ও ডাঃ বিচিত্রবীর্য! ৩৪ বছরের কথা ভুলে গেলেন?

কীর্তিমান ডাঃ বিচিত্রবীর্য এখন ‘গণশত্রু’র পাতা ভরাচ্ছেন নানা অপপ্রচারে। ওঁর নিজের ও ওঁর পার্টির অপকীর্তিগুলোর কথা তাই মনে করিয়ে দিতে কলম ধরলেন মৃত্যুঞ্জয় পাল

Must read

গত ২৮/১০/২০২৫ তারিখে সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’তে একজন ডাক্তারবাবু (subarna goswami) পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছেন। তিনি ছাত্রাবস্থা থেকেই এসএফআই করতেন। আলোচনা করতেই পারেন। সেটা ওঁর গণতান্ত্রিক অধিকার আর পশ্চিমবঙ্গেই গণতন্ত্রটা এখন বেশি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যা বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের শাসনকালে ছিল না।
উনি যখন এসএফআই করতেন তখন আরজি কর হাসপাতালেই একজন ডাক্তারি ছাত্র সৌমিত্র বিশ্বাস পর্নোগ্রাফি নিয়ে প্রতিবাদ করায় তাকে খুন করা হয় (পরিবারের অভিযোগ )।
ইনি ছিলেন ওই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার তৎকালীন প্রথম সারির ডাক্তারি ছাত্র-নেতা।
আজকে এই ডাক্তারবাবুই বাংলা তথা ভারতবর্ষকে জানিয়েছেন একজন মানুষের ১৫০ গ্রাম বীর্য হয়! আরজি কর-কাণ্ডে সুযোগ বুঝে ঘোলা জলে মাছ ধরতে এসে জেনেশুনে এইভাবেই মিথ্যে খবর রটিয়ে নতুন যুগের ‘বিচিত্রবীর্য’ (subarna goswami) প্রতিষ্ঠা করার কারিগর তিনি।
সিপিআইএম নেতৃত্বাধীন তৎকালীন সরকারের যা ১৯৭৭ থেকে ২০১১ সাল অবধি পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও সংশ্লিষ্ট নারীর ওপর নির্যাতন সংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়টি এতদিন পর জনগণের কাছে পুনঃ উন্মোচনের প্রয়োজন এসেছে।
পশ্চিমবঙ্গে একসময় দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বামের জোট সরকারের আমলে স্বাস্থ্য খাতে নানা ধরনের দুর্নীতি যেমন ধরা পড়েছে তেমনি ধরা পড়েছে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে নারীর ওপর হয়রানি/শ্লীলতাহানি-সহ বহু অনিয়ম।
উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ্য ১৯৯০ সালের বানতলার ঘটনা, যেখানে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের হামলা, ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হতে হয়েছিল।

৩০ মে, ১৯৯০। তিনজন স্বাস্থ্যকর্মী যাদের দুজন ছিলেন ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার, গভর্নমেন্ট অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল এবং একজন ছিলেন UNICEF থেকে, তাঁরা কিন্তু সরকারি কাজে ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামের জন্য এখানে গিয়েছিলেন। টিমের সদস্য ছিলেন অনিতা দেওয়ান, ডেপুটি ডিস্ট্রিক্ট এক্সটেনশন মেডিক্যাল অফিসার ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিপার্টমেন্ট অফ হেলথ অ্যান্ড ফ্যামিলি ওয়েলফেয়ার, শ্রীমতী উমা ঘোষ একজন সিনিয়র অফিসার হেল্থ ডিপার্টমেন্টের ও রেণু ঘোষ একজন প্রতিনিধি UNICEF-এর পক্ষ থেকে। তারা যখন বাইপাস-এর কাছে পৌঁছান চার-পাঁচ জনের কিছু যুবক তাদের গাড়ি আটকায় তাদের ক্লাবের কাছে। বিশ্বস্ত ড্রাইভার যার নাম না উল্লেখ করলেই নয়, অবনী নাইয়া চেষ্টা করেন এই মানুষজনগুলোকে বাঁচাবার জন্য কিন্তু গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে সুপরিকল্পিতভাবে আরও ১০-১২ জন যুবক সেই ঘটনাস্থলে আসেন এবং মহিলাদের উপর চড়াও হন, গাড়ি থেকে তাদের টেনে বার করেন এবং ড্রাইভার বাধা দিতে গেলে কী নির্মম সেই ঘটনা তাঁর যৌনাঙ্গে আঘাত করা হয় এবং গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আর মহিলা অফিসাদের কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে পুলিশ আনলে অনিতা দেওয়ানের অবস্থা দেখে ডাক্তারবাবু অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁর যৌনাঙ্গে মেটালিক টর্চ দিয়ে আঘাত করা হয়। ড্রাইভারকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর সারা দেহে বহু আঘাতের সঙ্গে যৌনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়। তিনিও মারা যান।
বানতলার এই ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলার ইতিহাসে এক ভয়ংকর অধ্যায় বাম আমলে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বিতর্কিত বক্তব্য সমালোচিত হয়েছিল এবং অত্যন্ত নিন্দনীয় ছিল। মন্তব্য ছিল ‘women should not have travelled that late’.
আমরা কি ভুলে গেছি কোচবিহারের নার্স বর্ণালী দত্তের খুনের কথা?
আমরা ভুলে যাব ২০০৩ সালে জাল ওষুধের বিরোধিতা করতে গিয়ে রানাঘাটে খুন হন ডাঃ চন্দন সেন। ২০০৪ সালের ২ জুলাই শ্রীরামপুরে ওয়ালশ-এ ডাঃ সুশীল পালকে খুন করে বিশ্বজিৎ বসু ও তার সহযোগীরা।
সব ভুলে যাবে এই বাংলার মানুষ?
২০০৭ সালে HIV কিট কেলেঙ্কারি।
Monozyme India Pvt Ltd-এর কিটে হাজার হাজার মানুষ HIV আক্রান্ত হল।

