অমিত শাহদের মিথ্যে প্রচার, আসুন, রুখতে তৈরি থাকি আমরা

অনুপ্রবেশকে ভোটের ইস্যু করে ভোট লুঠের ছক কষছে ওরা। আমাদের সেই চুরি আটকাতেই হবে। লিখছেন সাগ্নিক গঙ্গোপাধ্যায়

Must read

মহা মুশকিল হয়েছে অমিত শাহের।
প্রথমত, লোকজন এখন অনেক বেশি সচেতন। টুপি পরালেই টুপি পরে না। ক্লাস এইটেও পড়ার সময় থেকে সে সংবিধানের প্রাথমিক পাঠ নেয়। সে ভোট জানে, স্থানীয় প্রশাসন, বিধানসভা, লোকসভা, সবই অল্পবিস্তর পড়ে ফেলে তখন থেকে। কিন্তু এখনও মানুষের মাথায় যা ঢোকে না, তা হল ভোটের ইস্যু।
‘অনুপ্রবেশ’ ওই তালিকায় এক নম্বরেরও উপরে থাকে এবং যতদিন ভোটব্যাংক রাজনীতি বেঁচে আছে, ততদিনই থাকবে বলেই মনে হয়। সত্যিই কত লোক অনুপ্রবেশকারী, তাদের ধর্ম কী, তারা কোথায় আছে, ভারতীয় পরিচয়পত্র বানিয়ে ফেলেছে কি না… এইসব প্রশ্নের গুরুত্ব রাজনৈতিক দল অনুযায়ী বদলে বদলে যায়। এই যেমন গত বেশ কয়েক বছর ধরে বিজেপি লাগাতার বাংলা এবং ঝাড়খণ্ডে অনুপ্রবেশ সমস্যা নিয়ে খুঁচিয়ে চলেছে। অনুপ্রবেশ ঘটে, সেটা সূর্য ওঠার মতোই সত্যি। এবং তা নিত্যকাল ঘটে চলেছে। পড়শি দেশে যখন সামাজিক ও রাজনৈতিক দোলাচল বাড়ে, অনুপ্রবেশের হিড়িক তখন মাত্রাছাড়া হয়। তা না হলে সারা বছর কিছু না কিছু আসা-যাওয়া লেগেই আছে। আর তা সীমান্তবর্তী প্রত্যেকটা প্রশাসন তো জানেই, বিএসএফ এবং কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও জানে। অনুপ্রবেশ মাত্রাছাড়া হলে ডেমোগ্রাফি তো বটেই, এলাকার সংস্কৃতিও বদলে যায়। সে-ব্যাপারেও সন্দেহ নেই। অতীত তার প্রমাণ বহন করে। বহু এলাকার আদি বাসিন্দারা বিরক্ত হয়ে ঘরবাড়ি বিক্রি করে চলে গিয়েছেন। ভোটে প্রভাব পড়েছে। স্থানীয় অর্থনীতির বহর বদলে গিয়েছে। কিন্তু তাতে সীমান্ত রক্ষীর দায় কতটা? আর রাজ্য সরকারের দায়িত্বই বা কী? অনুপ্রবেশের জাল একটা এলাকায় বিস্তার ঘটাতে আট-দশ বছর সময় নিয়ে নেয়। ততদিনে অনেক রাজ্যে সরকার পালটে যায়। ততদিনে সেই মানুষজন ভারতীয়ই হয়ে গিয়েছে। এই থিয়োরি যদি বাংলায় সত্যি হয়, তাহলে রাজস্থান, ত্রিপুরা, পাঞ্জাব, কাশ্মীরেও সত্যি।

আরও পড়ুন-সাড়ে তিনশো বছরের ঐতিহ্য মালতীপুর মাতল কালীদৌড়ে

কতটা দীর্ঘ ভারতের সীমান্ত? ১৫ হাজার ৭০৬ কিলোমিটার। তার মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি— ৪ হাজার কিলোমিটার। পাকিস্তান, ভুটান, চিন, মায়ানমার, আফগানিস্তান, নেপালের সঙ্গেও ভারতের সীমান্ত ভাগাভাগি আছে। কিন্তু কোনওটা বাংলাদেশের থেকে বেশি নয়। তার থেকেও বড়ো কথা, সীমান্তবর্তী এলাকা কতটা দুর্গম, সেটা জরিপ করা। পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, চিনের সঙ্গে ভারতের অনেকটা সীমান্ত কিন্তু পবর্ত ঘেরা। অর্থাৎ, দুর্গম। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সেই সমস্যা নেই। বেশিটাই স্থলসীমান্ত, আর কিছুটা জল। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গ, অসম বা ত্রিপুরার বহু জেলা দিয়েই এপার-ওপার করা সম্ভব। সেটাই হয়ে থাকে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নিজেও সেটা স্বীকার করেছেন। তাঁর কথায়, ‘বাংলাদেশের সীমান্ত মোটেই সোজা রাস্তার মতো নয়। ওখানকার পরিস্থিতি ল্যুটিয়েন্স দিল্লিতে বসে বোঝা সম্ভবই নয়। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বহু এলাকায় নদী আছে, ঘন জঙ্গলও। সর্বত্র কাঁটাতার দেওয়া একেবারে অসম্ভব বলছি না। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা এত বড় সীমান্ত ধরে টহল দেওয়া সম্ভব নয়।’ অর্থাৎ, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেনে নিচ্ছেন, নিরাপত্তায় ফাঁক রয়েছে। আর সেই ফাঁক গলে অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে পড়ছে। এই প্রসঙ্গে তিনি কাশ্মীরের কথাও বলেছেন। যদিও উপত্যকার ক্ষেত্রে শাহবাবু খুব একটা উচ্চবাচ্য করেন না। করবেনও না। কারণ, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হওয়ায় ওখানকার নিরাপত্তার সম্পূর্ণটাই তাঁর উপর বর্তায়। তা সে অন্দর হোক বা সীমান্ত। অসম-ত্রিপুরাও তাঁর কাছে স্বর্গরাজ্য। কারও ওই দু’টিই ডাবল ইঞ্জিন। সেক্ষেত্রে বাকি থাকে কী? পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খণ্ড। এই দুই রাজ্যেই অবিজেপি দল শাসিত রাজ্য।
ভোটের সমীকরণ দানা বাঁধতে শুরু করলেই তাই বাংলা ও ঝাড়খণ্ড নিয়ে খোঁচাখুঁচি শুরু করে দেন অমিত শাহ। তাঁর সুরে খোল-করতাল পিটিয়ে ‘গেল গেল’ কীর্তন শুরু করে নিচুতলার চুনোপুঁটিরাও। এই যেমন বাংলায় সেটা এখন শুরুই হয়ে গিয়েছে। ভোটার তালিকার ইন্টেনসিভ রিভিশন এগিয়ে আসছে বলে তথাকথিত নেতারা ময়ূরের মতো হুমকির পেখম দুলিয়ে দুলিয়ে নেচে উঠছেন। সীমান্ত কি বিএসএফের দায়িত্ব নয়? অনুপ্রবেশ যদি ঘটেই থাকে, তাহলে সেই দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক নেবে না কেন? এইসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্য চুনোপুঁটিরা দেবেন না। অমিত শাহ কিন্তু দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যের সারাংশ হল, অত বড় এলাকায় অনুপ্রবেশ ঘটলে বিএসএফের চোখ এড়িয়ে যেতেই পারে। স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন কী করছে? এটা দেখা ওদের দায়িত্ব।

