সার (SIR) সার (SIR) করছেন, ‘সার’-এর সারাংশ জানা আছে তো!

স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। সরাসরি জানাচ্ছি। যেসব রামরেড ‘সার’-সমর্থক হয়ে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করছেন, এই উত্তর সম্পাদকীয় নিবন্ধ তাঁদের জন্য। লিখেছেন সঙ্গীতা মুখোপাধ্যায়

Must read

গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গে নয়, দেশের এক ডজন রাজ্যে। কেতাবি ভাষায় নাম ‘স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন’, সংক্ষেপে এসআইআর বা ‘সার’ (SIR)। সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের প্রতিটি জেলার প্রায় প্রত্যেকটি মানুষ জাতীয় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকা মেনে ২০০২ সালের যে ভোটার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, সেই তালিকায় নিজের বা নিজের বাবা-মায়ের নাম রয়েছে কি না সেটা মিলিয়ে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
এই ব্যস্ততা খুবই স্বাভাবিক। কারণ, ২০০২-এর ভোটার তালিকায় নিজের অথবা নিজের পরিবারের কারও নাম খুঁজে না পেলে অনেক কিছু বিপদ হতে পারে। তাকে বা তাদের ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে অমিত শাহের দফতর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তাদের ভারত থেকে পুশব্যাক করে বাংলাদেশে কিংবা দেশের বাইরে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এমন হুঁশিয়ারি মোদি-শাহ এবং তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গদের তরফে হামেশাই দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু অদ্ভুতভাবে ২০০২ সালের যে ভোটার তালিকাকে জাতীয় নির্বাচন কমিশন কার্যত বেদবাক্যের মতো ধ্রুবসত্য বলে ঘোষণা করেছেন, সেই ২০০২ সালের ভোটার তালিকা থেকেই রাতারাতি উধাও হয়ে যাচ্ছে এক-একটি গ্রাম, এক-একটি পল্লি, এক-একটি বুথ এবং তার সঙ্গে বেশ কিছু মানুষ। এক-একটি বুথে যেখানে ১২০০ থেকে ১৩০০ ভোটার আছেন কিংবা থাকার কথা, দেখা যাচ্ছে ২০০২ সালের প্রকাশিত ভোটার তালিকায় সেই বুথের কোনও অস্তিত্বই নেই। কিংবা বুথের নাম ও নম্বর ভোটার তালিকায় থাকলেও সেখানে কোনও ভোটারই নেই! এমতাবস্থায় জাতীয় নির্বাচন কমিশন অভিযোগে অভিযোগে বিদ্ধ। এভাবে ভোটার তালিকা থেকে রাতারাতি ভোটারদের নাম অথবা গোটা বুথের অস্তিত্ব অবলুপ্ত করে আতঙ্কজনক পরিবেশ তৈরি করছে। পুরো ব্যাপারটায় কুঅভিসন্ধি সুস্পষ্ট বলেই তৃণমূল কংগ্রেস এসআইআর-এর চালু পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ার বিরোধিতায় পথে নেমেছেন। নেতৃত্বে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সেনাপতিত্বে যুব নেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
আতঙ্ক সৃষ্টির প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে গুমা এলাকার কথা। উত্তর ২৪ পরগনার গুমা। সেখানকার মালিপাড়া শিশুশিক্ষা কেন্দ্র। বুথ নং ১৫৯, ২০০৩ সালের তালিকায় নাম রয়েছে অনেকেরই। ওই তালিকা (২০০৩-এর) অনুসারে এই বুথে মোট ভোটার সংখ্যা ৪৩৬। তারমধ্যে পুরুষ ২২৭। মহিলা ২০৯। কিন্তু অনলাইনে ২০০২-এর তালিকায় এঁদের অনেকেই নেই। স্থানীয় বিএলও নাকি বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছেন। জানানো হয়েছে নির্বাচন কমিশনকেও। কতদূর বিষয়টার বিহিত করা হবে, সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন।

গুমা ১ নম্বর পঞ্চায়েতের ৬১ নং বুথ। সেখানে ২০০২ সালের ভোটার তালিকা কমিশনের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে। তাতে ৩৪৩ থেকে ৪১৪ নম্বর ক্রমাঙ্ক বিশিষ্ট ভোটারদের নাম উধাও। অনলাইন তালিকায় এঁদের হদিশ না মিললেও ওই তালিকার হার্ড কপিতে এই ভোটাররা স্বমহিমায় উপস্থিত। ৭১ জন ভোটারের নাম নিয়ে বিভ্রান্ত।
সবাই বলাবলি করছে। এভাবে এক কোটি ভোটারের নাম বাদ দেওয়ার কথা সদর্পে বলে বেড়াচ্ছেন কাঁথির মেজ খোকা।

