মনে পড়ে সেই ৭০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে হেসিওদের লেখা গ্রিক পুরাণের প্যান্ডোরার বাক্সের কথা! গ্রিক দেব-কুলপতি জিউস মানবদরদি প্রমিথিউসের ঠগামি করার জন্য সেকালের বিশ্বকর্মা হেফাস্টাসকে দিয়ে মানবী প্যান্ডোরাকে বানিয়েছিলেন। জিউস কারসাজি করে প্রমিথিউসের ভাই এপিমিথিউসের সঙ্গে প্যান্ডোরার বিয়ে দেন এবং বিয়ের সময় প্যান্ডোরাকে একটি বাক্স উপহার দিয়েছিলেন; যা ইতিহাসে ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ নামে পরিচিত। মজার কথা, উপহারের সঙ্গে সঙ্গে দিয়েছিলেন কড়া নির্দেশিকা, সেকথা আবার ওই বাক্সটির উপরে লেখা ছিল— ‘কখনো খুলবে না’; অথচ সঙ্গে একটি চাবিও ছিল। এর রহস্য কী!? প্রশ্ন ওঠে স্বাভাবিক ভাবেই, তা সেটা কি নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ, নাকি অজানাকে জানার নিবিড় কৌতূহলপ্রবণতা!
আরও পড়ুন-বাড়ি বাড়ি কমিশন, কড়া নজরদারি তৃণমূলের
ছায়াপথের মহাজোট
আশ্চর্যের বিষয়, ঠিক ওই প্যান্ডোরার বাক্সের মতোই রহস্যে ঘেরা মহাজাগতিক ছায়াপথের একটি মহাজোটের সন্ধান মিলেছে ওই অন্তরীক্ষে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তার নাম রেখেছেন প্যান্ডোরা’স ক্লাস্টার বা প্যান্ডোরার মহাজট! বাস্তবে ওটা একটি জায়ান্ট গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বা ছায়াপথের দানবীয় গুচ্ছ। একটি গ্যালাক্সি ক্লাস্টার বা ছায়াপথের গুচ্ছ হল এমন এক মহাজাগতিক কাঠামো, যা কয়েকশো থেকে হাজার হাজার গ্যালাক্সির সমষ্টি— যেগুলো মহাকর্ষীয় বলের টানে পরস্পর যুক্ত থাকে। এই গুচ্ছগুলির ভর সাধারণত সূর্যের ভরের প্রায় একশো থেকে একহাজার ট্রিলিয়ন গুণ পর্যন্ত হয়ে থাকে। গ্যালাক্সি ক্লাস্টার গঠিত হয় তিনটি প্রধান উপাদানে— গ্যালাক্সি, তাদের মধ্যে থাকা উত্তপ্ত গ্যাস এবং অদৃশ্য অথচ প্রবল ডার্ক ম্যাটার বা অন্ধকার বস্তু। এগুলোই মহাবিশ্বের সর্ববৃহৎ মহাকর্ষীয়ভাবে বাঁধা গঠন— যেখানে কোটি কোটি নক্ষত্র ও ছায়াপথ যেন এক অদৃশ্য শক্তির সুতোর টানে একসঙ্গে আবদ্ধ। বিংশ শতাব্দীর আশির দশক পর্যন্ত এগুলোকেই মহাবিশ্বের সর্ববৃহৎ গঠন বলে মনে করা হত; পরে, সুপারক্লাস্টার বা অতিগুচ্ছ আবিষ্কৃত হলে জানা যায়, সেই বিশালতারও এক বৃহত্তর স্তর রয়েছে মহাবিশ্বের এই অসীম বুননে।
জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা অনুযায়ী ওই বৃহদাকার ছায়াপথ জোটের নাম ‘আবেল ২৭৪৪’। অ্যাবেল ২৭৪৪, যাকে ভালবেসে বলা হয় ‘প্যান্ডোরার ক্লাস্টার’, এক বিশালাকার গ্যালাক্সি গুচ্ছ— মহাবিশ্বের এক জটিল ও মনোমুগ্ধকর সৃষ্টি। এই গুচ্ছটি গঠিত হয়েছে অন্তত চারটি পৃথক, অপেক্ষাকৃত ছোট গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের সংঘর্ষ ও একত্রীকরণের ফলে, যা ঘটেছে প্রায় ৩৫ কোটি বছর ধরে এক দীর্ঘ মহাজাগতিক নাটকের মতো। পৃথিবী থেকে প্রায় চার বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত এই গ্যালাক্সি গুচ্ছটি যেন মহাবিশ্বের ইতিহাসে এক মহাবিস্ময়কর অধ্যায়— যেখানে অসংখ্য নক্ষত্র, গ্যাস, ধূলিকণা এবং অদৃশ্য ডার্ক ম্যাটারের সংঘাত ও সমন্বয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক মহিমান্বিত মহাজাগতিক চিত্রপট। প্যান্ডোরার ক্লাস্টার যেন প্রকৃতির সেই রহস্যময় বাক্স, যার ভিতর লুকিয়ে আছে মহাবিশ্বের উৎপত্তি ও বিবর্তনের গভীরতম গোপন কথা। জগৎ জুড়ে বিজ্ঞানীরা তাই ওঁত পেতে বসে আছেন, বোধহয় সে-কথা শোনার জন্যই!
