শিশুর শরীরে শীতের ছোঁয়া

শিশুর কোমল শরীরে শীতের হিমেল স্পর্শ সবসময় সুখকর হয় না। কেননা শীতের সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে নেমে আসে সংক্রমণের ভয়! এমন কিছু বিরলতম সংক্রমণ রয়েছে যাদের নামও অনেক অভিভাবকই জানেন না। জরুরি জনসচেতনতা। সেই নিয়ে প্রথম পর্বের আলোচনায় তুহিন সাজ্জাদ সেখ

Must read

শীতের প্রসঙ্গ
আমাদের দেশে শীতের আনন্দের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বিপদের হাতছানি, যা শিশুর শ্বাসনালি ও সংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। সাধারণ সর্দি, ফ্লু এবং নিউমোনিয়ার মতো রোগ এখানে বেশি প্রাধান্য পেলেও আছে এমন বেশকিছু বিরল সংক্রমণ যা শিশুর জীবনহানি পর্যন্ত ঘটাতে পারে। এসব রোগ প্রায়ই পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাব, নির্ণয়ের জটিলতা এবং আঞ্চলিক বৈচিত্র্যের কারণে গুরুত্ব পায় না অথচ সেগুলো যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। এবং ‘বিরল’ বলা হলেও শীতকালে এর প্রাদুর্ভাব বেশ বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন-মালগাড়ি-যাত্রীবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ! বিলাসপুরে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় মৃত ৬

মেনিনজাইটাইডিসের প্রাদুর্ভাব
মেনিনজোকক্ক্যাল ডিজিজ হল একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ— নেইসেরিয়া মেনিনজাইটাইডিস ব্যাকটেরিয়া এই রোগ ঘটায়। এটি মেনিনজাইটিস বা সেপটিসিমিয়ার মতো জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। রোগটি হঠাৎ করে জ্বর, চামড়ায় ফুসকুড়ি, ঘাড় শক্ত হওয়া এবং স্নায়বিক ও মানসিক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। দ্রুত অগ্রগতি ঘটলে শক বা মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে। কিছু মানুষ তাদের নাক ও গলায় ওই ব্যাকটেরিয়া বহন করে, কিন্তু তারা অসুস্থ হয় না। তবে, এরা অন্যদের কাছে এটি ছড়িয়ে দিতে পারে। ঝুঁকি বাড়ায় এমন কিছু কারণের মধ্যে রয়েছে— ঘন বসবাসের পরিবেশ, ধূমপান, সাম্প্রতিক ভাইরাল সংক্রমণ এবং দুর্বল ইমিউন সিস্টেম বা স্প্লিন (প্লিহা) সমস্যা।
শীতকালে বিরল হওয়ার কারণ : ভারতে সাধারণভাবে এ রোগের স্থানীয় প্রাদুর্ভাব কম। তবে শীতকালে বিশেষ করে উত্তর ভারতের শহরগুলিতে কখনও কখনও আক্রমণ দেখা যায়। শিশুদের মধ্যে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে, আর দ্বিতীয় প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায় ১৫-২৪ বছরের যুবকদের মধ্যে। তবে ব্যতিক্রম বড়দেরও হয়ে থাকে। ঠান্ডা আবহাওয়া এবং ঘরের ভিড়ের কারণে ড্রপলেট সংক্রমণ সহজ হয়। শীতকালে তাই কখনও কখনও এর প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটে।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা : ভ্যাকসিনেশন সম্ভব, যদিও ভারতে এটি এখনও নিয়মিত অন্তর্ভুক্ত নয়, তবে পাওয়া যায়। রোগের প্রাথমিক সময়ে অ্যান্টিবায়োটিক থেরাপি খুব কার্যকর। শীঘ্রই হাসপাতালে ভর্তি করা অত্যন্ত জরুরি, কারণ রোগের অগ্রগতি দ্রুত এবং জীবনঘাতী হতে পারে।
পারভোভাইরাস বি১৯ সংক্রমণ
পারভোভাইরাস বি১৯ একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা শিশুর মুখে ফিফথ ডিজিজ বা এরাইথেমা ইনফেক্টিওসাম। যা দেখতে ঠিক গালে চড় মারার পর যেমন লালচে গোলাপি দাগ তৈরি হয় তেমনি লাগে এবং ফুসকুড়ির আকারে দেখা যায়। এর সঙ্গে জ্বর, বড়দের ক্ষেত্রে জয়েন্টে ব্যথা এবং হালকা শ্বাসনালির সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন যাঁরা দুর্বল এবং গর্ভবতী। বিরল ক্ষেত্রে, যেখানে শিশুর রক্তের পূর্ববর্তী সমস্যা থাকে, সেখানে এটি এপ্লাস্টিক ক্রাইসিস, যখন কিছু সময়ের জন্য লোহিত রক্তকণিকার সৃষ্টি থেমে যায় অর্থাৎ একপ্রকার রক্তশূন্যতার মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।
শীতকালে বিরল হওয়ার কারণ : প্রাথমিক ক্ষেত্রে ভাইরাসটি ছোঁয়াচে, প্রধানত হাঁচি, কাশি কিংবা থুতুর ছিটে মারফত ছড়ায়। তবে অনেক সময় রক্তের মধ্য দিয়েও সংক্রামিত হতে পারে; গর্ভবতীর মায়ের কাছ থেকে সন্তানের দেহে প্রবেশ করে। এর প্রাদুর্ভাব শীত ও বসন্তের সময় সর্বাধিক হয়। ভারতীয় শিশুর ক্ষেত্রে এটি প্রায়ই হালকা ফুসকুড়ির মতো অন্যান্য রোগের সঙ্গে মিলিয়ে সঠিকভাবে নির্ণয় করা হয় না, তাই বাস্তবিক সংখ্যা কম মনে হয়। শীতকালে এ রোগের কেস বেশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেখা যায়। বিশেষ করে ৫-১৫ বছর বয়সের মধ্যে বাচ্চাদের বেশি লক্ষ করা যায়।

