জগৎকে ধারণ করেন যিনি

জগতের ধাত্রী যিনি সেই জগদ্ধাত্রী। দেবী পার্বতী এবং মা দুর্গার আর এক রূপ মা জগদ্ধাত্রী। কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে পুজো হয় তাঁর। এই বঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় তিনি বিখ্যাত নানা নামে, নানা রূপে। সেই সব জনপ্রিয় জগদ্ধাত্রীদের কথা লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

রাজসিক দেবী দুর্গা, তামসিক মহাকালীর পরেই সত্ত্বগুণের অধিকারিণী দেবী জগদ্ধাত্রীর আরাধনা হয়। তিনি হলেন দেবী পার্বতীর বা মা দুর্গার আর এক রূপ। ত্রিগুণের আধার। জগৎকে ধারণ করেন। দেব, দত্যি, দানব তাঁর অধীনস্থ। পুরাণ অনুযায়ী, যখন স্বর্গ অসুরদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হল, মহিষাসুর থেকে শুরু করে সমস্ত অসুররা পরাস্ত হল এবং বিজয়ী হলেন দেবতারা তখন অগ্নি, পবন, বরুণ ও চন্দ্র ইত্যাদি দেবগণ আত্ম-অহঙ্কারে ভুগতে শুরু করলেন। এমন অবস্থায় দেবতাদের দর্পচূর্ণ করতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আর্বিভাব। সেখানে হস্তীকে অহঙ্কারের স্বরূপ ধরা হয়। তাঁকেই বধ করেন দেবী।
অপর একটি মত অনুসারে, ত্রেতা যুগের শুরুতে করীন্দ্রাসুর নামে এক হস্তীরূপী অসুরকে বধের জন্য দুর্গার মতোই ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর এই ত্রিদেবের শক্তি থেকে সিংহবাহিনী, চতুর্ভুজা এই দেবীর জন্ম!
পুরাণে তাঁর বর্ণনাটি ভারি সুন্দর। দেবী সিংহপৃষ্ঠে আরূঢ়। নানা অলঙ্কারে ভূষিত। তিনি চতুর্ভুজা, দুই বাম হাতে শঙ্খ ও ধনুক, এবং দুই ডান হাতে চক্র ও পঞ্চবাণ ধারণ করে রয়েছেন। তিনি নাগ-উপবীত ধারণ করেন। দেবী রক্তবস্ত্র পরিধান করেন এবং উষার মতো তাঁর তনু। ষষ্ঠ শতকের গ্রন্থ শ্রীশ্রী চণ্ডীতে জগদ্ধাত্রীর উল্লেখ আছে, সেখানে স্তবে তিনি বিশ্বেশ্বরী জগদ্ধাত্রী বলে পূজিত। জগদ্ধাত্রী সম্ভবত প্রাচীন বৈষ্ণব ধর্মে পূজিত ছিলেন। শাস্ত্রমতে, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে হয় জগদ্ধাত্রী পুজো! বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলনের নেপথ্যে রয়েছে অনেক কাহিনি। আর এই বঙ্গে রয়েছেন হেভিওয়েট মা জগদ্ধাত্রীরা। যাঁরা ঐতিহ্যে, আভিজাত্যে, মহিমায় মহিমান্বিত।