আরও পড়ুন-বাংলার বকেয়া না দিলে ফের মেগা ধরনা দিল্লিতে, হুঁশিয়ারি অভিষেকের
বৈজ্ঞানিক খোঁজ
একদল বিজ্ঞানী মহাবিশ্বের সেই বিস্ময়কর গ্যালাক্সি গুচ্ছটি নিয়ে গভীর গবেষণা চালিয়েছেন। মহাকাশ ও ভূমি— উভয় ক্ষেত্রেই অবস্থিত দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে, যেমন হাব্ল স্পেস টেলিস্কোপ ও ইউরোপীয় সাউদার্ন অবজারভেটরির ভেরি লার্জ টেলিস্কোপের প্রাযুক্তিক পর্যবেক্ষণের সহায়তায় তাঁরা গড়ে তুলেছেন এই গুচ্ছটির তীব্র জটিল ও অস্থির অতীতের এক বর্ণময় ইতিহাস। গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাবেল ২৭৪৪ যে চারটি স্বতন্ত্র গ্যালাক্সি মহাজাগতিক সংঘাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছে, তার ফলে এমন সব রহস্যময় ও অদ্ভুত প্রভাবের সৃষ্টি হয়েছে, যেগুলো আগে কখনও একসঙ্গে দেখা যায়নি— মহাবিশ্বের নীরব ক্যানভাসে যেন এক প্রবল বিস্ফোরণ, যেখানে আলো, গ্যাস, ধূলিকণা ও অদৃশ্য শক্তি মিলে রচনা করেছে এক আশ্চর্য মহাজাগতিক কাব্য।
ওই দলের একজন বিজ্ঞানী ডঃ জুলিয়েন মার্টেন একটি গবেষণাপত্রে মন্তব্য করেছেন, যেমন কোনও দুর্ঘটনার তদন্তকারী গোয়েন্দা ভগ্নাবশেষের টুকরো জুড়ে ঘটনার রহস্য উন্মোচন করেন, তেমনি আমরা এই মহাজাগতিক সংঘর্ষগুলির পর্যবেক্ষণ থেকে কোটি কোটি বছরের বিস্তৃত সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলিকে পুনর্গঠিত করতে পারি। এই বিশ্লেষণ আমাদের জানায়, কীভাবে মহাবিশ্বে নানা গঠন ও কাঠামো ধীরে ধীরে জন্ম নেয় এবং কীভাবে বিভিন্ন প্রকারের পদার্থ— দৃশ্যমান ও অদৃশ্য— সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে একে অপরের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় মেতে ওঠে। যেন মহাবিশ্বের নিজস্ব এক গবেষণাগার, যেখানে প্রতিটি বিস্ফোরণ, প্রতিটি আলোকরেখা, পদার্থের প্রতিটি বিন্দু এক অনন্ত সৃষ্টির নকশা রচনা করে চলেছে। গবেষক দলের আরেক সদস্য রেনাটো ডুপকে জানান, আমরা একে নাম দিয়েছি ‘প্যান্ডোরা-স ক্লাস্টার’, কারণ এই সংঘর্ষের ফলে যেন একসঙ্গে উন্মোচিত হয়েছে অসংখ্য অদ্ভুত ও বিস্ময়কর মহাজাগতিক ঘটনা। তিনি আরও যোগ করেন, এই সংঘর্ষে যে ঘটনাগুলো প্রকাশ পেয়েছে, তার অনেকগুলিই আগে কখনও দেখা যায়নি। যেন মহাবিশ্ব নিজেই খুলে দিয়েছে প্যান্ডোরার সেই রহস্যময় বাক্স, যার ভিতর লুকিয়ে ছিল আলো, শক্তি ও অজানার এক অলৌকিক বিস্ফোরণ।
নাসা-ইএসএ-র হাবল স্পেস টেলিস্কোপ, ইএসও-র ভেরি লার্জ টেলিস্কোপ, জাপানের সুবারু ও নাসার চন্দ্রা এক্স-রে মানমন্দিরের তথ্য মিলিয়ে অ্যাবেল ২৭৪৪-কে আজ অভূতপূর্ব নির্ভুলতায় পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। উজ্জ্বল গ্যালাক্সিগুলো দৃশ্যমান হলেও তারা ভর-এর মাত্র পাঁচ শতাংশ; বাকি অংশে জ্বলন্ত গ্যাস (২০%) ও অদৃশ্য অন্ধকার পদার্থের (৭৫%) রহস্যময় ছায়া ছড়িয়ে আছে।
ভবিষ্যতের কথা
অ্যাবেল ২৭৪৪ গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে প্রায় ৫০,০০০ নিকট-অবরোধী আলোর উৎস ধরা পড়েছে, যা ক্লাস্টারের জটিল কাঠামো ও মহাজাগতিক গ্রাভিটেশনাল লেন্সের শক্তিকে ফুটিয়ে তোলে। এই লেন্স বিবর্ধন লেন্সের মতো কাজ করে প্রাচীন মহাবিশ্বের দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুবিধা করে দেয়। চন্দ্রা এক্স-রে তথ্য প্রমাণ করে, প্রায় ০.৫–০.৬ বিলিয়ন বছর আগে উত্তর–দক্ষিণ মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছিল; এবং জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ জানায় ওই এলাকায় পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক হাইড্রোকার্বনের নির্গমন শুরু হয়েছে যা ক্লাস্টারের প্রান্তে নতুন তারাদের আগমনের বার্তা বয়ে আনে। এই প্রাকৃতিক মহাজাগতিক ঘটনা প্যান্ডোরার বাক্সের মতোই মানব কৌতূহলকে তার চরম সীমায় পৌঁছে দিয়েছে; জন্ম নিয়েছে দৃষ্টান্তমূলক জেদ, সেই আদিম ব্রহ্মাণ্ডের অজানা বিস্ময় ও জ্ঞানের ভাণ্ডার উদ্ধারের। বিজ্ঞানীদের ধারণা যে কাজ হয়তো কোনও বহু শক্তিশালী প্রযুক্তি ব্যবহার করেও সম্ভব ছিল না, তা এখন প্রাকৃতিক উপায়ে সম্ভব!