আরও পড়ুন-জগন্নাথ ‘ধাম’ মামলা খারিজ করল হাইকোর্ট

প্রতিরোধ ও চিকিৎসা : এই রোগের কোনও ভ্যাকসিন নেই। প্রধানত সহায়ক বিশ্রাম, পর্যাপ্ত জলপান, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও সাবধানতা মেনে চলা। রোগ সাধারণত ১-২ সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই সেরে যায়। গর্ভবতী মহিলাদের সঙ্গে সংস্পর্শ এড়ানো জরুরি, কারণ এটি ভ্রূণের জন্য রক্তশূন্যতার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
হাত, পা ও মুখের অসুখ
ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে হ্যান্ড, ফুট অ্যান্ড মাউথ ডিজিজ। এই রোগ সাধারণত কক্সস্যাকি ভাইরাস বা এন্টেরোভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট হয়। শিশুদের মধ্যে এটি জ্বর, মুখে ফোড়া বা চুলকানো ক্ষত এবং হাত ও পায়ের ফুসকুড়ির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। বিরল ক্ষেত্রে এটি মেনিনজাইটিস বা এনসেফালাইটিসের মতো গুরুতর জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
শীতকালে বিরল হওয়ার কারণ : এটি মূলত গ্রীষ্মকালীন রোগ হিসেবে পরিচিত। তবে ভারতের কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণের শীতল ও আর্দ্র স্থানগুলোতে শীতকালে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। এই সময় শিশুদের মধ্যে ঘরের ভিতরের সংক্রমণ এবং অনেকক্ষেত্রেই ঘন বসতির কারণে এই ভাইরাস সহজেই ছড়ায়। ‘এন্টেরোভাইরাস ৭১’ নামে যে স্ট্রেন রয়েছে, তার লক্ষণ সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি গুরুতর হতে পারে। শীতকালে কখনও কখনও সঙ্কুচিত মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রধানত ৬ মাস থেকে ৫ বছরের শিশুদের মধ্যে এর প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা : পর্যাপ্ত স্বচ্ছতা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই এর সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক। নিয়মিত হাত ধোয়া, ব্যক্তিগত জিনিস আলাদা রাখা। আক্রান্ত শিশুকে অন্যদের থেকে দূরে রাখা। মনে রাখবেন, এই রোগের জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাস নেই; তবে দুশ্চিন্তার কারণ নেই, সাধারণত ৭-১০ দিনের মধ্যে লক্ষণ স্বাভাবিকভাবে কমে যায়। উপরিউক্ত প্রতিটা সংক্রমণের ক্ষেত্রেই জরুরি গণসচেতনতা।

Latest article