আশার অপর নাম সুমন লিন্ডা

৪ঠা অক্টোবর ২০২৫ রাত থেকে উত্তরবঙ্গ ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত। জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা পুরো জলমগ্ন।

Must read

অশোক মজুমদার
শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ
ভীরুতা পিছনে ফেলে—
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর,
অগ্রগতির ‘মেলে’,
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি—
নেই, দেরি নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে
দুর্দম, হে রানার ॥

আরও পড়ুন-গঙ্গাসাগর মেলার পর্যালোচনায় সন্তুষ্ট নবনিযুক্ত জেলাশাসক

মানবতার দুর্ভিক্ষপীড়িত এই পৃথিবীতে যখন কর্তব্যকে ছাপিয়ে যায় মনুষ্যত্বের টান তখন সুমন লিন্ডার মতো এক সাধারণ আশাকর্মীর পথচলাটাও কবি সুকান্তের রানারের মতো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।
কে এই সুমন লিন্ডা? কী করেছে সে? চলুন পরিচয় করিয়ে দিই জলপাইগুড়ি জেলার নাগরাকাটা ব্লকের সকলের প্রিয় আশাদিদি সুমন লিন্ডার সঙ্গে, এমন মেয়ের কৃতিত্বকে সম্মান জানিয়ে রাজ্য সরকার যাঁকে পুরস্কৃত করেছে।
৪ঠা অক্টোবর ২০২৫ রাত থেকে উত্তরবঙ্গ ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত। জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা পুরো জলমগ্ন। কোমরসমান জল বইছে সুমনের খেরকাটা বনবস্তিতেও। এমন বন্যা এলাকায় জীবনে দেখেনি কেউ। সারাটা দিন জলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই কেটে গেল। রাত তখন বারোটা সাড়ে বারোটা। সুমনের মোবাইল বেজে উঠল। খেরকাটারই এক অন্তঃসত্ত্বার প্রসবযন্ত্রণা হচ্ছে, তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আশাদিদি সুমনকে ফোন করেছে মেয়েটির শ্বশুরমশাই।
ফোন পেয়েই সুমন ব্যস্ত হয়ে উঠল বেরোনোর জন্য। কিন্তু এখন বাইরে বেরোনো মানে বিপদ মাথায় করে বেরোনো। রিজার্ভ ফরেস্টে এমনিতেই সারাবছরই হাতি আর চিতাবাঘের ভয় থাকেই। আর এই ভয়ানক বিপর্যয়ে চারদিকে জল থইথই অবস্থায় কোথায় কে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আটকে আছে জানা নেই। তার উপর বন্যায় কারেন্ট না থাকায় চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার।
অন্যান্য সময় হলে সে একাই বেরিয়ে পড়ে ছেলেমেয়েকে বড়ো জায়ের কাছে রেখে। কারণ তাঁর স্বামী কেরলে কাজ করে। বছরে দু-একবার আসে। তবে সৌভাগ্যবশত দুর্গাপুজোয় বাড়ি আসার জন্য সেদিন তিনি ছিলেন।

আরও পড়ুন-ট্রফি জয়ের স্বাদ চান অধিনায়ক, ফাইনালে বৃষ্টির পূর্বাভাস, চিন্তায় দু’দল