২০০৭ সালে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সূর্যকান্ত মিশ্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে অবৈধভাবে তাঁর স্ত্রী ঊষা মিশ্রের এনজিও-কে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার। ২০০৭-২০১২ সাল পর্যন্ত দিঘা ও সংলগ্ন এলাকায় এইডসের বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক প্রচার চালানোর জন্য ঊষার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে স্বাস্থ্য দফতরের এইডস প্রিভেশন অ্যান্ড কন্ট্রোল সোসাইটির তরফে বরাত দেওয়া হয়৷ এর জন্য কেন্দ্রের ন্যাশনাল এইডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশনের ২৯ লক্ষ টাকা দেওয়া হয়৷ সেই টাকা নয়ছয় করা হয়৷ প্রচারের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, ওষুধ না-কিনেও সরকারি টাকা হাতাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুয়ো নথি পেশ করা হয়েছে৷ এমনকী ৯০,৫০০ টাকার একটি হিসেবেও গরিমিল ধরা পড়েছে৷ এখানেই শেষ নয়, প্রমাণ লোপাট করতে বহু নথি সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে চার্জশিটে অভিযোগ করা হয়েছে৷

আরও পড়ুন-বিএলও-দের নিয়ে কমিশনের রাজনীতি, স্পষ্ট জবাব ব্রাত্যর

বাম জামানায় মেডিকেল পড়বার সুযোগ ছিল সীমিত। কঠিন প্রতিযোগিতায় বহু মেধাবী ছেলেমেয়ে যখন মেডিকেলে পড়তে পারত না, তখন দেখা যেত ‘মুখ্যমন্ত্রীর কোটা’য় পার্টির নেতা এবং ঘনিষ্ঠরা প্রতি বছর ১০ জন করে মেডিকেলে চান্স পাইয়ে দেওয়া হত, যাদের অনেকে দ্বিতীয় ডিভিশনে উচ্চমাধ্যমিক পাশ! ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এই কোটা ব্যবস্থার অপসারণ ঘটায়।
চিত্তরঞ্জন সেবাসদনের চিকিৎসক তথা বাম নেতা মহঃ সেলিমের স্ত্রী রোজিনা খাতুন ১৯৮৯ সাল থেকে ওই হাসপাতালের ৪০০০ স্কোয়্যার ফুটের স্যুট দখল করে রাখেন। সর্বহারা নেতা এবং তাঁর স্ত্রীর বিলাসিতার মাঝে কখনও এ-ভাবনা আসেনি যে এই ৪০০০ স্কোয়্যার ফুট জায়গা কত দরিদ্র রোগীকে পরিষেবা দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে! তবুও তা ছিল এমন সুশাসনের অধ্যায়, যেখানে কোনও ‘বিচিত্রবীর্য’ ডাক্তারের কলম ধরতে মন চায়নি প্রতিবাদ রচনায়।

অতীতের একাধিক নির্মম অধ্যায়ের দৃষ্টান্ত শেষ করব এক হতভাগ্য চিকিৎসক-গবেষকের নির্মম পরিণতির কথা টেনে। যিনি হয়তো নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন, কিন্তু সময়ের অভিঘাতে যাঁকে নিতে হয়েছিল আত্মহননের পথ। তিনি ডাক্তার সুভাষ মুখোপাধ্যায়। অনন্যসাধারণ এই গবেষক সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯৭০-এর দশকে টেস্টটিউব বেবি নিয়ে গবেষণা করতেন এবং প্রথম ভারতীয় বিজ্ঞানী হিসাবে সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু লালবাবুরা তাকে ‘উন্মাদ’, ‘প্রতারক’ ইত্যাদি ছাড়া স্বীকৃতি দেননি।
আজকাল বিরোধীরা বলে থাকেন পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে। তাই যদি হবে পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক স্তরে পঞ্চায়েতভিত্তিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও সাব- সেন্টার স্থাপনে অগ্রণী রাজ্যের মধ্যে একটি হয় কী করে? গ্রামীণ এলাকায় block Primary Health Centre ও rural Hospital-এর মাধ্যমে প্রাথমিক চিকিৎসা ও মাতৃ-শিশু পরিষেবা পাচ্ছে কী করে? ১০০% ইনস্টিটিউশনাল ডেলিভারি হচ্ছে কী করে? স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের আওতায় মানুষ বিনামূল্যে বা ক্যাশলেস সুবিধায় চিকিৎসা পাচ্ছেন। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৩৮টি মেডিক্যাল কলেজ, ৪২টি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল করা হয়েছে। ১৩,৫০০-র বেশি সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র হয়েছে। রাজ্যের প্রান্তিক মানুষ আজ নিশ্চিত আছেন সরকারি চিকিৎসা পরিষেবার উপরই। বিনামূল্যে বহু বিরল অস্ত্রোপচার-সহ একাধিক সাফল্য এসেছে গত দেড় দশকে।
আসলে ৩৪ বছর ধরে স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা ধ্বংসস্তূপের উপর ছিল। এখন স্বাস্থ্য-পরিষেবা সাফল্য-স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এবং ভবিষ্যতে আরও-আরও সফল হবে যা মানুষের কাছে স্বপ্নাতীত।

Latest article