শতবর্ষে বরেণ্য নট কেষ্ট মুখার্জি

সারাজীবন ছিটেফোঁটা সুরাপানে আসক্ত না থেকেও মদ্যপের চরিত্রে অবলীলায় অভিনয় করে দর্শকদের মাতাল করে তুলতে পারতেন তিনি। শুধু কমেডিয়ানই ছিলেন না, নায়কের চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। তিনি কিংবদন্তি অভিনেতা কেষ্ট মুখোপাধ্যায়। তাঁর জন্মের শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলেন শঙ্কর ঘোষ

Must read

প্রস্তাবনা
৫০-৬০-৭০-এর দশক জুড়ে যে সমস্ত কমেডিয়ানরা হিন্দি ছবির সাম্রাজ্যে রাজত্ব করে গেছেন তাঁদের মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য নামটি অবশ্যই জনি ওয়াকারের। কত অজস্র ছবিতে তিনি অদ্ভুত সুন্দর কমেডি অভিনয় করে দর্শকদের মাতিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তী নামটি অবশ্যই মেহমুদ-এর। তিনি শুধু কমেডিয়ানই ছিলেন না, নায়কের চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। মেহমুদের সঙ্গে আরেকটি নাম জুড়ে দিতে হয়। তিনি হলেন আই এস জোহার। তিনি পরিচালক ছিলেন, আবার বিখ্যাত কমেডিয়ানও ছিলেন। আর যেসব কমেডিয়ানকে আমরা পেয়েছি তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাজেন্দ্রনাথ, আগা, ধুমল, মুকরি, অসিত সেন, মোহন চটি, ভগবান দাস, জগদীপ, আসরানি, দেবেন বর্মা প্রমুখ শিল্পী। (অনবধানবশত দু’-একটি নাম বাদ গেলেও যেতে পারে)। সেই সময় কলকাতা থেকে একটি নব্য যুবা বোম্বেতে গিয়ে কমেডি চরিত্রে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন হিন্দি ছবির জগতে। তিনি হলেন কেষ্ট মুখার্জি। দীর্ঘ জীবন পাননি তিনি। অজস্র, অসংখ্য ছবিতেও কাজ করেননি। কিন্তু যা কাজ করে গেছেন তা দর্শকরা চিরদিন মনে রাখবেন।