আরও পড়ুন-হ্যালোইন বনাম বাংলার ভূতেরা

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী
জগদ্ধাত্রী পুজো নিয়ে চন্দননগর চন্দননগর করে মাতামাতি থাকলেও এই পুজোর শুরু হয়েছিল নদিয়ার কৃষ্ণনগরে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের হাত ধরে। ১৭৫৪ সালে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় এক বিশাল অঙ্কের কর জমা করতে ব্যর্থ হলে নবাব আলিবর্দি খাঁ তাঁকে কারাগারে বন্দি করেন। তখন ছাড়া পেলেও পরবর্তী সময়ে ১৭৬৪ সালে মিরকাশিম একই কারণে তাঁকে এবং তাঁর পুত্রকে আবার মুঙ্গেরে কারারুদ্ধ করেন। এরপর কারাগার থেকে মুক্তির পেয়ে রাজা জলপথে ফেরার সময় দেখলেন পুজো শেষ। মা রাজরাজেশ্বরী তখন বিসর্জনমুখী। মায়ের মুখ দেখতে না পাওয়ায় রাজা খুব কষ্ট পান। সেই রাতেই রাজা স্বপ্নাদেশ পান এবং দেখেন এক অপরূপ সুন্দরী কিশোরী মূর্তি যে রাজাকে বলে কার্তিক মাসের শুক্লা নবমীতে ‘সপ্তমী’, ‘অষ্টমী’, ‘নবমী’ তিথির সন্ধিক্ষণে তাঁর পুজো করতে। তাহলেই মহারাজের মা রাজরাজেশ্বরীর পুজো দেওয়ার সাধ পূরণ হবে। স্বপ্নে দেবী আরও জানান, পরের মাসেই তিনি রাজবাড়িতে অধিষ্ঠিত হবেন। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র বিষয়টি তাঁর বাবার সঙ্গে আলোচনা করার পর কিছুদিন বাদে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। হরিপুরেই তখন তর্কচূড়ামণি নামে এক ঋষি ছিলেন, যিনি পঞ্চমুণ্ডির আসনে বসে ধ্যানমগ্ন থাকতেন। একটি কামরাঙা গাছের তলায় তাঁর ধ্যানস্থানের পাশেই আজও সেই পঞ্চমুণ্ডির আসন চিহ্নিত হয়ে আছে।
ধ্যানমগ্ন অবস্থায় সেই ঋষি প্রথম জগদ্ধাত্রী দেবীর তেজস্বী রূপের দর্শন লাভ করেন। তিনি দেবীর রূপের বিস্তারিত বর্ণনা দেন— সূর্যের ব্রহ্মমুহূর্তের মতো আলোকোজ্জ্বল, তেজময়ী মূর্তি। এরপর তিনিই প্রথম ঘটে পুজো করে দেবীকে প্রতিষ্ঠিত করেন। পরে সেই মুনি রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে গিয়ে মায়ের রূপ ও দর্শনের কাহিনি শোনান। কথিত আছে, সেই বর্ণনা শুনেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে গড়ে ওঠে জগদ্ধাত্রী দেবীর প্রতিমা। অন্যান্য দেবীমূর্তির থেকে রাজবাড়ির দেবী জগদ্ধাত্রী মূর্তি কিছুটা আলাদা। এখানে মা তাঁর একটি পা ভাঁজ করে ঘোড়ার মুখের দিকে সিংহের উপর বসে থাকেন এবং সিংহের মুখ থাকে সামনের দিকে। অতীতের মতো আজও কৃষ্ণনগরের সব সর্বজনীন প্রতিমা রাজবাড়ির সামনে দিয়ে শোভাযাত্রা করে বিসর্জনে যায়। আগে রাজপ্রাসাদ থেকে রানিরা সেই সব প্রতিমা দেখে প্রথম, দ্বিতীয় নির্ধারণ করতেন। মিলত পুরস্কারও।

আরও পড়ুন-সরকারি চাকরিতে নিয়োগই হচ্ছে না, বেকারত্ব কমবে কী?

