বাংলায় সার (SIR)-এর কারবার

ছিঃ বিজেপি! এই জন্যই বুঝি এখানে এস আই আর চালু হল?লে লে বাবু ৮০ টাকায় হিন্দুত্বের শংসাপত্র, ৮০০-য় নাগরিকত্ব। এটাই চলছে এখন উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে সিএএ সহায়তা শিবিরে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর এবং বিজেপি বিধায়ক সুব্রত ঠাকুরের মতো বিজেপি নেতাদের নয়া কারবার। নাগরিকত্ব দেওয়ার নামে মতুয়াদের ভয় দেখিয়ে তাদের নিয়ে ‘ব্যবসা করছে ওরা। ওদিকে আত্মহত্যা করছে একের পর এক আতঙ্কিত নারী পুরুষ।এজন্যই বুঝি এত কিছু! লিখছেন শমিত ঘোষ

Must read

ফেলুদা থাকলে নির্ঘাত ধরে ফেলতেন ব্যাপারটা। বলতেন, “খটকা! অনেকগুলো খটকা থেকে যাচ্ছে রে তোপসে!” এই মুহুর্তে এস আই আর আর নাগরিকত্ব নিয়ে এমনই অনেক খটকা তৈরী হচ্ছে। সেই খটকাগুলোর কোনো সদুত্তর দিতে পারছেননা কেউই। সেটা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব হোক অথবা নির্বাচন কমিশনের কোনো অধিকর্তা। অনেকেই প্রশ্ন করছেন,যে তৃণমূল কংগ্রেস কেন এস আই আর নিয়ে সরব? তার কারণ স্পষ্ট। তৃণমূল কংগ্রেস চাইছেনা একজনও বৈধ নাগরিকের নাম যেন ভোটার তালিকা থেকে বাদ না যায়। কিন্তু, বিজেপি নেতাদের সাম্প্রতিক প্রায় সমস্ত বক্তব্যতেই একপ্রকার চেতাবনির সুরেই শোনা গেছে, যে এক কোটি ভোটারের নাম নাকি ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাবে! এবং একই সঙ্গে তাদের বক্তব্যে একটা কথা বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, যে এরাজ্যে যেন লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশী অবৈধ অনুপ্রবেশকারীতে ভরে গেছে। এবং এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা মূলত ধর্মে মুসলমান। তাই, এদের নাম বাদ যাবেই! এটা মূলত বিজেপির ন্যারেটিভ। বিজেপির ছোট বড় মেজো নেতারা বিভিন্ন সভা সমিতি, টিভি ডিবেট, সোশ্যাল মিডিয়াতে এই একই কথা সেই কুমীর ছানার গল্পের মতো আউড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তব কি তাই? এই এস আই আরে কি শুধুমাত্র মুসলিমদের নামই বাদ যাবে? হিন্দুরা সবাই সুরক্ষিত? এইখানেই খটকা। সম্প্রতি একাধিক বিজেপিরই বিধায়ক, যারা মূলত মতুয়া অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে জিতেছেন, তাঁরা প্রকাশ্যেই এই এস আই এর নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। বিজেপি বিধায়ক অসীম সরকার তাঁর সামাজিক মাধ্যমে লিখেই দিয়েছেন,”এস আই আরে নাম বাদ দিলেও সি এ এ তে নাগরিকত্ব পাবেনই!” অর্থাৎ শুভেন্দু অধিকারীর মতো নেতারা যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশী মুসলিম, রোহিঙ্গা ইত্যাদি বলে প্রচারে করে গেছেন যে এই এস আই আরে শুধু মুসলিম ভোটারদের নাম বাদ যাবে, তা যে মিথ্যে এবং বিভ্রান্তিকর প্রচার সেটা বিজেপির এই সকল বিধায়কদের নানা ফেসবুক পোস্ট এবং সংবাদমাধ্যমের নানা বক্তব্য দেখে পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন-গঙ্গাসাগর মেলার পর্যালোচনায় সন্তুষ্ট নবনিযুক্ত জেলাশাসক