আরও পড়ুন-আতরের ইতিকথা

কথামুখ
একটি ৮ বছরের ছেলের নাম কাঞ্চন। গ্রাম বাংলার ছেলে। অত্যন্ত দুরন্ত, দুষ্টু। পড়াশোনায় অমনোযোগী। গ্রামবাসীদের অতিষ্ঠ করে মারে। এই নিয়ে নিত্য তার সম্পর্কে অভিযোগ আসে তার মা-বাবার কাছে। একসময় শিশুটি খবর পেল যে কলকাতায় রয়েছে অনাবিল আনন্দ। তখন সে কলকাতা যাওয়ার জন্য মনস্থির করে ফেলে। বাড়ি থেকে পালিয়ে সে পৌঁছে যায় কলকাতায়। এ যেন এক আজব নগরী। বড় বড় বাস চলছে। ট্রাম চলছে। কত গাড়ি-ঘোড়া। কত লোকজন। ভিড় দেখে অবাক হয়ে যায় কাঞ্চন। নানান মানুষের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। তেমনি একজনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে, ফুটপাথের এক জাদুকর। যার নাম ইউসুফ ভেলকিওয়ালা। তার কাণ্ডকারখানা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় শিশু কাঞ্চন। যে ভেলকিওয়ালার কাণ্ডকারখানা দেখে দর্শকরা মুগ্ধ হয়েছেন সেই চরিত্রের শিল্পীর নাম কেষ্ট মুখার্জি। আর ছবির নাম ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। পরিচালক ঋত্বিক ঘটক। প্রসঙ্গত বলি, পরিচালক ঋত্বিক ঘটক এবং অভিনেতা কেষ্ট মুখার্জি দু’জনেরই জন্মের শতবর্ষ চলছে।
শুরুর যাত্রাপথে
কেষ্ট মুখার্জির জন্ম এই কলকাতায় ১৯২৫ সালের ৭ অগাস্ট। ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে কেষ্ট মুখার্জির যোগাযোগ হয়েছিল গণনাট্য সংঘ থেকে। দু’জনেই সেখানে অভিনয় করতেন। ঋত্বিক ঘটক পরিচালনা করতেন। কিছুদিনের মধ্যেই কেষ্ট মুখার্জির সঙ্গে বেশ সখ্য হয়ে গেল ঋত্বিকের। যদিও কেষ্ট মুখার্জি অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। ইংরেজি সাহিত্যের পিএইচডি। তবে তিনি অভিনয়কে আপন করেছিলেন, অধ্যাপনাকে নয়। ঋত্বিক ঘটক তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি ‘নাগরিক’ (১৯৫১)-এ যতীনবাবুর চরিত্রে কেষ্ট মুখার্জিকে নিলেন। এটি তাঁর অভিনয় জীবনের প্রথম ছবি। যতীনবাবু গরিব মানুষ কিন্তু ইলিশ মাছ খেতে ভালবাসেন এবং কীভাবে তিনি ইলিশ খেতে পারেন সেই ভাবনা নিয়ে ছোট্ট একটা চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন কেষ্ট মুখার্জি। এছাড়াও তিনি ঋত্বিক ঘটকের ‘অযান্ত্রিক’ ছবিতে পাগলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
বোম্বাই পাড়ি
তিনি বুঝেছিলেন কলকাতায় তেমন কিছু সুবিধা হবে না। তখন তিনি পাড়ি দিলেন বোম্বাইয়ে এবং সেখানে তিনি প্রথমেই পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করলেন বাঙালি পরিচালক বিমল রায়ের সঙ্গে। বিমল রায় কোনও সুযোগ দিতে পারলেন না। বরং স্টুডিওর গেটটা দেখিয়ে দিলেন। তবে পরে বললেন, ‘‘একটা রোল আছে। এটা কি আপনি করতে পারবেন? কুকুরের ডাক দিতে হবে!’’ কেষ্ট মুখার্জি সেদিন কুকুরের ডাক ডেকেছিলেন, যা শুনে বিমল রায় মুগ্ধ হয়ে যান। আসলে তিনি হরবোলাও ছিলেন। তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা শুনে পরিচালক স্তম্ভিত হয়ে পড়লেন। বললেন— ‘‘আপনি আসবেন’’। এইভাবে বিমল রায়ের ‘পরখ’ ছবিতে তাঁর প্রবেশ ঘটল হিন্দি ছবির মধ্য দিয়ে। ওই ছবিতে কেষ্ট মুখার্জির চরিত্রের নামও ছিল কেষ্ট কম্পাউন্ডার। ওই ছবির নায়ক-নায়িকা ছিলেন বসন্ত চৌধুরী ও সাধনা। বিমল রায় তাঁকে পরে বহু ছবিতে কাজ দিলেন। বিমল রায়ের প্রধান সহকারী হৃষীকেশ মুখার্জি যখন তাঁর প্রথম ছবি ‘মুসাফির’ পরিচালনা করতে নামলেন, তখন তিনি কেষ্ট মুখার্জিকে কাজ দিলেন। বোম্বেতে কলকাতার পরিচালক অসিত সেন যখন গেলেন তখন তিনি তাঁকে কাজ দিলেন। এইভাবে বহু বাঙালি পরিচালকের সাথে তিনি পরপর কাজ করতে শুরু করলেন। সেই তালিকায় আর আছেন শক্তি সামন্ত, বাসু চ্যাটার্জি প্রমুখ পরিচালক।