চাষাপাড়ার বুড়িমা
বুড়িমা, যাকে দেখলে চোখ ফেরানো দায়। বুড়িমা অভিজাত্য, বুড়িমা ঐতিহ্য, বুড়িমা ম্যাজিক। তার ভুবনমোহিনী রূপে মুগ্ধ আপামর ভক্তকুল। অপূর্ব তাঁর মহিমা। এবছর ২৫২ বছরে পদার্পণ করলেন কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ার জগদ্ধাত্রী ‘বুড়িমা’। কৃষ্ণনগরে রাজবাড়ির পুজো ছাড়া অন্যতম প্রসিদ্ধ জগদ্ধাত্রী। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী বুড়িমার প্রসাদ মুখে দিলে মনস্কামনা পূরণ হয়।
কথিত আছে, একসময় রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ভেবেছিলেন কীভাবে তাঁর এই প্রতিমার খরচ ও আনুষঙ্গিক দায় দায়িত্ব বহন করবেন। এরপরই দেবী তাঁকে পুনরায় স্বপ্নাদেশ দেন, চাষাপাড়ায় যাঁরা লাঠিয়াল আছেন তাঁরাই এই প্রতিমার দায়দায়িত্ব সামলাবেন। তাই এটা ‘লেঠেলদের পুজো’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কৃষ্ণনগরের জগদ্ধাত্রী প্রতিমার মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণালঙ্কার নাকি রয়েছে চাষাপাড়ার বুড়িমার। আনুমানিক ১৭৭২ সাল থেকে কৃষ্ণনগরের চাষাপাড়ায় এই প্রসিদ্ধ জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু হয়। সে সময় পুজোর খরচ জোগাড় হতো দিনুরি প্রথার মাধ্যমে। চাষাপাড়া পুজোর মূল কর্তাব্যক্তিরা খালি বালতি হাতে গোয়ালাদের কাছে হাজির হতেন। তখন গোয়ালারা নিজের সাধ্যমতো কিছু দুধ ওই বালতিতে ঢেলে দিতেন। সেই বালতি ভরে গেলে তখন সে দুধ বিক্রি করে যে পয়সা পাওয়া যেত, সেই পয়সা তুলে রাখা হত বুড়িমার পুজোর খরচের জন্য। সারাবছর ধরে এইভাবে দুধ সংগ্রহ করে সেই দুধ বিক্রির পয়সায় কার্তিক মাসের শুক্ল নবমী তিথিতে জগদ্ধাত্রী মায়ের পুজো করতেন তাঁরা।এই প্রথাকেই দিনুরি প্রথা বলে। এই দুধ সংগ্রহের পাশাপাশি পুজোর সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাপড় চাল, ডাল সংগ্রহ করেও জগদ্ধাত্রী পুজো করা হত। সেই পুজো আজও চলে আসছে। কৃষ্ণচন্দ্রের শহরে মূল পুজো হয় নবমীর দিনেই। এই পুজো দেখতে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় করেন কৃষ্ণনগরে। প্রায় ২ লক্ষ মানুষকে ভোগ প্রসাদ দেওয়া হয়। এই পুজোর জন্য কোনও চাঁদা তুলতে হয় না, মানুষ লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে চাঁদা জমা দিয়ে যান। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ টাকা জমা পড়ে ‘বুড়িমা’র পুজোর জন্য। পঞ্চাশ, ষাট কেজির ওপর সোনার অলঙ্কার রয়েছে বুড়িমার। সেই সব গয়না দিয়ে সাজানো হয় বুড়িমাকে। বুড়িমা’র কপাল জুড়ে থাকে বিভিন্ন আকারের সোনার টিপ। গলায় সোনার চিক, মোটা মালা, নেকলেস, সীতাহার। হাত ভর্তি সোনার বালা থেকে শুরু করে মানতাসা। সঙ্গে জড়োয়ার সেট। বুড়িমা পায়ের নূপুরও পরেন সোনার। দেবীর বাহন সিংহকেও পরানো হয় স্বর্ণালঙ্কার-সহ সোনার মুকুট। বলা হয় বুড়িমা এত জাগ্রত যে বহু ভক্ত সোনার গহনা মানত করেন এবং পূরণ হলে তা দিয়ে যান মাকে। মায়ের বিদায় বেলাতেও আছে বিশেষ রীতি। সুবিশাল প্রতিমা কিন্তু ভক্তদের কাধে চেপেই বিসর্জনের পথে যাত্রা করেন। কৃষ্ণনগরের প্রথা অনুযায়ী সব ঠাকুর বিসর্জন হওয়ার পরে, সবশেষে বিসর্জন হয় ‘বুড়িমার’। প্রথমে কাঁধে করে মূর্তি নিয়ে প্রদক্ষিণ করা হয় কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি। তারপর প্রথা মেনেই জলঙ্গির ঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয় দেবীকে।

