ভোল্ট ২২০, ডিসি বিভব বা ভোল্ট ৩০০-র সমান বিপজ্জনক। তা হলেও এসি বিদ্যুতের সুবিধা অনেক। বিভব বা ভোল্ট বাড়ানো বা কমানোর জন্য সবচাইতে বেশি দক্ষ যন্ত্র ট্রান্সফরমার ব্যবহার করা যায়। বর্তমানে বহুদূর বিদ্যুতের পরিবহণের জন্য ট্রান্সফরমারের সাহায্যে ৪ লক্ষ ভোল্ট করা হয়। দূর প্রান্তে আবার ট্রান্সফরমার দিয়ে বিভব কমিয়ে দেওয়া হয়। এতে অনেক সরু তারের সাহায্যে অনেক বেশি বিদ্যুৎ পাঠানো সম্ভব। আবার ভূপৃষ্ঠকে (আর্থিং) একটি পরিবাহীর মতো ব্যবহার করে পরিবাহীর সংখ্যা কমানো যায়। এসিতে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির দাম ডিসির বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির থেকে অনেক কম। ঘরোয়া বিদ্যুৎ সরবরাহ ডিসি নিরাপদ তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘরের ব্যবহারের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির দাম তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিভব কমে যায়। ট্রান্সফরমার ব্যবহার করা যায় না। শিল্পে অনেক সময় ডিসি-র প্রয়োজন, লোহা ইস্পাত জোড়বার (ওয়েল্ডিং) জন্য, তড়িৎলেপন (ইলেক্ট্রোপ্লেটিং), ধাতু নিষ্কাশন (মেটাল এক্সট্রাকশন) ইত্যাদি কাজে ডিসি দরকার। কিন্তু এসি থেকে ডিসি করা খুব সহজসাধ্য। ওই সমস্ত শিল্পে ডিসি-এর প্রয়োজন হলেও এসি ব্যবহার করে ডিসিতে পরিবর্তন করা হয়। সূক্ষ্ম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে ডিসি ছাড়া চলবে না।

আরও পড়ুন-দীপ জ্বালিয়ে-ভোগ রেঁধে বাড়ির কালীপুজোর সূচনা মুখ্যমন্ত্রীর, রয়েছেন অভিষেকও

ঘরোয়া বিদ্যুতের ভোল্টেজ কমের সুবিধা-অসুবিধা
উন্নত দেশে ১১০ ভোল্ট এসি ব্যবহার করে বিদ্যুতের জন্য প্রাণহানি অনেক কমিয়ে ফেলেছে। এটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। বিভব বা ভোল্টেজ ২২০ এসি-র পরিবর্তে ১১০ এসি করলে ঘরের বৈদ্যুতিক তার একটু মোটা করতে হবে। বৈদ্যুতিক জিনিসপত্রের দাম একটু বাড়বে, শিল্পে প্রতিযোগিতা আসবে। ভারতে বৈদ্যুতিক শিল্পে নবজাগরণ হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে এই অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা গ্রহণ করা উচিত। প্রযুক্তি যত উন্নত হবে বিভব বা ভোল্টেজ তত কমানো সম্ভব। আগে ১০০ ওয়াট বাল্ব ব্যবহার হত। বর্তমানে ১০ ওয়াট এলইডি ব্যবহার করা হয়। এই এলইডিগুলির মাত্র ৫ ভোল্ট প্রয়োজন। এখন ২৪ বা ৪৮ ভোল্ট-এ মোটর দিয়ে গাড়ি চালানো শুরু হয়েছে। সুতরাং আমাদের ঘরোয়া প্রয়োজনের আলো-বাতাসের ব্যবস্থা ৫৫ ভোল্টেই সম্ভব। এমনকী বাড়িতে শীততাপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র চালনা ৫৫ ভোল্টস-এ সম্ভব। অদূর ভবিষতে ৫৫ ভোল্ট এসি সরবরাহ হলে, ঝড়-বৃষ্টিতে বিদ্যুতের জন্য প্রাণহানি হবে না বললেই চলে। বলতে বাধা নেই, আমাদের দেশে মহিলা ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার অনেক আছেন, কিন্তু নিত্যঘরের প্রয়োজনে মহিলা ইলেক্ট্রিশিয়ান এখনও পাওয়া খুব মুশকিল। বিভব বা ভোল্ট ১১০ এসি বা ৫৫ এসি হলে তখন নিশ্চিন্তে সবাই ঘরে ইলেক্ট্রিশিয়ানের কাজ করতে পারবেন।

Latest article