একটি ব্যর্থ পরিকল্পনা, ফেকু ফেকু কান্না, দীর্ঘশ্বাসের গুনগুন, হতাশার আলপনা

রাজ্য সরকারকে কালিমালিপ্ত করা থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর প্রয়াস, সবেতেই মরিয়া বিজেপি ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। লিখছেন অনির্বাণ সাহা

Must read

কী খারাপ দিনটাই না গেল বিজেপির! প্ল্যান কষাই ছিল। ৬ পার্সেন্ট সাকসেস এসেও গিয়েছিল। রাজ্যব্যাপী সাজ-সাজ রব পড়ে গিয়েছিল। ‘হিন্দু খতরে মে’ আওয়াজ তুলে দাঙ্গা বাধানোর জন্য সবাই তৈরি। গেরুয়া পার্টির অফিসে দীপাবলি-উত্তর দীপ প্রজ্বলন উৎসবময় আবহ। ৬০ মিনিট ধরে কুমন চর্চার আসরে তৃপ্তির ঢেকুর। কিন্তু সব্বনাশ করে ছাড়ল এ-রাজ্যের দুষ্টু পুলিশ। সেই আরজিকর কাণ্ড থেকে এদের চেনা হয়ে গিয়েছে। যত নষ্টের মূলে ওরা। সেবার এমন দুষ্কৃতীকে অপরাধী সাব্যস্ত করল যে সিবিআই তার বাইরে আর কারও কোনও খোঁজ পেল না! ১৫০ গ্রাম বীর্য তত্ত্বের প্রচারক হাসির খোরাক হয়ে গেলেন। স্টুডিওতে স্টুডিওতে মিডিয়া ট্রায়াল এক্কেবারে জলে গেল। সেটিং তত্ত্বের বারুদ মাখিয়েও তাতে আগুন জ্বালানো গেল না। মানুষ বিশ্বাস করল না।
দুর্গাপুরেও তাই। বিপ্লবী বুলি। পড়শী রাজ্যের বিজেপি সরকারের তর্জন গর্জন। পশ্চিমবঙ্গের বদনামের যাবতীয় চেষ্টা দারুণ সফল। কিন্তু, ওই, মোটে কয়েকদিনের জন্য। কারণ, সেখানেও মিডিয়া ট্রায়াল মুখ থুবড়ে পড়ল। গণধর্ষণ যে নয়, তা আগেই পরিষ্কার করে বলে দিয়েছিল পুলিশ। বিজেপি ধরনা মঞ্চ সাজিয়ে প্রতিবাদের নাটক নামাল। মানবে না তারা পুলিশের কথা। এবার ফরেন্সিক পরীক্ষায় নির্যাতিতার পোশাকে সহপাঠীর যৌনরসের নমুনা পাওয়া গেল। ব্যাস! বিজেপির লাগাতার ৬ দিনের ধরনা মঞ্চ ফ্লপ। দুর্গাপুরে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রীর ‘গণধর্ষণের’ অভিযোগকে কেন্দ্র করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জোড়া ফুল-বিরোধীরা। রামরেডের দল।