আসন্ন শিশু ও মায়ের কথা ভেবেই সুমন স্কুটি বের করলেন, স্বামীকে নিয়ে পৌঁছালেন খেরকাটা বড়ো রাস্তায়। এদিকে মোবাইলে চার্জ কমে আসছে। গাড়ির ব্যাটারিতে মোবাইল চার্জে বসিয়ে ফোন করলেন সরকারি অ্যাম্বুলেন্সে। কিন্তু সে আসবে কী করে? টন্ডুতে ডায়না ও গাঠিয়া নদীর উপর টানাটানি সেতুটাই তো তুমুল জলের স্রোতে ভেঙে গেছে। অ্যাম্বুলেন্স চালক সুমনকে যাহোক করে নদীর ওপারে পৌঁছাতে বলল, সে ওখানেই থাকবে।
এদিক-ওদিক ফোন করে অনেক কষ্টে একটা টোটো শেষমেশ জোগাড় হল। সুমন তাতে করে ওই অন্তঃসত্ত্বা ও তাঁর স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে আসেন টন্ডুতে। কিন্তু এরপর? এবার তো আর গাড়ি যাওয়ার উপায় নেই। এই পরিস্থিতিতে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে কীভাবে?
নদীর ধারে কয়েকজনকে দেখতে পেয়ে সুমন এগিয়ে গেলেন কথা বলতে… ওরা এনডিআরএফ কর্মী; অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটির অবস্থা শোনামাত্র তাঁরা তৎক্ষণাৎ স্পিড বোট নামিয়ে নদী পার করে দিল সকলকে। ততক্ষণে নদীর ওপাড়ে উপস্থিত হয়েছে অ্যাম্বুলেন্সও, দ্রুত মেয়েটিকে সুলকাপাড়া গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গেলেও ডাক্তারবাবুরা তাঁর শারীরিক অবস্থা দেখে মাল সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে রেফার করে।
এদিকে, আশাকর্মী হিসাবে সুমনের সুলকাপাড়া হাসপাতাল অবধিই ডিউটি। কিন্তু ওই অন্তঃসত্ত্বার বাড়ির লোক কিছুতেই তাঁকে ছাড়া মালবাজার যাবে না। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মেয়েটি ও তাঁর পরিজনদের ওই অবস্থায় ফেলে আসতে পারেননি সুমন। তাই ওদের সকলকে নিয়ে মালবাজার ছুটলেন। ততক্ষণে জঙ্গলের গাছগাছালির ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠছে।
অবশেষে মাল সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে মেয়েটি ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়। বন্যার মধ্যে জন্ম বলেই যার নাম রাখা হয় ‘বন্যা’। একটা বিপদসঙ্কুল রাতের শেষে সদ্য জন্মানো শিশুর মা ও তার পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি দেখে তবেই হাসপাতাল ছাড়েন সুমন।
ঘটনার বেশ কিছুদিন পর যোগাযোগ করি সুমনের সঙ্গে। সেদিনের পরিস্থিতির কথা তুলতেই গড়গড় করে নিজের যাবতীয় সাংসারিক, অফিসিয়াল কাজের কথা বলল সে। ওই দুর্যোগের রাতে বেরোতে হয়েছে বলে কোনও আফসোস বা অভিযোগ একবারও শুনলাম না। বরং ও যে শুধুমাত্র ফোনে যোগাযোগ করেই সরকারি ব্যবস্থার সাহায্যে এহেন পরিস্থিতিতে মেয়েটি ও তার শিশুটিকে বাঁচাতে পেরেছে তাতে ভীষণ খুশি।
এমনিতেই এলাকায় সুমনদিদি হিসাবে সে বেশ পরিচিত। আশাকর্মী হিসাবে চব্বিশ ঘণ্টাই তাঁকে অ্যালার্ট থাকতে হয় কখন কীসে ডিউটি পড়ে যায়। কিন্তু তাতে তার কোনও সমস্যা নেই। এমন নয় যে সংসারে তার কোনও সমস্যা নেই। শ্বশুর-শাশুড়ি মারা গেছে। মা-বাবার বাড়ি অনেকটা দূর। পরিযায়ী স্বামীও থাকে না কাছে। ফলে ক্লাস ফাইভ পড়ুয়া ছেলে ও টুয়ের মেয়েকে রেডি করে স্কুলে পৌঁছে সে ডিউটি ধরে রোজ। বিকেলে আবার ছেলেমেয়েকে স্কুল-ফেরত টিউশন করিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রোজই সন্ধে নেমে যায়।
সুমন চাইলেই সেদিন পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যেতে পারত। ৫ তারিখ রাতে নাগরাকাটার অবস্থা ভয়ংকর ছিল। চারদিকে জল বইছে নদীর মতো, সেই অবস্থায় মাঝরাতে জঙ্গলের ভিতর ঘুটঘুটে অন্ধকারে গন্ডার, হাতি, চিতা, সাপের আক্রমণকে তোয়াক্কা না করে সে শুধুমাত্র একটি নবাগত শিশু যেন সুস্থভাবে জন্ম নেয় সেই তাড়নায় বেরিয়ে পড়েছিল। মেয়েটিকে হাসপাতাল পাঠানোর চিন্তা ছাড়া কোনও ভয় তার মানে কাজ করেনি।