আরও পড়ুন-জিয়ান একটি কবিতার বই

যে চরিত্রাভিনয়ের জন্য তিনি বন্দিত
সেটি অবশ্যই মাতালের চরিত্র এবং সেই মাতালের চরিত্রে প্রথম সুযোগ পেয়েছিলেন অসিত সেন পরিচালিত ‘মা ঔর মমতা’ ছবিতে। ওই ছবিতে তাঁর সহযোগী শিল্পীরা ছিলেন নূতন, জিতেন্দ্র, মুমতাজ। তখন এমন ঘটনা ঘটল যে হিন্দি ছবিতে মাতালের চরিত্র মানেই কেষ্ট মুখার্জি। মাতাল এবং কেষ্ট মুখার্জি পরস্পরের পরিপূরক হয়ে উঠল। মদ্যপান করে তো কোনও শিল্পী স্টুডিওর ফ্লোরে ঢোকেন না, অথচ তিনি যে মাতালের চরিত্রগুলিতে নিয়মিত অভিনয় করেছেন, এই ছাঁচটা তিনি কোথায় পেলেন? সে ব্যাপারে কেষ্ট মুখার্জি একবার জানিয়েছিলেন যে তিনি যখন জুহুতে ছিলেন তখন একজন পাপড়ওয়ালা পাপড় বিক্রি করত। সেই মানুষটি সর্বদাই মদ্যপান করে থাকত। তার কথা বলার ভঙ্গিটাকে নকল করে নিয়েছিলেন। সেই পাপড়ওয়ালার অঙ্গভঙ্গি লক্ষ করতেন কেষ্ট মুখার্জি। সেটাই তিনি ছবিতে অভিনয়ের সময় কাজে লাগাতেন।
হিন্দি ছবির জয়যাত্রা
অজস্র হিন্দি ছবিতে তিনি কাজ করেছেন। তাঁর কিছু ছবির নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হয়— আশিক, আরতি, ডালমে কালা, বাজি, মেরে আপনে, রাখওয়ালা, পরিচয়, জঞ্জির, পড়োশন, চুপকে চুপকে, তিসরি কসম, মাসুম, প্রেমপত্র, চায়না টাউন, মজলিদিদি, সাধু আউর শয়তান, আনো কি রাত, গীত, নাসিব, দো শিকারি, দ্য বার্নিং ট্রেন, গাজাব, হাম দোনো, রাখওয়ালা, রকি প্রভৃতি।
বাংলা ছবিতে অভিনয়
ঋত্বিক ঘটকের তিন-তিনটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছিলেন। সেগুলি হল নাগরিক, বাড়ি থেকে পালিয়ে এবং অযান্ত্রিক। দিলীপ কুমার-ধর্মেন্দ্র অভিনীত বাংলা ‘পাড়ি’ ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন ‘ত্রয়ী’ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে। সেখানে রাহুল দেব বর্মনের সুরে কিশোরকুমারের গাওয়া একটি বিখ্যাত গান ছিল, ‘এক টানেতেই যেমন তেমন’… সেখানেই ড্রাগ সেন্টার-এর মধ্যে কেষ্ট মুখার্জি ড্রাগের নেশায় বুঁদ হয়ে যেভাবে চোখের ভঙ্গিমা করেছেন এবং নানারকম অঙ্গভঙ্গি করেছেন তাতে দর্শকেরা প্রভূত আনন্দ পেয়েছেন। এই গানটির সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন মিঠুন চক্রবর্তী এবং সৌমিত্র ব্যানার্জি।
উল্লেখযোগ্য চরিত্রায়ণ
‘শোলে’ ছবিতে কেষ্ট মুখার্জি অভিনীত চরিত্রের নাম হরিরাম। চরিত্রটি ইংরেজ আমলের জেলারের (আসরানি) চরের চরিত্র। কমেডির ছিটেফোঁটা নেই। কিন্তু কেষ্ট মুখার্জির অভিনয় দর্শক উপভোগ করেছেন। হরিরাম চরিত্রটি হিন্দি ছবির ইতিহাসে মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। দ্বিতীয় আরেকটি ছবি হল ‘চরস’। সেখানে চরস ধরতে যাওয়ার জন্য ধর্মেন্দ্রর সহকারী হিসেবে যে দু’জন গেলেন, চরসের গুপ্ত আড্ডায় তাঁরা হলেন আসরানি এবং কেষ্ট মুখার্জি। তাঁরা ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন। আসরানি ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন সাহেবের আর কেষ্ট মুখার্জি ছদ্মবেশ নিয়েছিলেন মেম সাহেবের। যতক্ষণ মেমসাহেব রূপী কেষ্ট মুখার্জি পর্দায় রয়েছেন, দর্শক সংলাপ শুনবেন তার কোনও উপায় নেই। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন সিট থেকে মেমসাহেব রূপী কেষ্ট মুখার্জির অভিনয় দেখে। ‘গোলমাল’ ছবির কথাই বা বাদ যায় কী করে? ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে উৎপল দত্ত এবং কেষ্ট মুখার্জি মুখোমুখি। একসময় দু’জনেই গণনাট্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। দু’জনেই অসাধারণ অভিনেতা কিন্তু দর্শকদের মন কিন্তু জিতে নিলেন উৎপল দত্তের পাশাপাশি কেষ্ট মুখার্জিও। কিছু কিছু চরিত্রাভিনয় তাঁকে আলাদা করে রেখেছিল। যেমন গুলজারের ‘কিতাব’ ছবিতে তিনি কিন্তু শঙ্কর পণ্ডিতের ভূমিকায়। সেটি হচ্ছে স্কুলের শিক্ষকের চরিত্র। গুলজারের ‘পরিচয়’ ছবিতে তিনি গৃহশিক্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। মনমোহন দেশাই কেষ্ট মুখার্জির উপরেই একটি গান রেখেছিলেন ‘সাদি বানানে কেষ্ট চলা।’ ছবির নাম ‘চাচা ভাতিজা’। হৃষীকেশ মুখার্জির ‘খুবসুরত’ ছবির জন্য কেষ্ট মুখার্জিকে দেওয়া হয়েছিল best comedian-এর ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। গোড়ার দিকে ‘মুসাফির’ ছবিতেও তিনি করেছেন স্ট্রিট ডান্সারের ভূমিকায়। তাঁর নৃত্যভঙ্গি, কথা বলার ঢং দর্শকদেরকে মাত করে দিয়েছিল।