আরও পড়ুন-হ্যালোইন বনাম বাংলার ভূতেরা

প্রথম দিন সিটি সেন্টারে ধরনা শুভেন্দু অধিকারী শুরু করলেও বিজেপির প্রথম সারির নেতারা আসেননি। শেষ করার কথাও ছিল শুভেন্দুর। কিন্তু শেষ দিনে তিনিও আর পা মাড়াননি ধরনা মঞ্চে। সিপিএমের মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় মিছিল করলেও তার আগেই এই ঘটনা আসলে কী তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে। ওটা গণধর্ষণ নয়। নির্যাতিতা ছাত্রীকে প্রলোভন দেখিয়ে সহপাঠী হস্টেল থেকে নিয়ে যায় এবং কলেজের পিছনের বনাঞ্চলে সেখানে সে ছাত্রীকে ‘ধর্ষণ’ করে। অভিযুক্ত বাকিরা তখন ওই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। তারা বাধা দেওয়ায় সহপাঠী মেয়েটিকে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। অভিযুক্তরা মেয়েটিকে চড়-চাপড় মারে। মোবাইল কেড়ে নেয়। টাকা-পয়সা দাবি করে। সহপাঠী ফিরে আসবে এই আশায় অনেকক্ষণ আটকে রাখা হয় ছাত্রীকে। অনেকক্ষণ বাদেও ছেলেটি ফিরে না আসায় তারা মেয়েটিকে ছেড়ে দেয়। সহপাঠী পালিয়ে গিয়ে খানিকটা দূরে মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু, মেয়েটি দীর্ঘ সময় না আসায় সে তখন আবার ওই জঙ্গলে যায় এবং মেয়েটিকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে হস্টেলে প্রবেশ করে। ওই সহপাঠী ব্যতীত অন্য ওই চার অভিযুক্তই ধর্ষণের সঙ্গে যুক্ত নয়, এমনটাই বলছে পুলিশ। পুলিশি জেরায় ওই পাঁচ অভিযুক্ত নাকি বলেছে, ওই বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের ছেলে-মেয়েরা প্রচণ্ড অসভ্যতামি, নোংরামি করে। সন্ধ্যার পর নিয়ম করে বহু পড়ুয়া ক্যাম্পাসের পিছনের জঙ্গলে যায় শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হতে। এদের কাছ থেকেই চুরি, ছিনতাই কিংবা ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করে এই পাঁচ অভিযুক্ত-সহ বেশ কয়েকজন। মুখে এক গাল মাছি মমতা- বিরোধীদের।
নির্যাতিতার বাবা বললেন, ‘সোনার বাংলা সোনার হয়ে থাকুক। আমরা ওড়িশা চলে যাচ্ছি। আর ফিরে আসব না।’ বাজারি পত্রিকা সেই বক্তব্যকে হেডলাইন করে খবর করল। কিন্তু শেষমেশ সব সত্যি ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়তে অসহায় বাবা বললেন, ‘মমতাদিদি আমার মায়ের মতো, ওঁকে কোটি কোটি প্রণাম। যদি আপনার বিরুদ্ধে কোনও ভুল কথা বলে থাকি… আপনার ছেলের মতো, আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। আমার মেয়েকে ন্যায় দেওয়ার চেষ্টা করবেন।’ বাজারি পত্রিকা এই বক্তব্যকে অনুল্লেখিত অমুদ্রিত না রাখলেও সেটিকে যথোচিত গুরুত্ব দিল না। আর লাল গেরুয়া হাতের কথা এই প্রসঙ্গে যত কম বলা যায়, ততই ভাল।
একটার পর একটা প্রোজেক্ট ফেল করে যাচ্ছে দেখে ধর্ম নিয়ে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা হল। কালী পুজোকে নিয়ে নোংরা ঘৃণ্য খেলা চলল। কালীপুজোকে কেন্দ্র করে তুলকালাম হল কাকদ্বীপে। কাকদ্বীপের সূর্যনগরে একটি মন্দিরের কালীমূর্তি ভাঙা হল। মূর্তি ভাঙাকে কেন্দ্র করে এলাকায় বিক্ষোভ-পথ অবরোধ । রাস্তা অবরোধমুক্ত করতে পুলিশকে মৃদু লাঠিচার্জ করতে হল। শেষ পর্যন্ত অশান্তি থামাতে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রিজন ভ্যানে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হল ভাঙা কালী মূর্তি। এবং আসরে অবতীর্ণ বিজেপি। শমীক ভট্টাচার্য এক্স হ্যান্ডলে লিখে বসলেন, অতীতের দিলীপ এবং বর্তমানের শুভেন্দুর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার বাসনায়, ‘দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ বিধানসভার সূর্যনগর গ্রামপঞ্চায়েতের নস্করপাড়ায় মা কালী মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় গোটা এলাকা ক্ষোভে ফুঁসছে। ভোরবেলায় গ্রামের মানুষ দেখে, মা কালীর প্রতিমা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যে মন্দিরে বছরের পর বছর গ্রামের মানুষ পূজা দিয়েছে, আশ্রয় পেয়েছে, সেই মন্দির আজ অপবিত্র হয়েছে দুর্বৃত্তদের হাতে। …আরও লজ্জাজনক হল প্রশাসনের ভূমিকা। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে প্রথমেই মন্দির বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। যেন অপরাধী ধরার থেকে অপরাধ ঢাকা দেওয়াই তাদের প্রধান কাজ। মানুষের প্রতিবাদের মুখে অবশেষে মন্দির খুলতে বাধ্য হয় প্রশাসন। এখনও পর্যন্ত একটিও গ্রেফতার হয়নি। এই নীরবতা কি কাকতালীয়, নাকি তৃণমূল সরকারের নীরব প্রশ্রয়? প্রশ্ন তুলছে গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগনা। …হিন্দু মন্দিরে আঘাত হচ্ছে, প্রতিমা ভাঙা হচ্ছে, অথচ সরকার চুপ। এই রাজ্যে কি হিন্দুদের অনুভূতির কোনও মূল্য নেই? অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার করা হোক। সঙ্গে প্রশাসনিক গাফিলতির তদন্ত হোক। …তৃণমূল কংগ্রেস যতই ঢেকে রাখতে চাক, মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে — এই রাজ্যে হিন্দু নিরাপদ নয়, কারণ সরকার চোখ বুজে আছে। শুভেন্দু অধিকারী পিছিয়ে থাকবেন কেন? তিনি বলেন, ‘হিন্দুস্তানে কেন এই জিনিস হবে?’ অর্থাৎ হিন্দুস্তানে হিন্দু দেবদেবীর বিগ্রহ ভাঙা হবে কেন? শেষে কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বের হল। দেখা গেল, হিন্দুস্তানে হিন্দু দেবীর বিগ্রহ ভেঙেছে সনাতনী হিন্দুরাই। দাঙ্গা বাধানোর জমি তৈরি করতে। অভিযুক্ত নারায়ণ হালদারকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় সে তার অপরাধ স্বীকার করে এবং তার কাজের জন্য ক্ষমা চায়। ঘটনার সময় সে মদ্যপ ছিল বলে জানা যায়।
যেসব টুনটুনি সোনাটুনিরা ‘মা কালী কেন প্রিজন ভ্যানে’ বলে ফেসবুকে ও রাস্তার বুকে বিপ্লবীপনা দেখাচ্ছিল, তাদেরকেও পুলিশ ‘ক্রোনোলজি’ বুঝিয়ে দিয়েছে।

