প্রথমে ভয় দেখাও। ঘুম কেড়ে নাও। আতঙ্কিত ত্রস্ত প্রহর গড়ে তোলো চার পাশে। বিপন্ন করে তোলো মানুষকে।
তারপর অন্তিম বিন্দুতে দাঁড়িয়ে বিপন্ন প্রাণের দিকে বাড়িয়ে দাও সাহায্যের হাত। টেনে তোলো তাকে। উদ্ধার করো বিপদ থেকে।
দেখবে, সে তোমাকে ত্রাতা জ্ঞানে সদা প্রভুর মতো পুজো করবে। আর ভোট? সে তো তোমাকেই দেবে। না দিয়ে যাবে কোথায়?
এই ফর্মুলা প্রয়োগ করতে চলেছে বিজেপি এই বঙ্গে।
১৯৭২ সালে ছয় দিদি এবং একমাত্র ভাই দিলীপবাবু বাংলাদেশ থেকে এদেশে আসেন দিলীপকুমার সাহা। গত আগস্টে দক্ষিণ কলকাতার রিজেন্ট পার্ক এলাকায় তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করেছিল পুলিশ। এনআরসি হলে বাংলাদেশে পাঠানো হবে বলে আতঙ্কে ভুগছিলেন ওই ব্যক্তি। সেই আতঙ্ক থেকেই তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। রিজেন্ট পার্ক থানা এলাকার এক বাড়িতে তাঁকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে পান পরিবার ও প্রতিবেশীরা। তাঁর কাছে বৈধ ভোটার আইডি কার্ড এবং অন্যান্য নথি ছিল। একটি সুইসাইড পাওয়া গিয়েছে। সেখানেই এত কথা লেখা ছিল।
আরও পড়ুন-বিমানবন্দরে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনের পাশেই বাসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড
নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী মঙ্গলবার থেকে রাজ্যে শুরু এসআইআর। তারই মাঝে মঙ্গলবারই এনআরসি আতঙ্কে পানিহাটির এক ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন বলেই দাবি পরিবারের। আত্মঘাতী প্রদীপ কর। বছর সাতান্নর ওই ব্যক্তি উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটির মহাজাতি নগরের বাসিন্দা। মৃতের দেহের সঙ্গে একটি সুইসাইড নোট পাওয়া গিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, ওই সুইসাইড নোটে ‘আমার মৃত্যুর জন্য দায়ী এনআরসি’ বলে স্পষ্ট লেখা।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্পষ্ট প্রতিক্রিয়া, প্রদীপ করের মৃত্যুর ঘটনা বিজেপির ভয় এবং বিভেদের রাজনীতির ফল। বিজেপি নিরীহ মানুষদের হুমকি দিচ্ছে, মিথ্যা প্রচার করছে, আতঙ্ক ছড়াচ্ছে এবং ভোট নিয়ে নিরাপত্তাহীনতাকে অস্ত্র করেছে। গণতন্ত্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই দুঃখজনক ঘটনা বিজেপি বিষাক্ত প্রচার কৌশলের ফল।… দিল্লিতে বসে ভারতীয়দের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে আর সাধারণ মানুষ বিদেশি বলে ঘোষণার ভয়ে আত্মহত্যা করছেন।
তিনি কেন্দ্রের জমিদারদের কাছে আর্জি জানিয়েছেন, এই ‘হৃদয়হীন খেলা’ চিরতরে বন্ধ করার জন্য। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য, বাংলা এনআরসি বরদাস্ত করবে না। আমাদের মাটি মা-মাটি-মানুষের। যারা ঘৃণার রাজনীতি করে তাদের সহ্য করে না। দিল্লির জমিদাররা স্পষ্ট করে শুনে নিন। বাংলা সুরক্ষা দেবে।
নাগরিকত্ব নির্ধারণ কোনও অবস্থাতেই নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়। সুপ্রিম কোর্ট সেটা বলেও দিয়েছে। কিন্তু ‘সঙ্ঘী’ জ্ঞানেশের সেকথায় কান দিলে চলে না। তিনি তো অমিত শাহ নামক ‘স্বৈরতন্ত্রী’-এর প্রভুভক্ত ‘পোষ্য বিশেষ’। তিনি তো ভোটার তালিকা সংশোধন নিয়ে ভাবিত নন, তিনি নিজ পরিবারের সদস্যদের প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে কীভাবে ভারতকে আরএসএস-এর মডেল অনুযায়ী হিন্দু বানানো যায়, সেটা নিয়ে চিন্তিত।
আরও পড়ুন-সারান্ডার জঙ্গলে IED বিস্ফোরণে মৃত নাবালিকা
