SIR নাকি ষাঁড়, তাড়া করছে আমাদের

সার এখন ষাঁড় হয়ে বাংলার মানুষকে গুঁতোতে আসছে! আর সেই সুযোগে বাংলা দখলের ছক কষছে গেরুয়া পার্টি। লিখছেন দেবু পণ্ডিত

Must read

‘স্যার’ (এসআইআর) কখনও কখনও ‘ষাঁড়’ হয়ে যায়। আবার স্যারের আগে ‘ইয়েস’ যোগ করতে গিয়ে, উচ্চারণ বিভ্রাটে, হয়ে যায় ‘ইয়েচ চার’! তাতে বিশেষ ক্ষতি নেই। কারণ, যাঁদের মুখে এই শব্দের জন্ম, সেই খোদ ব্রিটিশরা এই র-এর উচ্চারণ ঠিকমতো করতে পারে না। যাঁদের মুখে এই শব্দের জন্ম, সেই খোদ ব্রিটিশরাও এই ‘র’-এর উচ্চারণ ঠিকমতো করতে পারে না। ব্রিটিশদের অনুকরণে অনেক ইঙ্গো-ভারতীয়কেও ‘র’ বাদ দিয়ে ‘স্যা’ বলতে শুনবেন। বুটজুতা দিয়ে ঠকাস করে শব্দ করে, লম্বা একটা স্যালুট ঠুকে অধস্তন পদধারীও বলে ওঠে, ‘ছ্যা’! ‘ছ্যা’ শুনে আপনার সচেতন কান কুঞ্চিত হতে পারে, মুখ দিয়ে আপনি হয়তো ছ্যা-ছ্যাও করতে পারেন, তবে যাঁকে ‘স্যা’ কিংবা ‘ছ্যা’ বলা হল, তাঁর তাতে ভাবান্তর ঘটে না। আসল ব্যাপার তখন উচ্চারণ ছাড়িয়ে স্যালুটের মধ্যে ঢুকে যায়। তখন স্যালুট, মানে সালাম, মানে সম্মানটাই মুখ্য হয়ে ওঠে। সংঘী জ্ঞানেশ কুমারের অমিত শাহের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন সেই পর্যায়ের কিনা জানা নেই।

আরও পড়ুন-দুর্বল মন্থা, চলবে দুর্যোগ

তবে ‘স্যার’–এর প্রতি অমিত শাহের মতো ব্যক্তিদের এই লালসা আজকের নয়। সেই ব্রিটিশ আমলে ভারতবর্ষে উপনিবেশ গড়েই ইংরেজরা আমাদের ‘স্যার’ বলা শিখিয়েছেন। আমরাও নিজ উন্নতি ত্বরান্বিত করতে ‘স্যার’ বলা শিখেছি। স্যার যে কত বড়, এটা বোঝাতে ইংরেজরা নাইট উপাধির সঙ্গে স্যার যুক্ত করে দিয়েছেন। তবে সেই স্যার বর্জনেরও নমুনা আছে।
আমরা শুধু জানি, ব্রিটেনে ‘স্যার’ শব্দের জন্ম, ফরাসি ‘সিউর’ থেকে। জমির মালিক, সম্ভ্রান্ত আর সম্মানিত মানুষের জন্যই শব্দটি চালু ছিল। যার অন্য মানে ছিল ‘লর্ড’। ফরাসিরা ওটা ছেড়ে বহু আগেই ‘মিসিয়া’ গ্রহণ করেছে। আমরা ফরাসিদের অনুকরণে ‘মিসিয়া’ বা ‘মশিঁয়ে’ অবশ্য বলি না, কিন্তু বলি ‘মশাই’ বা ‘মহাশয়’। স্যার বাংলা (!) কি না, এই দ্বিধা থেকে অনেকে চিঠিপত্রে ব্যবহার করেন ‘মহাশয়’ বা ‘জনাব’। স্যার শব্দের নারীবাচক প্রয়োগে এককালে ব্যবহার হত ‘জনাবা’। ইংরেজিতে অবশ্য স্যারের নারীবাচক কোনও শব্দ গড়ে ওঠেনি।
শিক্ষকতা করবেন, এই ইচ্ছা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী খুলেছিলেন, গুরু হয়েছিলেন। আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করে শেষ বয়সে ‘স্যার’ হয়েছিলেন। কিন্তু পড়ন্ত যৌবনে জালিয়ানওয়ালাবাগের ইংরেজদের নির্লজ্জ হত্যাকাণ্ড দেখে নাইট উপাধি ‘স্যার’ ত্যাগ করেছিলেন।