আরও পড়ুন-বন্যাত্রাণে সাংসদ তহবিল নিয়ে পক্ষপাতের অভিযোগ তুললেন সুখেন্দু শেখর রায়

ব্যক্তিগত কিছু কথা
কেষ্ট মুখার্জি বিয়ে করেছিলেন। তাঁর স্ত্রীর নাম শোভা মুখার্জি। তাঁদের দুই পুত্রসন্তান। বড়টির নাম অশোক মুখার্জি। ছোটটির নাম বাবলু মুখার্জি। বাবলু দু’-একটি ছবিতে এবং সিরিয়ালে অভিনয় করেছিলেন। সুস্মিতা মুখার্জি নামের এক অভিনেত্রী রয়েছেন যাঁকে অনেকেই ভাবতেন কেষ্ট মুখার্জির মেয়ে কিন্তু আদৌ তা নয়। কেষ্ট মুখার্জির মেয়ে সুস্মিতা মুখার্জি নন।
জীবনের শেষ সময়
একটি মোটর দুর্ঘটনায় তিনি গুরুতর আহত হন। তাঁকে ভর্তি করা হয় নানাবতী হাসপাতালে। মাথায় সাংঘাতিক আঘাত লেগেছিল। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন বটে কিন্তু শেষরক্ষা আর হয়নি। ১৯৮২ সালের ২ মার্চ তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তখন তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৬ বছর। জন্মশতবর্ষে এমন এক বরেণ্য নটকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

Latest article