কারণ, এটা এখন জলের মতোই স্পষ্ট, যে আসন্ন এস আই আরে একটা বড় অংশের হিন্দু (যারা মূলত মতুয়া অথবা যারা গত অর্ধশতাব্দীর বিভিন্ন সময়ে পূর্ব বঙ্গ তথা বাংলাদেশ থেকে এদেশে এসেছেন) এমন ভোটারদের একটা বড় অংশের নাম বাদ পড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এবং বিগত দিনে বাংলাদেশ থেকে আসা এই অংশের উদ্বাস্তু পরিবারগুলোর জন্য এই এস আই আর অত্যন্ত উদ্বেগের। এবং এই উদ্বেগ যে মিথ্যে নয়। বরং এই এস আই আরে যে শুধু মুসলমান নয় বরং হিন্দু উদ্বাস্তু বাঙালীর ভবিষ্যৎকেও একপ্রকার অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো, তা বোঝা যায় সাম্প্রতিক আরো একটি ভিডিওতে। যেখানে রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার বলছেন, ‘’কোনো হিন্দু নাগরিককে নিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়’কে ভাবতে হবেনা। কারণ, তাদের জন্য সিএএ আছে।❞ অর্থাৎ, সুকান্ত মজুমদারও প্রকারন্তরে স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, এস আই আরে একটা বৃহৎ অংশের হিন্দুদের নাম বাদ যেতে চলেছে। এবং তাদের কে ফের নাগরিকত্বের জন্য সিএএ’র মাধ্যমে আবেদন করতে হবে ভারতীয় নাগরিকত্বের জন্য! এই কথাতেই ঈঙ্গিত স্পষ্ট। এই এস আই আরে’র ফলে উদ্বাস্তু, মতুয়া, নমশুদ্র হিন্দু বাঙালী পরিবারগুলোর মধ্যে ভূমিহীন, দেশহীন হওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরী হচ্ছে। কিছু উন্মাদ এখনো বিশ্বাস করে, এইসব করে নাকি মুসলমানদের ‘টাইট’ দেওয়া হচ্ছে! আসলে ক্রমাগত বিকৃত এবং অসত্য প্রচারের ফলে কিছু মানুষ বিভ্রান্ত। কিছু মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে ডুবে আছেন। গত কয়েকদিনে এমন বহু সহ নাগরিকদের সাথে কথা হয়েছে যারা চূড়ান্ত বিভ্রান্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।কারোর পরিবারের অনেকের নাম ২০০২ এর ভোটার লিস্টে নেই। কারোর বাবা মা দুজনের কারোর নামই নেই। কারোর মায়ের আছে,বাবার নেই। কারোর সেই সময়ে বাবা প্রয়াত হয়েছেন। কারোর বাবা মা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন, তাদের এখন ভোটকেন্দ্র পালটে গেছে,এদিকে পুরনো ভোটকেন্দ্র মনে করতে পারছে না! অনেকের আবার যে ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতেন, সেই ভোটকেন্দ্রটাই নেই! কিন্তু, এত সব কিছুর পরেও ধরা গেলো এস আই আরের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হলো। এবং উদ্বাস্তু হিন্দু পরিবারগুলোর অনেকের নাম এস আই আরের তালিকা থেকে বাদ চলে গেলো। তখন? তখন আবার নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। এবং বিজেপি নেতাদের কথা অনুযায়ী, আপনি যদি হিন্দু হন, আপনাকে কিচ্ছুটি চিন্তা করতে হবেনা। আপনি শুধু আবেদন করবেন। আর হাতে গরম নাগরিকত্ব পাবেন! কিন্তু, ব্যাপারটা কি সত্যিই এত্ত সোজা?
এখানেও কয়েকটা ওই যাকে বলে ‘খটকা’ আছে।

আরও পড়ুন-জয়পুরে স্কুলের পাঁচতলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যু ষষ্ঠ শ্রেণির পড়ুয়ার

প্রথমত, সিএএ বলছে,ধর্মীয় নিপীড়নের স্বীকার হয়ে আপনি যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে শরনার্থী হিসেবে আসেন, তাহলে আপনি সিএএ ‘র মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো,একজন নাগরিক কীভাবে প্রমাণ করবেন, যে তিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের স্বীকার? একই সঙ্গে তিনি যে প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে এসেছেন, তার স্বপক্ষে প্রয়োজনীয় নথিও তাকে পেশ করতে হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে লক্ষ লক্ষ মানুষ এক কাপড়ে ওপার বাংলা থেকে এপাড় বাংলায় এসেছিলেন, তাদের ক’জনের কাছে এই সমস্ত সরকারি নথিপত্র আছে?
দ্বিতীয়ত, একজন ব্যক্তি সিএএ’এর মাধ্যমে নাগরিকত্বের আবেদন করলে ঠিক কতদিনের মধ্যে নাগরিকত্ব পাবেন? এসআইআরের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হবে ৭ই ফেব্রুয়ারিতে। সব কিছু নির্ধারিত সময়ে হলে আগামী বছরের মার্চ এপ্রিলেই বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ পর্ব চলবে। তাহলে, ৭ ই ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত চূড়ান্ত তালিকায় যদি কোনো ব্যক্তির নাম না ওঠে এবং সেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি যদি সি এ এ ‘এর মাধ্যমে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। তাহলে তিনি ঠিক কতদিনের মধ্যে নাগরিকত্ব পাবেন? সেই ব্যক্তি কি আদৌ আগামী ২০২৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন?
তৃতীয় আরো একটি জরুরি প্রশ্ন। বিজেপি নেতারা বলছেন, সি এ এ’এর মাধ্যমে অমুসলিম যেকোনো ব্যক্তি যিনি প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে এসেছেন, এমন যেকোনো ব্যক্তিই আবেদন করলেই নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন!
কোনো যাচাই হবেনা? তাহলে, যদি এমন কোনো ব্যক্তি সে হয়তো প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রে অপরাধমূলক কোনো কাজ করে এদেশে নাম ভাঁড়িয়ে চলে এলো। ধরে নিলাম সে ধর্মও বদলে নিলো! তাহলেও কি সে নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে? নিশ্চয়ই নয়। সেক্ষেত্রে তো দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যাবে! তাহলে কিভাবে নাগরিকত্ব পাবে?