আসব আসব করছিল। শেষমেশ এসে পড়েছে। এবং এসেই এক এক করে মৃত্যুর কারণ হয়ে চলেছে। রাজ্যের নানা প্রান্তে।
এসআইআর-এর কথা বলা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর চালু হওয়ার কথা বলা হচ্ছে। সার এখানে ষাঁড় হয়ে গুঁতোতে আসছে। রাজ্যে ‘সংঘী’ জ্ঞানেশ কুমারের এসআইআর হামলার ফলে ত্রাহি ত্রাহি রব। শহিদসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা স্পষ্টতর।
পুরো ঘটনাটা পর্যালোচনা করলে যা উঠে আসছে সেটা আসলে পরস্পর বিরোধী দুটি পর্যবেক্ষণ।
এসআইআর তার উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য পূরণ অভীষ্ট ফলদানে ব্যর্থ হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গে অমিত শাহরা এসআইআর চালু করতে চেয়েছিলেন ত্রিবিধ প্রকারে। একেবারে রাবড়ি-পদ্ধতিতে।
প্রথম স্তরে উনুনের গনগনে আঁচ। সেই আঁচে গোটা নাগরিক সমাজ, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে, ত্রস্ত হয়ে উঠবে। বাতাস দিয়ে আগুনের তাপ, আঁচের গনগনে ভাব আরও বাড়ানো হবে। আতঙ্ক ছড়াবে পল্লিতে পল্লিতে। হিন্দুর বস্তিতে, মুসলমান মহল্লায়। কড়াইয়ে দুধ টগবগ করে ফুটবে।
দ্বিতীয় স্তরে কড়াইয়ের দুধের ওপর বাতাস করা হবে। ঠান্ডা করার লক্ষ্যে। আতঙ্কের তাপ কমানোর জন্য থাকবে আশ্বাস শিবির। সেখানে বোঝানো হবে, আরে এসআইআর-এ নাম বাদ গিয়েছে তো কী হয়েছে! সিএএ ফর্ম পূরণ করুন। আবেদন করুন নাগরিকত্ব লাভের জন্য। সিএএ-তে আবেদন করা আর নাগরিকতা লাভ যে সমার্থক নয়, সেটা গোপন করেই এটা করা হবে।

আরও পড়ুন-এসআইআরের নামে নোংরা খেলা, ২০০২-এর ভোটার লিস্ট থেকে রহস্যজনকভাবে নাম উধাও বসিরহাটে

আতঙ্ক সবার জন্য, কিন্তু আশ্বাস কেবল হিন্দুদের জন্য।
২০০২-এর ভোটার লিস্টে কোনও হিন্দুর নাম না থাকলে চিন্তার কোনও কারণ নেই। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন অনুসারে, হিন্দুরা নাগরিকত্ব লাভের আবেদন করলেই সে আবেদন মঞ্জুর হওয়ার বন্দোবস্ত। চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এমন একটা ভাব।
এসআইআর নিঃসন্দেহে আতঙ্কের প্রতিবেশ প্রসৃতি রচনায় আপন সামর্থ্য প্রদর্শন করেছে। কিন্তু এসআইআর-এর অন্তিম স্তর তথা মূল উদ্দেশ্য যেটা ছিল, সেই মুসলমানের নাগরিকত্ব হরণ, তাতে বড়সড় গোলমাল হয়ে গিয়েছে। আতঙ্ক সৃষ্টিতে সফল এসআইআর মুসলমানের নাম কাটতে গিয়ে হিন্দুর প্রাণ কেড়েছে।
বিহারে এসআইআর সব দিক থেকে ব্যর্থ হয়েছে। ভোটার তালিকা প্রস্তুতি ও সংশোধনী সংক্রান্ত প্রতিটি মাপকাঠিতে ব্যর্থতা প্রতিপন্ন হয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটদাতার সংখ্যায় বিরাট হ্রাস। মহিলা ও মুসলমান ভোটারদের শতাংশের বিচারে ব্যাপক পতন। অথচ, একই ঠিকানায় অস্বাভাবিক সংখ্যক ভোটারের বাস, একাধিক কেন্দ্রে একই ভোটারের নামোল্লেখ— এসবে কোনও যতি নেই। কিন্তু এই তথাকথিত তালিকা সংশোধন প্রক্রিয়ার নিবিড়তা আনার জন্য কত না অর্থ ব্যয়িত হল! গরিব মানুষের ওপর কীরকম প্রবল মানসিক বোঝা চাপানো হল! এসআইআর-এর সূত্রে রাজনৈতিক বিপ্লব সংঘটিত হতে চলেছে, এরকম একটা ভাবও ছড়ানো হল।
একেবারে নোটবন্দির কাহিনি। কালো টাকা বিনাশ করার নাম করে নোটবন্দি করা হল। তাতে কিছু মানুষ প্রাণ হারাল। কালো টাকা রয়েই গেল। এও তেমনটাই।
বিহারে অযৌক্তিকভাবে একটা বিরাট সংখ্যক ভোটারকে বিহারের ভোটদান পর্ব থেকে সরিয়ে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। নথিপত্রের সমস্যার কারণে ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন অনেকে। ফের নাম তোলার জন্য তাঁদের মধ্যে অনেকেই আবেদন করেছেন। কিন্তু এর মধ্যেই ভোট প্রক্রিয়া চালু হয়ে যাওয়ায় নভেম্বর মাসের নির্বাচনে তাঁরা ভোট দিতে পারবেন না। নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হলে তাঁরা হয়তো নতুন করে নাম তুলতে পারবেন, কিন্তু বিহারের আগামী সরকার নির্বাচনে তাঁদের মতামতের কোনও জায়গা রইল না।
এখানেও সেইভাবে বৈধ ভোটারকে ভোট প্রক্রিয়া থেকে দূরে রেখে সেই সুযোগে বাংলা দখলের ফন্দি এঁটেছে বিজেপি। আমাদের সর্বশক্তি দিয়ে সেই অপচেষ্টা রুখতে হবে। রুখতেই হবে।

Latest article