আরও পড়ুন-নাগরিকত্বের জন্য ৮০০ টাকা! মতুয়াদের নিয়ে ব্যবসা করছে বিজেপি, তুলোধনা তৃণমূলের

মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং ৬ তারিখ যখন নাগরাকাটা গেলেন দিনের আলোতে যে পরিস্থিতি আমরা সেদিন দেখেছি তা বর্ণনার অতীত। চারদিকে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। তাও সেদিন জল নেমে গেছে। বৃষ্টিও আর হয়নি।
আমি জানতে চেয়েছিলাম, ‘সেদিন যা অবস্থা ছিল তুমি গেলে কেন?’
সুমন অবলীলায় বলল, ‘কেয়া করে সাব; জানা তো পরেগাই। কারোর অসুস্থতা শুনে কি ঘরে বসে থাকতে পারি?’
সুমনের কথা শুনে আমাদের শহুরে রাতদখলের ডাক দেওয়া মেয়েগুলোর কথা মনে পড়ছে। যারা মাঝরাতে আঙুলে সিগারেট ধরিয়ে কেরামতি দেখিয়ে মুক্তমনার ডেমো দেখায়, রাস্তা ফুটপাথ বন্ধ করে উদ্বাহু নাচগান করে বোঝায় তারা শিক্ষিত রুচিশীল এলিট শ্রেণি, মহিলা মুখ্যমন্ত্রীকে অশ্লীল নোংরা ভাষায় কুৎসা করে নারী স্বাধীনতার আওয়াজ তোলে।
আর এদের থেকে কয়েকশো কিমি দূরে আধুনিক নগরসভ্যতাহীন একটি জঙ্গলঘেরা গ্রামের অল্প শিক্ষিত, আদিবাসী একটি মেয়ে রাতের অন্ধকারে একা বিপদকে পায়ে ঠেলে এগিয়ে গেছে শুধুমাত্র মানুষ হয়ে আর একটা মানুষের জীবন রক্ষা করার তাগিদে। তাঁর বোধই তাঁকে মনুষ্যত্বের শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছে। তাই তাকে নারী স্বাধীনতার নামে রাতদখল করার ধুয়ো তুলতে হয় না। সেই স্বাধীনতা সুমন অর্জন করেছে বলেই ওই রাতে তার স্বামী বেরোতে বাধা দেয়নি। এটা বইয়ের পাতা নয় জীবন শেখায়।
আমি সুমনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মুখ্যমন্ত্রী এই বন্যায় তোমার মতো যাঁরা জীবনের পরোয়া না করে কাজ করেছে তাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই সম্মান পেয়ে কেমন লাগছে?’
তাতে ও উচ্ছ্বাস ভরা গলায় বলেছিল, ‘বহুত খুশ হ্যায় হাম। বাড়িতেও সবাই খুব আনন্দ পেয়েছে। দিদি (মুখ্যমন্ত্রী) বহুত আচ্ছি হ্যায়। হাম লোগো কো মা কি তারাহ কিতনা খায়াল রাখতে হ্যায়! হাম সব খুশ হ্যায়।’
সুমন সেই শ্রেণির মানুষ যারা হাজারো অসুবিধার মধ্যে শুধু অভিযোগ করে জীবন কাটায় না। সমাধানে খুশি খোঁজে। সুমন নিজের কী কী অসুবিধা সেসব পাত্তা না দিয়ে বারবার বলছিল সরকারি পরিষেবার কথা। যেটা ওই দুর্যোগেও ভেঙে পড়েনি। এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব মুখ্যমন্ত্রীর; আমি সবসময়ই বলি, কেন ওই সত্তরোর্ধ্ব মহিলাটি বারবার ভোটে জেতে তার রহস্য এই সুমনরা… আর মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া এদের কথা কেউ বলে না। কেউ খোঁজও রাখে না।