সেজন্যই সুপ্রিম কোর্টের নিষেধ সত্ত্বেও নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা সংশোধনের নামে ঘুরপথে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন প্রয়োগ করছে। SIR-এর নামে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। তাতে প্রাণ বলি দিচ্ছেন দিলীপকুমার সাহা, প্রদীপ করের মতো নিরীহ মানুষ অসহায়ত্বের অন্ধকারে আটকে পড়ে। তারপর শ্মশানে আগুন নেভাতে বসাচ্ছে সিএএ ক্যাম্প। কিনতে চাইছে বাংলার আনুগত্য। কারণ, বিজেপি বাংলা-বিদ্বেষী আর বাংলা বারবার বিজেপিকে ঘাড় ধাক্কা দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ শুধু নয়, আরও অনেক রাজ্যের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। অথচ শুধু বাংলায় এসআইআর হচ্ছে। বাংলা-বিরোধী কারা, বুঝতে অসুবিধা হয় না।
মায়ানমারের ক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত না থাকলেও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আক্রমণ করা হচ্ছে বাংলাকে। ত্রিপুরা থেকে বাংলাদেশি ধরা পড়েছে, অসমে রোহিঙ্গা ধরা পড়েছে। অথচ এই দুই রাজ্যে এসআইআর-এর নাম গন্ধ নেই। কেন? শুধু বাংলার ভাবমূর্তি অবশিষ্ট ভারতের কাছে মলিন করবে বলে? এটাই তো অমিত শাহ অ্যান্ড কোম্পানির উদ্দেশ্য।
আগে ভোটাররা ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করত। আর এখন সরকার ঠিক করবে তারা কাদের ভোট পাবে।
‘SIR করে ভোটার তালিকা ত্রুটিমুক্ত করা লক্ষ্য নয়। যাতে জিততে পারে সেটাই লক্ষ্য। আর যদি ভোটার লিস্ট ত্রুটিযুক্ত হয় তাহলে লোকসভা ভেঙে দেওয়া হোক অবিলম্বে। সে দম তো অমিত শাহদের নেই।
২০০২-এর SIR-এ সময় লেগেছিল দু বছর। এখন নির্বাচন কমিশন বলছে দু মাসে শেষ করবে। আগামী বছর যেসব রাজ্যে ভোট আছে, সেখানে SIR হচ্ছে, কৌশলে কেবল অসমকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ, বিজেপি ক্ষমতায় আছে সেখানে। তাই সেখানে SIR নয়। অসমে হবে না, কিন্তু বাংলায় হবে! তাহলে এক দেশ এক নির্বাচন গল্প দেয় কেন ওরা? কমিশনের কোন নিয়মে লেখা আছে এক রাজ্যে SIR হবে না অন্য রাজ্যে হবে? এর উত্তর কিন্তু কমিশন দিতে পারেনি।
আরও পড়ুন-মহিলাদের নিরাপত্তায় বিশেষ পরিকাঠামো, ৬ কোটি টাকা বরাদ্দ
বিরোধী দলনেতা গদ্দার কুলের পোদ্দার অধিকারী বারবার বলে চলেছেন এসআইআর-এ বাদ যাওয়া ভোটারদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে পুশব্যাক করা হবে। এই ধরনের মন্তব্যকে খুবই সিরিয়াসলি নিয়েছে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষজন। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে তাঁরা নিজেদের দলকেই ছেড়ে দেবেন না বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। এমনকী বিজেপিকে কাঠগড়ায় তুলেছেন মতুয়া, নমঃশূদ্ররাও। শান্তনু ঠাকুর, নিশীথ প্রামাণিক, অসীম সরকার সকলেই ভাবছেন তাহলে বিজেপির মহা বিপদ। আর বিজেপি নেতাদের মুখে ১ কোটি ২০ লক্ষ নাম বাদের আওয়াজ শুনে মতুয়ার পাশাপাশি রাজবংশী, আদিবাসীরাও চরম আতঙ্কে রয়েছেন। দাবি করা হচ্ছে, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ও রোহিঙ্গাদের বাদ দিতেই এই সংশোধন করা হচ্ছে। কিন্তু উপযুক্ত নথির অভাবে ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কায় হিন্দু উদ্বাস্তুরা।
ভোটার তালিকায় নাম থাকলেও আবার মতুয়া, নমঃশূদ্রদের অনেকেই এখনও নাগরিকত্ব পাননি। সেই কারণে ওই অংশের মানুষও আশঙ্কায় আছেন। এই পরিস্থিতিতে আশঙ্কা থেকেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বনগাঁর সাংসদ শান্তনু ঠাকুরকে দাবি করতে হয়েছে, এসআইআর-এ নাম বাদ গেলেও মতুয়া উদ্বাস্তুদের সিএএ-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। আসলে, এসআইআর হলে সবচেয়ে বেশি মতুয়া উদ্বাস্তুদের নাম কাটা যাবে, সেটা শান্তনু ঠাকুররা জানেন। কিন্তু কাঁথির মেজো খোকা বুঝে উঠতে পারছে না।
সুতরাং, খেলা আবার হবে ২০২৬-এ।