আরও পড়ুন-ভোটার তালিকা : পরিযায়ী শ্রমিকদের বিশেষ সুবিধা

তাঁতিপাড়ার বড়মা
কথিত আছে, এই পুজোর সূচনা হয়েছিল কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোর ঠিক পরের বছর। ২৫০ অতিক্রান্ত এই পুজোর। বড়মা যেন একাধারে বুড়িমা-ই, একই অঙ্গে তাঁরা অন্যরূপ দুই বোন। বড়মা’র গায়ের রং শিউলি ফুলের বৃন্তের রঙের মতো। তাই এই জগদ্ধাত্রীকে অনেকে ‘লাল ঠাকুর’ বলেও ডেকে থাকেন। বড়মা’র মূর্তিতে যে কত অলঙ্কার তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। এখানেও ভক্তরা দূর-দূরান্ত থেকে এসে মানত করেন এবং মনস্কামনা পূর্ণ হলে গয়না দিয়ে যান। এটি কৃষ্ণনগরের অন্যতম একটি বড় পুজো হিসাবে গণ্য করা হয়।
কাঁঠালপোঁতার ছোটমা
কৃষ্ণনগরের কাঁঠালপোঁতা বারোয়ারির পুজোয় অন্যতম হলেন বুড়িমা এবং বড়মা’র সবচেয়ে ছোট আরও এক জগদ্ধাত্রী। কাঁঠালপোঁতাতেও বুড়িমার আঙ্গিকেই গড়ে ওঠে এই প্রতিমা। ইনি বুড়িমার ছোট বোন হিসেবেই পরিচিত। তাই এনাকে সবাই বলেন ‘ছোটমা’।
প্রচুর পরিমাণে স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত ছোটমার মহাসমারোহে নবমীতে পুজো হয় কৃষ্ণনগরে।

আরও পড়ুন-রবীন্দ্র সরোবরের পথে সুভাষ সরোবর, প্রথমবার বৃক্ষসুমারি শুরু করছে কেএমডিএ

মালোপাড়া জগদ্ধাত্রী
(জলেশ্বরী মাতা)
এটা হল কৃষ্ণনগরের প্রাচীনতম পুজো। কথিত রয়েছে, কৃষ্ণনগরের মা রাজরাজেশ্বরীর বিসর্জনের দিন জোড়া নৌকার মাঝখানে রাজরাজেশ্বরীকে রেখে এক অদ্ভুত কায়দায় মালোরা দেবীকে ভাসান দিতে নিয়ে যেতেন। এভাবে দীর্ঘদিন চলার পর এলাকার মালো অর্থাৎ জেলে বা মৎস্যজীবীদেরও ইচ্ছে হল ইচ্ছা হল তারা জগদ্ধাত্রী পুজো করবে। তখন তারা রাজার কাছে আবেদন জানায়। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাদের আবেদন মঞ্জুর করে পুজোর অনুমতি দেন এবং পুজোর জন্য প্রয়োজনীয় সব সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিও দেন। রাজবাড়ি থেকে প্রতিমার কাঠামো তৈরির কাঠ এবং পুজোর খরচের জন্য ১১ টাকা বরাদ্দ করেন। ভিন্নমতে আবার শোনা যায়, রাজা সতীশচন্দ্র রায়ের দ্বিতীয় রানি ভুবনেশ্বরী দেবী নাকি ১১ টাকা দিয়ে এই মালোপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজোর শুভ সূচনা করেন। যদিও আজও সেই ধারা অব্যাহত। রানিমার পাঠানো অনুদানটি না এলে পুজো শুরু হয় না এখানে। প্রায় আড়াইশো বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা এই নিয়ম পালন করে আসছে। এই পূজার অন্যতম বিশেষত্ব হল, পুজোর জন্য পাড়ার ছেলেরা শাড়ি পরে, মাথায় ঘোমটা দিয়ে জল ভরতে যায়। জগদ্ধাত্রী পুজোর নবমীর দিন এখানে ‘ধুনো পোড়া’ হয় এবং যার মানত পূরণ হয়, তিনি ভিজে কাপড় পরে মায়ের সামনে সরা নিয়ে বসেন। সরার আগুনে দেওয়া হয় ধুনো। ধুনোর আগুন যত উঁচুতে ওঠে, ততই ভাল বলে মনে করেন সবাই। বাজতে থাকে ঢাকের বাদ্যি। আসলে এর পিছনে রয়েছে অন্য ব্যাখ্যাও। এক সময় মালোপাড়ার পুজো দেখতে রাজা নিজে আসতেন। কিন্তু মাছের তীব্র আঁশটে গন্ধে রাজার যাতে অসুবিধা না হয় তার জন্যই এখানে পুজোয় ধুনো পোড়ানোর চল শুরু হয়। প্রতি বছর এই ধুনো পোড়া স্বচক্ষে দেখতে আসেন হাজার হাজার মানুষ। এই পুজোতে দেবী জগদ্ধাত্রীকে জলেশ্বরী রূপে পুজো করা হয়। তাই মালোপাড়ার প্রতিমার অপর নাম জলেশ্বরী।