আরও পড়ুন-সোনালিকে জোর বাংলাদেশে পাঠিয়েছে বিজেপি, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় রয়েছে বাবা-মা, তোপ তৃণমূলের

এরকম অজস্র বিভ্রান্তির মধ্যেই দিন কাটছে এই বাংলার কোটি কোটি মানুষের। আতঙ্কে আত্মহননের পথ অবধি বেছে নিচ্ছেন বহু সহনাগরিক। যদিও বিজেপি নেতারা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। তাঁরা অভয়বাণী দিয়ে চলেছেন,’ সি এ এ আছে কিচ্ছু হবেনা।’ সি এ এ ‘তে নাম তুলিয়ে দেওয়ার নাম করে ক্যাম্প অবধি খুলে বসেছেন বিভিন্ন জায়গায়। অভিযোগ, সেই সব ক্যাম্পে নাকি টাকার বিনিময়ে নাগরিকত্বের আবেদন করতে হচ্ছে। ঠিক যেভাবে কয়েক মাস আগে বিজেপি সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুর ‘মতুয়া কার্ড’ বিলি করেছিলেন। অভিযোগ সেই কার্ডও নাকি বহুক্ষেত্রে টাকা দিয়ে কিনতে হয়েছিলো। শান্তনু ঠাকুররা ঘোষণা করেছিলেন, এই মতুয়া কার্ডই নাগরিকত্বের পরিচয়। এই কার্ড থাকলেই আসমুদ্র হিমাচল আপনি নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারবেন। যদিও কয়েকমাস আগেই আমরা দেখলাম বিজেপি শাসিত মহারাষ্ট্রেই দুই মতুয়া ভাইকে বাংলাদেশী সন্দেহে আটক করে সেখানকার পুলিশ প্রশাসন। শান্তনু ঠাকুরের দেওয়া মতুয়া কার্ড দেখিয়েও রেহাই পাননি দুই ভাই। কার্যত ওই মতুয়া কার্ডকে গ্রাহ্যই করেনি মহারাষ্ট্রের বিজেপি সরকার! এবারও ফের একবার সি এ এ তে নাগরিকত্ব পাইয়ে দেওয়ার নাম করে টাকা তোলার অভিযোগ আসছে! বিভ্রান্ত এবং অনিশ্চিত জীবনের অতল সাগরে পড়ে যাওয়া লক্ষ লক্ষ বাঙালী এখন দিশাহীন। আর সেই সুযোগেরই সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এই রাজনৈতিক ফোঁড়েরা! তাতে কি? সেই ধান্দাবাজি করবার এখনও চলছে।
একটা কথা অবশ্যই সকলকে মাথায় রাখতে হবে,বিজেপি নেতাদের মুখের কথা আর ফলিত ক্ষেত্রে তাদের কাজের মধ্যে আসমান জমিন পার্থক্য। এই এস আই আর কে কেন্দ্র করে উদ্ভুত জটিল পরিস্থিতি সেটা আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। তাই, প্রতিটি বৈধ নাগরিকের নাম যেন ভোটার তালিকায় থাকে তা নিশ্চিত করাটা আশু কর্তব্য। দিল্লির জমিদাররা বাঙালীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছে। বাঙালীকে ভূমিহীন করার ঘৃণ্য প্রয়াস শুরু হয়ে গেছে। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে ম্যান মার্কিং করে রুখে দেওয়াটাই আসল লক্ষ্য।

Latest article