আরও পড়ুন-জগৎকে ধারণ করেন যিনি

প্রাথমিকভাবে গ্রামবাসীরা মূর্তি বিসর্জন করে পুলিশে অভিযোগের বিষয়ে সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু পরে কয়েকজন সেখানে ঢুকে পড়েন। মূর্তি নিয়ে জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়। অ্যাম্বুল্যান্স-সহ গাড়ি আটকে পড়ে। অবরোধকারীদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ। এরপর ইট ছোঁড়া শুরু হয়। তখন প্রতিমাটিকে পাথরের আঘাত থেকে রক্ষা করতেই কাছে থাকা পুলিশের ভ্যানে তোলা হয়েছিল।
পরিশেষে তিনটি জিজ্ঞাসা। এক, হিন্দু মূর্তি মুসলমান ধর্মাবলম্বী ভাঙছে বলে রটনা করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন হল, দেশ ভাগের পর থেকে স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গ মুসলমান অধ্যুষিত রাজ্য। বিজেপি এখানে আসরে নামার আগে অবধি মন্দির-মূর্তি ভাঙার ঘটনা ঘটেনি। কেন? দুই, ভোট কাছে আসলেই এরকম রটনার দৌরাত্ম্য বাড়ে কেন? তিন, হিন্দু মন্দির ও বিগ্রহ ভাঙার পিছনে বারবার সব জেলাতেই হিন্দুরাই দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে। তখন আর গেরুয়া অভিযোগ ধোপে টিকছে না। কেন? চার, হিন্দু ধর্মে এত্ত বড় ‘আঘাতে’র ঘটনা ঘটে গেল। পদ্মশ্রী কার্তিক মহারাজকে তর্জনী তুলতে কিংবা গর্জন করতে আর দেখা যাচ্ছে না কেন? এই চারটি প্রশ্নের উত্তরেই লুকিয়ে আছে ষড়যন্ত্রের গেম প্ল্যান।
সাধু সাবধান!

Latest article