সুমনের মতো গরিব, খেটে খাওয়া, ভাঙা ঘর, কোন জঙ্গলের ধারে বাস করা এক আশাকর্মীর খবর মিডিয়া কেন করবে? অথচ সমাজে এরা আছে বলেই তো আমরা শহুরে জীবনে ভাল থাকি। কত আয়োজন আমাদের সুখ কেনার। তার সবটাই তো সুমনের মতো সাধারণ এক সরকারি কর্মীর মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকার কারণেই সম্ভব। তার খবর করতে, তাকে নিয়ে একটা সন্ধ্যা আলোচনা করার মতো মেরুদণ্ডটা আপনাদের বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে যে মুখ্যমন্ত্রীর সরকারি ব্যবস্থায় সুমনরা একটি শিশুকে পৃথিবীর আলো দেখাল, সেই কাজকে সম্মান দেওয়া হল। আপনাদের সেসব খবর করার ইচ্ছেটুকুও ধর্তব্যের মধ্যেই এল না।
একটা সময় ছিল আমরা সাংবাদিকরা দল বেঁধে এইসব খবর করতে যেতাম। কাগজের হেডলাইন হত বড় বড় করে। পাঠকেরা খবর পড়ে আনন্দ পেত। এখন সেসব অতীত। বরং সান্ধ্য আসরে ৫ তারিখে মুখ্যমন্ত্রী কেন উত্তরবঙ্গ না গিয়ে কার্নিভালে নাচলেন সেটাই চেঁচিয়ে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হয়। তাছাড়া রাতজাগা বিপ্লবী যারা ব্র্যান্ডেড পোশাক পরে মুখে ইংলিশ বুলি ছুটিয়ে সরকারকে নিপাত যাও বলবে, আঙুল তুলে সরকারি সিস্টেমকে গালি দেবে …তাদের খবর করাটাও খুব জরুরি। কারণ লোকজন সেই দেখে সোশ্যাল মিডিয়ায় আরও ভরতনাট্যম নাচে। মিডিয়ার টিআরপি বাড়ে।
কিন্তু সুমন লিন্ডারা কাজ করে যায় মানবিক মূল্যবোধ থেকে। তাই আপনারা খবর করুন ছাই না করুন যতক্ষণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও এই সুমনরা ভরসার হাত হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াবে ততক্ষণ আপনাদের ওই রাত দিন দখলের হুজুগ তোলা বেকার খবরের ডাস্টবিনেই ঘোরাফেরা করতে হবে।
পরিশেষে এটুকুই সবাইকে বলার যে, মানুষ হয়ে একটু মানুষের মাঝে যান। সবকিছু সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে সারাদিন এটা কেন হবে? ওটা কেন হল না এসব বলাতে কোন মহত্ত্ব নেই। সামর্থ্য সামান্য হলেও এগিয়ে তো যান, পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা তো করুন। তবেই না একটা সুস্থ সমাজবন্ধনে একে অপরের সুখ দুঃখের শরিক হতে পারব!!
আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো সুমনের আলো যেমন এক জঙ্গল-ঘেরা ছোট্ট জনপদে ছড়িয়ে পড়েছে তেমনি আমাদের পরস্পরের মনেও আলো জ্বলে উঠুক মানবতার, আর তার ছটায় উজ্জ্বল হয়ে উঠুক এ-সংসার।

Latest article