জিয়ান একটি কবিতার বই

সাহিত্যজগৎ প্রকাশিত রূপম কর্মকারের কাব্যগ্রন্থের উপর আলোকপাত করলেন দেবাশিস পাঠক

Must read

জীবন সম্বন্ধে তত্ত্বকথা বলা কবিতার ধর্ম নয়। জীবনের নানান অভিঘাত হৃদয়মনের নানান প্রতিক্রিয়ার রূপায়িত করাই তার ধর্ম। লিখেছিলেন, অরুণ মিত্র। ‘কবির কথা, কবিদের কথা’য়। এই কথাগুলো মনে করিয়ে দেন রূপক কর্মকার, তাঁর ‘জিয়ান’-এ তিনি যখন লেখেন ‘মনের মাঝে স্বপ্নগুলো / করছে আঁকিবুকি / ইচ্ছেগুলো ছড়িয়ে আছে / রঙিন পাহাড় দেশে, / সময় যে নেই ইচ্ছেগুলো / পূরণ করার শেষে।’ তখন বোঝা যায় সহজিয়া ভাবনা সোজা কথাকে আশ্রয় করে ছন্দোবদ্ধ হয়েছে। দার্শনিক উপলব্ধি হয়তো এতে আছে, কিন্তু বিজ্ঞতার মনোভাব নেই এতটুকু। সব জানা হয়ে গিয়েছে, সব বোঝা হয়ে গিয়েছে, এমন ধারণা জেঁকে বসেনি কোথাও।