আরও পড়ুন-দুর্গাপুর-কাণ্ডে চারজনের ৫ দিনের পুলিশ হেফাজত, মাঝের ৪০ মিনিট ধোঁয়াশাপূর্ণ

কোনও অনুপ্রবেশকারীই যে এলাকা দিয়ে এদেশে ঢোকে, সেখানে থাকতে শুরু করে দেয় না। চেষ্টা করে সেখান থেকে দূরবর্তী কোথাও চলে যাওয়ার। কখনও ওই রাজ্যে, আবার কখনও দূরে কোথাও। হতে পারে তা নয়ডা, বেগুসরাই, বা বেঙ্গালুরু।
দুই নং কথা, অন্য দেশ থেকে বেআইনি পথে যারা আসে, তারা সেটা নিয়ে ঢাক পেটায় না। ধরে নেওয়া যাক, এক স্বামী-স্ত্রী অবৈধভাবে এপারে এল এবং বনগাঁয় থাকার জন্য মনস্থির করল। তারা কি এলাকায় গিয়ে ঘরে ঘরে কড়া নেড়ে বলবে, শুনুন আমরা বাংলাদেশি। না, তাঁরা কখনওই সেটা করবেন না। তারা সব সময় স্থানীয় কাউকে, অর্থাৎ কোনও দালালকে ধরবে এই কাজগুলো ঘুরপথে করার জন্য। তারাই কথা বলবে, কার কাছে গেলে ভুয়ো পরিচয়পত্র বানানো যাবে, তার হদিশ দেবে। আবার তারাই বাড়ি খুঁজে দেবে। ধীরে ধীরে সেই দম্পতি মিশে যাবে এলাকাবাসীর সঙ্গে। শুধু বাংলা নয়। বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, দক্ষিণ ভারত… সর্বত্র এই চক্র ক্রিয়াশীল। একটা বিষয় পরিষ্কার, অনুপ্রবেশকারী শুধু বাংলায় থাকতেই পারে না।
একটা ছোট্ট হিসেব। অসমে ছ’বছর ধরে এনআরসি প্রক্রিয়া চলেছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এবং গুয়াহাটি হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে। ২০১৯ সালে প্রকাশিত হয়েছিল চূড়ান্ত তালিকা। সেখানে দেখা গিয়েছিল, ১৯ লক্ষ নাম নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ চলে গিয়েছে। তার মধ্যে মুসলিম ৭ লক্ষ। আর হিন্দু ১২ লক্ষ। খরচ হয়েছিল, ১৬০২ কোটি টাকা। তারপরও কিন্তু লাগাতার আবেদন এসেছে ট্রাইব্যুনালে। যাচাই হয়েছে এবং ধীরে ধীরে খালি হয়ে গিয়েছে ডিটেনশন ক্যাম্প। এর উপর ভর করেই হয়ে গিয়েছে খান তিনেক ভোট। কোন নাগরিকের এতে লাভ হয়েছে? কারও না। সবটাই লোকসানের খাতায়। তাহলে লাভের অঙ্কে ফুলেফেঁপে উঠেছে কারা? বিজেপির মতো রাজনৈতিক দল।
যত দিন যাবে, রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন যত কাছে আসবে, অনুপ্রবেশ কথাটা তত জোরে জোরে শোনা যাবে। এসআইআরের পর যদি কোটিখানেক নাম সত্যিই বাদ যায়, তাহলে এই প্রোপাগান্ডা কিছুটা স্তিমিত হবে।
এসব কিছুর জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের প্রত্যেক সৈনিককে তৈরি থাকতে হবে। যোগ্য জবাব দিতে হবে ডিজিটাল যোদ্ধাদের জন্য।
আমরা তৈরি। আপনারা তৈরি তো! বাংলার শত্রুদের হাত থেকে রাজ্যটাকে বাঁচানোর জন্য!

Latest article