ওই উত্তর ২৪ পরগনা জেলারই বসিরহাট। সেখানকার ১৯৮ পার্টের ভোটার লিস্ট। জাতীয় নির্বাচন কমিশন এই পার্টের যে ভোটার তালিকা অনলাইনে আপলোড করেছে, তাতে ১৫৯ নম্বর থেকে ৮৯২ নম্বর পর্যন্ত ভোটারদের কোনও অস্তিত্ব নেই। অথচ বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় যে ভোটার তালিকা দেখে ভোট হয়েছিল তার হার্ড কপিতে এই নামগুলো জ্বলজ্বল করছে।

আরও পড়ুন-আইএনটিটিউসির কর্মিসভায় এসআইআর নিয়ে কেন্দ্রকে তুলোধনা রাজ্য সভাপতি ঋতব্রতর

লোকে তাই বলাবলি করছে এসআইআর (SIR) মানে স্পেশাল ইনটেনসিভ রিভিশন নয়, এ হল সাইলেন্ট ইনভিজিবল রিগিং। বিশেষ নিবিড় সংশোধন পরিণত হয়েছে নীরব অদৃশ্য ভোটচুরিতে। চুপি চুপি ভোটে কারচুপি করে বামফ্রন্ট চালু করেছিল সায়েন্টিফিক রিগিং। আর গেরুয়া পার্টি চালু করল সাইলেন্ট ইনভিজিবল রিগিং।
কোচবিহারের নাটাবাড়ি। বুথ নং ২। ২০০২-এর ভোটার তালিকায় নাম ছিল ৭১৭ জনের। অনলাইনের লিস্টে দেখা যাচ্ছে নামের সংখ্যা কমে সেখানে মোটে ১৪০!

উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগর। সেখানকার ১৫৯ নম্বর বুথ। ৯০০ ভোটার ছিল। এখন একটাও নেই!
উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট। সেখানকার সংগ্রামপুর শিবহাটি গ্রাম। ভোটগ্রহণ কেন্দ্র গ্রামের বিরামনগর স্কুল। ভোটার লিস্টে পার্ট নম্বর ১৯৮। জাতীয় নির্বাচন কমিশন অনলাইনে এই পার্টের যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে ৮৫৯ থেকে ৮৯২ পর্যন্ত ক্রমাঙ্কের ভোটারের কোনও অস্তিত্ব নেই। অথচ ২০০২ সালের প্রকাশিত ভোটার তালিকার হার্ডকপিতে এই সবক’টা নাম আছে।
এসআইআর চালু হওয়ার তিনদিনের মধ্যে বাংলার সর্বত্র বিজেপি-নির্বাচন কমিশন যৌথ জালিয়াতির এইসব খণ্ডচিত্র সামনে এসেছে।
এই টুকরো ছবিগুলো জুড়লেই তৈরি হচ্ছে একটা পূর্ণাঙ্গ কোলাজ চিত্র। তাতেই প্রকাশিত ‘সার’ (SIR)-এর সারাংশ।
হিন্দু, মুসলমান, মতুয়া, রাজবংশী। এককথায় প্রান্তিক মানুষের নাম নির্বিচারে কাটা হয়েছে এবং হচ্ছে।
খোদ কলকাতাতেও হচ্ছে। আসাইকা বেগম এবং জামিল রহমানের। আগে থাকতেন ৪/১ এইচ/১৩ জে কে ঘোষ রোড, কলকাতা ৩৭, এই ঠিকানায়। ভোট কেন্দ্র ছিল বেলগাছিয়া মনোহর অ্যাকাডেমি। পরবর্তীকালে ২০০৮-এ ভোটার কার্ড আসে। ঠিকানা তখন ৮৩ই/১ বি/এইচ/১২ বেলগাছিয়া রোড, কলকাতা ৩৭। ভোটকেন্দ্র বদলে ব্লু বেল ডে স্কুল।
আগের নির্বাচনের ভোটার তালিকায় নাম আছে। ২০০২-এর অনলাইন ভোটার তালিকায় ‘জাস্ট’ নেই।
কী করবেন, বুঝে পাচ্ছেন না, আতঙ্কে প্রহর কাটাচ্ছেন। আর দানবের দল হিংস্র নিশ্বাস ফেলছে চারিদিকে।
আতঙ্কিত হয়ে লাভ নেই। লড়াইয়ের জন্য চোয়াল শক্ত করুন। অধিকার পাওয়ার জন্য লড়াই করতেই হবে।
নো পাসারন।

Latest article