আরও পড়ুন-মমতা-অভিষেকের নেতৃত্বে আশ্বস্ত বঙ্গবাসী

বইয়ের আর একটি কবিতায় রূপক লেখেন, ‘মুগ্ধ হয়ে তোমায় দেখি / ফিরিতে চায় না চোখ / শরীর শুধু কষ্ট বোঝে /বলিতে চায় না মন।’ এ তো কেবল একালের কথা নয়, সেকালের কথাও, শাশ্বত প্রেমের চিরন্তন উপলব্ধি, আর সেই অনুভবই দাঁড় করিয়ে দেয় পরের পঙ্‌ক্তিতে, যেখানে কবি বলেন, ‘একাল সেকাল সবকালই যেন / তোমার কাছেই জব্দ। আঁধার মনের সলতে যেন / জ্বলিয়াছে নিঃশব্দে।’ এ যে এক অমোঘ কালাতীত উচ্চারণ, সন্দেহ নেই।
এমন সর্বকালীন একটা প্রেমিককে আসনপিঁড়ি পেতে বুকে বসিয়েছেন বলেই রূপক-কবি অনায়াসে লেখেন, ‘তুমি বলো তুমি নাকি বৃষ্টি ভালোবোসো / কিন্তু বৃষ্টি হলে ছাতার আশ্রয় খোঁজো… তুমি বলো তুমি নাকি উদভ্রান্ত হাওয়ায় ভাসো। কিন্তু ঝড় উঠলে জানালা বন্ধ করো।’ এই দ্বিচারিতা প্রকৃতি প্রেমিক মধ্যবিত্ত যাপনের নিশ্চিত অভিজ্ঞান। এতে অন্তর্লীন দর্শন তাই ‘ভালোবাসা’ কবিতার অন্তিম পঙ্‌ক্তিতে পৌঁছে দেয় এক বিপন্ন অনুভবে, এক শিউরে ওঠানো বার্তায়, ‘তাই ভয় হয় যখন তুমি বলো / তুমি আমায় ভীষণ ভালোবাসো।’ এরকম লাইন আমাদের প্রত্যেককে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। ভিক্টর হুগো বলতেন, সেই কবিতাই প্রকৃত কবিতা, তাই কবিতার শিরোমণি, যার মধ্যে পাই একটা বৃহত্তর ভাব, ‘immensity’ বিশালতা। ‘ভালোবাসা’র মতো কবিতাগুলো এই বইয়ে সত্যিই তাই। অনন্তের বিস্তার, সর্বজনীন তরঙ্গোল্লাস, এইরকম কবিতার প্রাণধর্ম। রোজকার চেনা জীবনের ঝোড়ো-যাপনের ভেতর সেসব কবিতাগুলো যেন হয়ে উঠেছে নিয়তির কণ্ঠস্বর। বুঝতে পারা যায়, কেন রবীন্দ্রনাথ ‘শান্তিনিকেতন’-এ লিখেছিলেন, ‘কবিতা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন সেই শেষ হয়ে যওয়াটাও কবিতার একটা বৃহৎ অঙ্গ।’
রবি ঠাকুরের আক্ষেপ ছিল, তাঁর কবিতা ‘গেলেও বিচিত্রপথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।’ রূপকের ‘জিয়ান’-এ তেমন আক্ষেপ-উক্তির অবকাশ নেই। তাঁর কবিতা মানুষের মন ছুঁয়ে প্রকৃতির বিশালতা ছুঁয়েছে, বাদ রাখেনি রাজনীতির, সমকালীন সমাজ চেতনার বীক্ষাও।
প্রকৃতির প্রেমে মগ্ন কবি এই বইয়ের পাতায় ঋত্বিক হয়ে উঠে লিখেছেন, চৈত্রের দাবদাহে বসন্ত পেরিয়েছে একমনে / কখন ও শান্ত কখন ও তপ্ত সূর্যের কিরণে / কোকিলা যে একমনে ডেকে চলেছে / বসন্ত যে পেরিয়ে যায়নি ক্যালেন্ডারে। … কখন যেন কালো মেঘ ঘনিয়ে আসে। নীল আকাশের বুকে পাখিদের কলরবে / মনে হয় কালবৈশাখী আসছে ধেয়ে / জরাজীর্ণ ধরায় সবুজের খোঁজে।।’
এই কবিরই কলম তাই সৃজনক্ষম এরকম পঙক্তিনিচয়ের, ‘শরৎ ঋতুর জীবন তুমি / অসীম তোমার দান / তুমি বিনা বৃক্ষ যেন চাতক হয়ে রয়। … শত শত কোটায় তোমার / জীবন যেন ধন্য / আকাশ বাতাস লেখে আজই / শ্রাবণেরও গদ্য।… শত শত ফোটায় তোমার / জীবন যেন ধন্য / আকাশ বাতাস লেখে আজই / শ্রাবণেরও গদ্য। … আসো তুমি আসো আজই / কারো নতুন প্রাণের সঞ্চার / ধুয়ে দাও জরাজীর্ণ ধরা / হোক পাখির কলরব।।’
বইতে ব্লার্বে যেটুকু কবি পরিচিতি দেওয়া আছে, তা থেকে জানা যাচ্ছে কবি শিক্ষক, তবে ভাষা-সাহিত্যের নন, সেটা বোঝা যায় ছান্দিক গাঁথনি দেখে, কবিতার শাব্দিক বুনোট ছুঁয়ে ছুঁয়ে। ঠিক যেমন ‘এসো’-র বদলে উল্লিখিত পঙ্‌ক্তিতে ‘আসো’ শব্দের প্রয়োগ ইঙ্গিত দেয়, কবির পূর্বপুরুষ বা বর্তমান প্রতিবেশী বাংলাদেশের সান্নিধ্যে পুষ্ট।
এবং রূপকের রাজনীতি। তাঁর রাজনৈতিক কবিতা। তাঁর কবিতায় রাজনৈতিক প্রসঙ্গ। প্রত্যক্ষ নয়, মোটেই সরাসরি কিছু নয়, কিন্তু স্পষ্ট অনুভববেদ্য। জাতীয়তাবাদী অনুপ্রেরণায় প্রাণিত রূপকের কলম।
তাই তাঁর সোচ্চার ঘোষণা, প্রায় স্লোগানধর্মী উচ্চারণ, ‘রাম রহিম এর দেশে / বন্ধ কি বা শেষে / রক্তগুলো সবারই লাল / দেখবো সবাই শেষে… মরছে রহিম মরছে রাম / মানুষ রূপে শেষে। / আসল ভারত এইটা নাকি!’ এই বিস্ময়াবিষ্ট অনুভববোধ হয় মোদি-ভারতে আমাদের সবারই।
বাঙালি ও বাংলাবিদ্বেষের আবহে কবি রূপকের হিম্মৎ হ্রেষা, ‘বুদ্ধিতে মোরা নেইকো পিছিয়ে। জগৎ মোদের বলে বাঙালি / স্বাধীনতা হোক বা ধর্ম যুদ্ধে / কে আমাদের আজ হারাবি? … সাহিত্যে মোরা অগ্রগণ্য বিজ্ঞানেও সর্বশ্রেষ্ঠ / যুদ্ধে মোরা কালজয়ী / শান্তির মোরা ভক্ত।’ কবিতার নাম ‘ধারেভারে বাঙালি’। তার অন্তিম স্তবকে স্পষ্ট উচ্চারণ, ‘বিশ্ব যেথা কাল ভাবে। বাংলা সেথা আজ’।
অধ্যাপক সুলভ বিশ্লেষণাত্মক মন নিয়ে পড়তে বসলে এই বইতে অজস্র খানাখন্দ চোখে পড়বে। কিন্তু ভাললাগা আর ভালবাসা এই কবিতা গ্রন্থ পাঠের অনিবার্য পরিণাম, সেকথাও জানিয়ে রাখা দরকার।
সুমুদ্রিত গ্রন্থ। বইয়ের ছবিগুলিও মনোগ্রাহী। সাদা-কালো জাদু-চিত্র এঁকেছেন এই বইতে সায়ন কর্মকার, রাজশ্রী বসাক, সন্দীপন রায়। কয়েকটি মুদ্রণ প্রমাদ ও বানান বিভ্রম ছাড়া এই বইয়ের নির্মাণও কবিতাগুলোর মতোই মন-টানা।
বইয়ের নাম : জিয়ান
প্রকাশক : সাহিত্যজগৎ, কলকাতা
লেখক : রূপম কর্মকার
মূল্য : ১৫০ টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা : ৫৬

Latest article