কৃষ্ণনগরের নুড়িপাড়ার
‘চারদিনি মা’
কৃষ্ণনগরে সব জগদ্ধাত্রী পুজোই শুধু নবমীর দিনে ধুমধাম করে হলেও নুড়িপাড়ার এই পুজোটা কিন্তু হয় সাবেকি ছন্দে চারদিন ধরেই ঠিক চন্দননগরের মতো। নুড়িপাড়ার জগদ্ধাত্রী পুজোটি তাই এ শহরের ব্যতিক্রমী একটি পুজো। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পর্যন্ত সমস্ত রীতি মেনে এই পুজো চলে। নবমীর পুজোর দিনে বারোয়ারিতে প্রতিমা দর্শনে আসা দর্শনার্থীদের দুপুরে অঢেল খাওয়ানোর ব্যবস্থা থাকে। শোনা যায়, আগে যেহেতু এই এলাকায় কোনও দুর্গাপুজো ছিল না সেহেতু চারদিন ধরে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিলেন উদ্যোক্তারা। এ-বছর ১৩৩ বছরে পদার্পণ করল এই পুজো।
চন্দননগরের ‘আদি মা’ জগদ্ধাত্রী
নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই শুরু চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো। ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর হাত ধরে।
ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ এবং ফরাসি সরকারের দেওয়ান। শোনা যায়, কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়ির পুজোয় অতিথি হিসাবে গিয়েছিলেন তিনি। কৃষ্ণচন্দ্রের বাড়ির সেই পুজো দেখে মুগ্ধ হয়ে যান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী। ইন্দ্রনারায়ণ ছিলেন চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জের চাউলপট্টির বাসিন্দা। সেখানেই চাউলপট্টির নিচুপাটিতে ইন্দ্রনারায়ণ প্রথম শুরু করেন জগদ্ধাত্রী পুজো। তবে এই কাহিনি নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।
অন্য মতে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান ছিলেন দাতারাম শূর। দাতারামের বসবাস ছিল ভদ্রেশ্বরের গৌরহাটি অঞ্চলে। জনশ্রুতি, এখানেই আনুমানিক ১৭৬২ সাল নাগাদ দাতারামের বিধবা মেয়ে তাঁর বাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেছিলেন। অনেকের মতে, এ-পুজোতেও অনুদান দিতেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র। পরবর্তীকালে এই পুজোই স্থানান্তরিত হয় বর্তমানের শিবতলা অঞ্চলে। মাঝে আর্থিক কারণে পুজোটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে গৌরহাটি অঞ্চলের বাসিন্দারা পুজোটির দায়িত্ব নেন এবং সেই পুজোটি আজ এলাকায় পরিচিত তেঁতুলতলার পুজো নামে। এই জগদ্ধাত্রী মা চন্দননগরের ‘আদি মা’ নামে জনপ্রিয়। যুগ যুগ ধরে এখানে পুরুষরাই শাড়ি পরে মাকে বরণ করে নেন। কথিত আছে, ফরাসি শাসনকালে তাদের ভয়ে মহিলারা বাড়ি থেকে বেরতে পারতেন না, তখন পুরুষরাই মহিলা সেজে কনকাঞ্জলিতে মাকে বরণ করতেন। সেই প্রথা আজও চলে আসছে। রীতি মেনে ছাগবলিরও চল আছে এখানে। প্রতিবছর প্রায় ২০০ থেকে ২৫০টি বেনারসী মাকে উৎসর্গ করা হয়। সেই শাড়ি পরে গরিব মানুষদের বিতরণ করা হয়।

Latest article